• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

শেষযাত্রা

রাজর্ষি একাই আসে। এবার পাড়ার পুজোর রজতজয়ন্তী বর্ষ। এই ক্লাব সরস্বতী পুজো দিয়ে তাদের কয়েকজনের হাতেই প্রথম শুরু হয়েছিল।

প্রতীকী চিত্র

মাধবী দাস

সকাল ছ’টা। শরৎকাল। জানলার পর্দা সরিয়ে, আকাশের মুখ ভার হয়ে আছে দেখে মেজাজটাই বিগড়ে গেল। সকালে হাঁটতে গেলে, তোর্সার বুকে তুষারশুভ্র কাশফুল দেখে মনটা শীতল হয় রোজ। আজকেও হাঁটা হবে না ভেবে ইনস্টাগ্রামে চোখ রাখলাম। ভেসে উঠল কাশফুলে ঘেরা ঝিল। ঝিল জুড়ে দিগন্তবিস্তৃত পদ্মফুল হাওয়ায় দুলছে। ক্যাপশন— ‘ঘরে ফেরার ডাক’। মিউজিক— ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি’। রাজর্ষির পোস্ট দেখেই টেক্সট করলাম—
কী রে কোন গাড়িতে আসছিস?
—পরশু ঢুকে গেছি।
আজকে ভোরের পোস্ট যে?
—ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইল খুটখাট করতে করতে পোস্ট দিয়ে ফেললাম। তোদের জানানোও হয়ে গেল। জনে জনে মেসেজ করতে হল না। তারপর বল কেমন আছিস?
এই তো চলছে। তোরা?
—আর বলিস না। মায়ের শরীরটা ভালো নেই।
কাকু?
—তথৈবচ। আমার আর শান্তি নেই রে।

Advertisement

পরদিন সকালেও বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে হাঁটাটা সকালের হাঁটার সঙ্গে ঠিক যায় না। আর তাছাড়া সারারাতের বৃষ্টিতে কাশফুলগুলো ভিজে ন্যাতা হয়ে আছে ভেবেও যেতে ইচ্ছে করল না। ঘরেই একটু পায়চারি করছি। ইউটিউব চালিয়ে ফ্রি-হ্যান্ডগুলো সেরে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জীবেশ ফোন করল। এত সকালে জীবেশের ফোন?
আমি, রাজর্ষি আর জীবেশ কলেজে ভর্তির দিন থেকে এক বেঞ্চে বসে তিনবছর কাটিয়েছি। তারপর ইউনিভার্সিটিতে ওরা দু’জন কলকাতায় চলে যায়। আমার আর রেগুলারে পড়া হয়নি। পোস্ট-অফিসের চাকরি জুটে যায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ভরসা রাখতে পারিনি। তখন টাকার খুব দরকার ছিল। বাবা, একা পেরে উঠছিলেন না। পরে মনের ইচ্ছে পূরণ করতে প্রাইভেটে এমএ-টা করেছি বটে, সেই ডিগ্রি রোজগারের কাজে আসেনি আর। রাজর্ষি আর জীবেশ দু’জনেই কলেজে পড়ায় এখন। জীবেশ নিজের শহরেই ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে। বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ভরা সংসার। পাশাপাশি চলছে ছাত্রপাঠ্য বইপত্র লেখার কাজ। বাড়ির কাছেই কলেজ। রাজর্ষি সুযোগ পায়নি, না নেয়নি, সেসব নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। পেশাগত আলোচনা উঠলে আমি একটু এড়িয়েই যাই। সত্যি কথা বলতে— রেজাল্ট ওদের থেকে আমারই ভালো ছিল বরাবর। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার জন্য স্বপ্নটাও ছোট হতে হতে ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সে বন্দি হয়ে গেছিল। ফোনটা রিসিভ করে বললাম—
হ্যালো বল্। রাজর্ষি এসেছে জানিস তো!
—আরে, সেটাই তো বলছি। একটু আগেই কাকিমা চলে গেলেন।
কী বলিস? কালকেই তো রাজর্ষির সঙ্গে কথা হল…
—ঝটপট চলে আয়। ওদের বাড়ির কয়েকজন ছাড়া কেউ নেই তেমন। এখন আর শোনামাত্র গামছা কাঁধে চলে আসার মতো প্রতিবেশীও নেই রে। তার মধ্যে লাগাতার বৃষ্টি—

Advertisement

জীবেশের ঠাকুমা যেদিন পরলোকগমন করেন, আমরা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। সবার হাতে মোবাইল ফোন ছিল না তখন। ল্যান্ডফোনও পাড়ার মুষ্টিমেয় কয়েকটা বাড়িতে থাকত। কীভাবে যেন ছড়িয়ে পড়ত খবর। মধ্যরাতেও জমা হয়ে যেত কত মানুষ! কে আত্মীয়, কে অনাত্মীয় ভেদাভেদ ছিল না। শবযাত্রার সমস্ত বন্দোবস্ত কখন, কীভাবে, কারা করে ফেলত বাড়ির লোক বুঝতেই পারত না। শোকে বোঝার পরিস্থিতিও থাকত না। এইসব আত্মিক-সামাজিক-আধ্যাত্মিক সম্পর্কগুলো ভেজা কাশফুলের মতো যেন নেতিয়ে গেছে।‌ পদ্মফুল এখন ছাদের জলটবে। গলা জলে নেমে সাপের কামড়ের ভয় নিয়ে পদ্মফুল তোলার অ্যাডভেঞ্চার নেই। একশো আটটা নীলপদ্ম খুঁজতে বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করেও মরে না কেউ এখন। প্রিয়জন হারিয়ে গেলে বুকের উপর হামলে পড়ে কাঁদতেও যেন সংকোচ। দুঃখ প্রকাশের জন্য একমাত্র সম্বল সোস্যাল মিডিয়ার খোলা পৃষ্ঠা! তাই মৃতদেহ বহন করার লোকের কথা ভাবতে হয়। টাকা দিয়ে আনা হয় শকটযান কিংবা ভাড়াটে মানুষ। কাঁধ পাল্টে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি আর নেই। পাড়াপড়শি জানালার ফাঁক দিয়ে একটু দেখে, মুখে একটা ‘চু’ শব্দ করে প্রণাম জানিয়ে শবযাত্রায় অংশ নেয়। অথচ একটু উষ্ণতা পেলেই আবার ভেজা কাশফুলের মতো সম্পর্কগুলো ডানা মেলতে পারে। ফোনের ওইপারে যে জীবেশ তখনও কথা বলে যাচ্ছে আমি খেয়ালই করিনি। আজকাল প্রায়ই এমন হারিয়ে যাই নিজের সঙ্গে।
—কী রে, চুপ হয়ে গেলি যে! যাবি না নাকি? তুই রেডি হয়ে নে আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
হুঁ, আয়।
ফোনটা রাখার আগে জীবেশের গলা বুজে আসছিল। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলল—
—প্রিয় মানুষের মৃত্যুর সময় যদি পাশে না থাকি, আমাদেরও যে শেষযাত্রায় একাই যেতে হবে। আর কত একা, একাকিত্ব, নৈঃশব্দ্য নিয়ে কবিতা লিখব আমরা?
—ঠিক বলেছিস। একাকিত্ব উদযাপন করতে করতে বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছিরে আমরা। আমি চৌরাস্তার মোড়ে থাকলাম। জীবেশ তুই চলে আয়।


ফোন রেখে ছেলের জন্য কোনওরকমে সকালের খাবার বানিয়ে, ডাইনিং টেবিলে ঢাকা দিয়ে
—‘খেয়ে নিস। আমি জীবেশের সঙ্গে রাজর্ষিদের বাড়ি যাচ্ছি। আজ ভোরে ওর মা…’

হোয়াটসঅ্যাপে ছেলেকে এমন একটা মেসেজ লিখে দিয়ে, বেরিয়ে এসে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়ালাম। জীবেশ এল। সঙ্গে স্ত্রী, অন্বেষা। অন্বেষা কলকাতার মেয়ে। রাজর্ষির স্ত্রীর সঙ্গেই পরের ইয়ারে ছিল। সেখান থেকেই ওদের সম্পর্ক। তারপর বিয়ে। রাজর্ষির স্ত্রী, মনিমা হাইস্কুলে চাকরি পেয়ে গেছে। অন্বেষা সংসার নিয়ে হাবুডুবু খেলেও স্বপ্ন ছাড়েনি। পিএইচডি করছে। নেট কোয়ালিফাই করা আছে। মনে মনে চাইছে ছেলেটা একটু বড় হয়ে গেলে চাকরিটা হলেই ভালো। জীবেশের বাবা-মা এখনও শক্তসামর্থ্য। ডাক্তার দেখানোর সময় একটু সঙ্গে যেতে হয়। তাছাড়া নিজেরাই নিজেদের মতো নাতিকে নিয়ে বেশ কাটাচ্ছেন।
নীরবতা ভেঙে অন্বেষা আমাকে জিজ্ঞেস করল—
—আপনার মা চলে গেছেন কতদিন হল?
—তা প্রায় পাঁচ বছর।

চাকরিটা আগে পাওয়ায় আমার বিয়ে, ওদের অনেক আগেই। ছেলেও বড় হয়ে গেছে। পড়াশোনা শেষ করে ও এখন চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে। সাংসারিক অভিজ্ঞতা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি আমার। সত্যি দেখতে দেখতে মা নেই পাঁচ বছর…! মায়ের চলে যাওয়া প্রত্যেক সন্তানকে সত্যিকারের সাবালক করে। সংসারের সব সমস্যায় মায়ের ভূমিকা ‘মুশকিল আসান’। মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক বা সামাজিক— যাই হোক না কেন! মায়ের উপস্থিতিই যেন সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের শক্তি। আমার আর জীবেশের মধ্যে অদ্ভুত একটা নীরবতা বয়ে যাচ্ছিল দেখে অন্বেষা আবার কথা বলার জন্য বলল—
—এখন তো জীবেশের মা কেবল…

জীবেশ, অন্বেষার কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করতে দিল না। আগেই মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বলল,
—কখন কী বলতে হয় এখনও শিখলে না, অন্বেষা। কেন তোমার মাও তো বেঁচে আছেন। আমার মায়ের কথাই মাথায় এল কেন?
—আমি তো তোমাদের তিনবন্ধুর মায়ের কথা বলতে গিয়ে…
—থাক আর বলতে হবে না। আমি ওসব ভাবতেই চাই না।
অন্বেষাকে চুপ করিয়ে অপেক্ষাকৃত নিচুস্বরে আমাকে বলে উঠল—
—আচ্ছা তোর মনে পড়ে, আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের দুই বেলার পরীক্ষার সময় রাজর্ষির মা, কাকিমা কতটা পথ হেঁটে ওকে টিফিন খাইয়ে যেতেন? খুব মনে পড়ছে রে কাকিমাকে আজ। আমরাও তো কখনও যাইনি বেঁচে থাকতে। একটিবার গেলে কত খুশি হতেন বল তো!

বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে সামনের ভেজা রাস্তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। সারারাতের বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট যেন মৃতদেহের মতো শান্তিতে শুয়ে আছে। মাঝেমাঝে উইন্ডশিল্ডে ওয়াইপারের দু’হাত এসে জল মুছে দিয়ে যাচ্ছে। অঝোরে কেউ কাঁদতে থাকলে অজান্তেই যেমন করে দু’হাত এসে জল মুছে চোখের ঝাপসা কাটিয়ে দেয়, ঠিক তেমন করে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমার এই দুঃখানুভূতি, কার জন্য? রাজর্ষির মায়ের সঙ্গে আমাদের মোটেই যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং, কাকিমার জন্য এত খারাপ লাগার কথা নয়। রাজর্ষির জন্য? তবে কি আমার মায়ের জন্য?

জীবেশের কথাটা শোনার পরেও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে, জীবেশ স্টিয়ারিং থেকে হাতটা সরিয়ে আমাকে একটু ধাক্কা দিয়ে আবার বলল,
—কী রে, শুনলি আমি কি বললাম?
আমি একটু বিজ্ঞের মতো উত্তর দিলাম,
—মানুষ বেঁচে থাকতে অনেক কিছুই আমরা ভাবি না রে। এই যে এখন ভাবছি, এটাও সাময়িক। এর থেকে আমরা কোনও শিক্ষাও নেব না। সবাই আসলে আমরা পরম্পরাগতভাবে এক। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ বুঝলি!


আমরা যখন রাজর্ষির বাড়িতে ঢুকলাম, তখন রাজর্ষির বাবাকে দিয়ে কয়েকজন বয়স্ক মহিলা শেষযাত্রার নিয়ম-আচারগুলো করাচ্ছেন। এয়োস্ত্রীরা কাকিমার পায়ের কাছে রেখে যাচ্ছেন আলতা আর সিঁদুরের প্যাকেট। কেউ আবার সিঁথি রাঙিয়ে দিয়ে প্রণাম করছেন। কাকিমার মাথাভরা পাকা চুল যেন আমাদের চিরচেনা তোর্সাচরের কাশবন। নদীর বুকে অস্তমিত সূর্য ডোবার যে রক্তিমাভা, অগোছালো সিঁথি জুড়ে সেই আভা দেখে চোখ সরাতে পারছি না। ভাবছি একটু পরেই অন্ধকার ঘিরে ফেলবে এই কাশবন। আগুনের লেলিহান শিখায় চিরকালের মতো মুছে যাবে এতদিনের সিঁদুরের পথ। ঠিক যেমন করে তোর্সার বুকে রাত নেমে আসে।

কাকাবাবু নাছোড়বান্দা হয়ে রয়েছেন শেষযাত্রায় যাবেন। যতক্ষণ পঞ্চভূতে বিলীন না হচ্ছে কাকিমার দেহ, ততক্ষণ তিনি সঙ্গে থাকবেন। ছেচল্লিশ বছরের জীবনপথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেননি। এই বিচ্ছেদ অনিবার্য জেনেও শিশুসুলভ বায়না জুড়ে দিয়েছেন। আমাদের কাছে পেয়ে, বায়না আরও যেন জোরালো হল। ঘরে নিজের বিপত্নীক বাবার মানসিক টানাপোড়েন প্রতিনিয়ত দেখি। কিছুটা হলেও বোঝার চেষ্টা করি, এ ব্যথার অনুভূতি কতটা দুর্বিষহ! এদিকে রাজর্ষির কাছে এসব বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখেমুখে শোকের থেকে বিরক্তি যেন বেশি ফুটে উঠেছে। যেন মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে— মরার আর দিন পেল না মা! একেবারে পঞ্চমীর দিন? দুটো দিন বাদে হলেও তো পুজোতে একটু থাকতে পারতাম। এতদূর থেকে মেয়ে-বউকে নিয়ে এসেছি এবার। কতরকম পোশাক কিনে এনেছে ওরা। একেকদিন একেকটা পরবে! সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেল মা!

কাকাবাবু ছাড়া সবাই বুঝতে পারছি এই শরীরে তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া সম্ভবও না। উচিতও না। শেষপর্যন্ত আমি আর অন্বেষা কাকাবাবুকে সামলাতে মনিমার সঙ্গে বাড়িতেই থেকে গেলাম। মনিমা বিয়ের পর, এই নয় বছরে সবমিলিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ত্রিশ দিন থেকেছে কিনা সন্দেহ। যাতায়াত যতটুকু রাজর্ষি করে। মেয়ে নিয়ে, চাকরি নিয়ে এতটাই বাঁধাধরা জীবন যে, মনিমার আর শ্বশুরবাড়ি আসাই হয় না। ছুটিছাটা পেলে বাবা-মায়ের কাছে দু’দিন কাটিয়ে আসতে মন চাওয়াটাও তো তার অপরাধ নয়। এসব বোঝাপড়া দু’জনের মধ্যে আছে বলেই সংসারে অশান্তি নেই। রাজর্ষি এসে বাবা-মায়ের দেখভাল করে যায়। এই যাতায়াত যে সবসময় প্রাণের তাগিদে করে এমনটাও নয়। প্রতিবেশীরা, নিকট আত্মীয়রা বুড়োবুড়িকে রাজর্ষির কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ কম দেয়নি। যতবার সে বাড়িতে আসে, কেউ না কেউ বলেই ফেলে— কম কষ্ট তো করেনি, তোকে কলকাতায় রেখে পড়ানোর জন্য তোর বাবা-মা! ডাক্তার দেখানো তো দূরের কথা, নিজেরা ঠিকমতো না খেয়েও টাকা পাঠিয়েছে। এর জন্য এত শরীর খারাপ ওঁদের। এই বয়সে এখন বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখ। এভাবে হয় না। কাজের লোক যতই করুক, সন্তানের সান্নিধ্যসুখ তো আর দিতে পারে না।

এসব বস্তাপচা উপদেশ শুনতে শুনতে রাজর্ষি ধাতস্থ হয়ে গেছে। বললেই তো আর নেওয়া যায় না। খোলামেলা মফস্‌সল এলাকার মানুষ কলকাতার চার দেওয়ালের বন্দি জীবনে হাঁফিয়ে উঠবেন, এমন বলেই সবাইকে জবাবদিহি করলেও বাকি কথা বলেনি। বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। প্রায় সব সংসারেই এসব না-মানিয়ে চলা থাকে ভেবে, রাজর্ষি নৈতিক দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থাকেনি। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছে— বাবা-মায়ের দুজনেরই ওষুধময় জীবন। কেউ বেশিদিন টিঁকবে না। যতদিন বাঁচে এভাবে একটু কষ্ট করতেই হবে আমাকে। আত্মীয় পরিজন না হলে থুতু ছেটাতে ছাড়বে না। তারপর তো নিজের মতো বাঁচা…। মুখে না বললেও কথাবার্তায় এমন আভাস পাওয়া গেছে অনেকবার। দেখা হলেই বাবা-মায়ের দেখভাল নিয়ে নানারকম অভিযোগের গল্প করেছে আমাদের সঙ্গে। আমি আমার মতো বুঝিয়েছি। জীবেশও। হয়তো বস্তাপচা উপদেশ ভেবে শুনেও শোনেনি।

সব পুজোতে মনিমা আসে না। বিয়ের বছর এসেছিল কেবল। রাজর্ষি একাই আসে। এবার পাড়ার পুজোর রজতজয়ন্তী বর্ষ। এই ক্লাব সরস্বতী পুজো দিয়ে তাদের কয়েকজনের হাতেই প্রথম শুরু হয়েছিল। তারপর পাশের পাড়ার মিলন সঙ্ঘের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়, দুম করেই একবার শুরু হয়ে গিয়েছিল দুর্গাপুজো। এই ক্লাবকে ঘিরে রাজর্ষির স্মৃতি, আবেগের অন্ত নেই। মায়ের শরীর বহুবছর থেকেই মন্দ-ভালোয় চলছে। একমাত্র ছেলে হিসেবে চিকিৎসার ত্রুটিও করেনি রাজর্ষি। নিজে কাছে থাকতে পারে না বলে, সবসময়ের জন্য একজন সহায়িকা রাখা আছে বাড়িতে। বাজারহাট থেকে ওষুধ কেনা, যত্নআত্তি সবকিছু রাজর্ষি টাকা দিয়েই কিনে রেখেছে। মোটা মাইনে দেয়। বেগতিক হলে নিজেও চলে এসে, অবস্থা সামলে আবার ফিরে যায়। সেই নিয়ে কাকাবাবু বা কাকিমার কোনও অভিযোগের সম্মুখীন রাজর্ষিকে হতে হয়নি। পাড়ার লোক তাঁদের কিছু বললে, উল্টে বলে দিতেন— ছেলেটা সরকারি চাকরি করে। পোস্টিং কাছে পায়নি। ওর আর কী দোষ?


রাজর্ষিকে নিয়ে জীবেশরা ফিরে এসেছে দেখে আমরা যেন ভরসা পেলাম একটু। দাদুর মাথার পাশে বসা তখন রাজর্ষির মেয়ে। ছোটো ছোটো হাত, মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে। ছয় বছরের ছোট্ট মেয়েটি যেন দাদুর একা হয়ে যাওয়ার কথা ভেবেই আচ্ছন্ন। যাওয়া আসা তেমন নেই তাদের। ঠাকুমার মৃত্যু বা চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া, এসব দুঃখ-বিষাদ সে বোঝে না। ঠাকুমার জন্য বিয়োগব্যথা জন্মানোর জন্য যতটুকু সান্নিধ্য পেতে হয় সেই সুযোগ তার আসেনি। সে শুধু বুঝেছে, তার বাবার মা আকাশের তারা হয়ে গেছে। আর ফিরতে পারবে না। বাবাকে দেখে প্রশ্ন করে— পাপা তুমি মায়ের কথা শুনতে না? মাকে ভালোবাসতে না? তবে যে ঠাম্মা তোমাকে ছেড়ে চলে গেল? মা তো বলে— মায়ের কথা না শুনলে, মা আকাশের তারা হয়ে যাবে। আমি তো শুনি। আমি তো খুব ভালবাসি মাকে। মাকে ছাড়া আমি তো বড় হতেই পারব না।

এদিকে কাকাবাবুকে জিভের নিচে ওষুধ দিয়ে সাময়িক সুস্থ করা গেলেও ডাক্তার ডাকাটা বড় জরুরি। আমরা সবাই রাজর্ষিকে ডাক্তারকে ফোন করতে বলতেই সে মেজাজ হারিয়ে ফেলল।

—আমার জীবনটা উপভোগ করতেই দিল না এই দু’জন। আর কবে করব? বুড়ো হলে? সারাটা জীবন কষ্টের মধ্যে লড়াই করে বড় হয়েছি। এখন একটু সুখের মুখ দেখেছি। তবু শান্তি পেলাম না বাবা-মায়ের জন্য। আমি ডাক্তার-টাক্তার ডাকতে পারব না। তোরা কী করবি কর!

জীবেশ, আমি, অন্বেষা— এই তিনজন পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বড়দের কথা শুনতে নেই বলে, মনিমা মেয়েকে এ ঘর থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে। আমার বাড়ি থেকে ছেলের ফোন এল— বাড়িতে এসো তাড়াতাড়ি। দুপুরে কী খাব?

Advertisement