শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়
কৃশানু পড়াতে পড়াতে পেছনে ফিরে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালো একবার। সকলের আগ্রহী চোখে-মুখে একটা উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে আছে যেন। কৃশানু আবার বলতে শুরু করল।
Advertisement
আম্ফানের পরবর্তী সময়ে যখন দিকে দিকে ত্রাণের জন্য হাহাকার পড়ে গেছিল, তখন কৃশানু ও তার সব বন্ধুরা একসঙ্গে এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। ত্রাণ নিয়ে ওরা হাজির হয়েছিল সাগরদ্বীপের এই প্রত্যন্ত গ্রামে।
Advertisement
ঘর-বাড়িগুলো যেন একপ্রকার ধ্বংসস্তূপের মতো পড়েছিল চারদিকে। অসহায় ছোট্ট ছেলে-মেয়েগুলো মায়ের আঁচলের খুঁট ধরে তাকিয়েছিল তাদের দিকে। কৃশানু খোঁজ নিয়েছিল ঝড়ের পর স্থানীয় স্কুল বা পাঠশালাগুলো কীরকম অবস্থায় আছে। উত্তরে গ্রামের প্রধান এগিয়ে এসে জানিয়েছিল, এ অঞ্চলে কোনো প্রাথমিক স্কুল নেই। বহুকাল আগে একটা পাঠশালা মতো ছিল বটে, কিন্তু তা কবে উঠে গিয়ে এখন জঙ্গল হয়ে আছে।
এখানকার বেশিরভাগ লোকই দিনমজুর, নয়তো মাছ ধরে, বন থেকে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অতএব এসব বিষয়ে তাদের আগ্রহও বেশ কম। পড়াশোনার চেয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের খেত-খামারে কিংবা দোকান-হাটে কাজ করতে পাঠানো বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করে। এর ফলে জন্ম নিচ্ছে অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা।
সেই মুহূর্তেই কৃশানুুু মনস্থির করে এই ছোট্ট শিশুগুলোর মধ্যে সে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবে। কিন্তু সে তো প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। তার পক্ষে শনি-রবি ছাড়া ছুটি বের করা অসম্ভব। তাই প্রথম প্রথম শনি-রবিবার করেই পঞ্চায়েতের একটা ঘর নিয়ে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করেছিল।
কিন্তু তারপর একে একে অনেকে কৃশানুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাত্র তিন মাসে মোটামুটি একটা স্কুলের মতো দাঁড় করাতে পেরেছে। এখন পাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকেও ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে এখানে।
রহিম নামের ছেলেটির জানার আগ্রহ অবাক করে কৃশানুকে। সেদিন কৃশানু তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সে বড়ো হয়ে কী হতে চায়? উত্তরে রহিম বলেছিল, ‘আমাদের দেশকে বিশ্বের দরবারে সেরা করতে চাই।’
কৃশানু পিঠ চাপড়ে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিল।
সেদিন বিকেলে রহিম তখন বনে-বাদাড়ে প্রজাপতির পেছন পেছন দৌড়চ্ছে। ঠিক তখন হঠাৎই গ্রাম জুড়ে কীসের একটা শোরগোল পড়ে গেল। রহিম ওদের চালাঘরের সামনেটায় ছুট্টে এসে দেখল, সারা গ্রাম সেখানে এসে দাঁড়িয়ে জটলা করছে।
ভিড় ঠেলে কাছে যেতে রহিম বুঝতে পারল ব্যাপারটা। মাছ ধরে ঘরে ফেরার সময় ওর চাচা হামিরুদ্দিনকে নদীর পাড়ে সাপে কেটেছে। সকলে বলাবলি করছে ভয়ানক বিষাক্ত সাপ। রহিম দেখল জটলার মাঝখানে হামিরুদ্দিন প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হাঁটুর নীচ দিয়ে একটা গামছা কষে বাঁধা।
রহিম চারপাশে তাকিয়ে আম্মিকে দেখতে পেল। ‘চাচাকে তো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে বেশিক্ষণ রাখলে…’
আম্মি ওকে ধমকে কড়া গলায় বলল, ‘থাম তুই। ওরা সকলে মিলে ওঝা মশাইকে ডাকতে গেছে। তিনি এসেই একটা বিহিত করবেন।’
বলতে বলতেই রহিম দেখতে পেল ওঝা মশাই এসে হাজির হয়েছেন। রোগীকে এক ঝলক দেখে নিয়ে, কী কী করতে হবে তার বিধান দিতে লাগলেন তিনি।
রহিম জানে, কৃশানু স্যার ওদের বহুবার জানিয়েছে এরকম মুহূর্তে ঠিক কী করতে হবে। ক্যাম্প করে গ্রামবাসীদের অন্ধ কুসংস্কার দূর করতে বহু চেষ্টা করেছে তারা। কিন্তু কেউ তার কথা শুনলে তো!
যখন শত বলেও রহিম দেখল কোনো লাভ হচ্ছে না, তখন সে দৌড় দিল স্কুলবাড়ির দিকে।
কৃশানু ও অন্যান্যরা তখন সবেমাত্র দরজা বন্ধ করে বাড়ির দিকে রওনা দিতে যাবে। রহিমকে এ সময়ে দেখে অবাক হল কৃশানু। রহিম গড়গড় করে সমস্ত ঘটনা বলল। সব শুনে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সবাই ছুটে এল রহিমদের বাড়ির কাছে।
একটা ট্রেকার জোগাড় করে কৃশানুরা যখন হামিরুদ্দিনকে দশ ক্রোশ দূরের গ্রামীণ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে তখন চিৎকার করে উঠল সেই ওঝা। গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়ে সে বলে ওঠে, ‘যদি হামিরুদ্দিনের কোনো ভালো-খারাপ হয়, তবে এরাই তার জন্য দায়ী হবে এবং সেক্ষেত্রে ওদের যেন এ গ্রামে টিকিটি না দেখা যায়।’
চমকে উঠল কৃশানু। সাপে কাটা রুগীকে অন্তত দেড়-দু’ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এখন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। কী হবে ভেবে পেল না কৃশানু।
ওদের যদি ফিরে যেতে হয় তবে এই স্কুলের কী হবে? এতোগুলো শিশু শিক্ষার আলো পাচ্ছিল! হাসপাতালে দাঁড়িয়ে এসব কথাই চিন্তা করছিল কৃশানু। ভেতরে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে হামিরুদ্দিনের চিকিৎসা চলছে।
সময় গড়িয়ে যেতে লাগল নিজের তালে। অবশেষে কিছুক্ষণ পর কে যেন খবর নিয়ে এল ডাক্তার বলেছে, হামিরুদ্দিন এখন বিপদমুক্ত।
কৃশানু আনন্দে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রহিমকে জড়িয়ে ধরে। এতটুকু ছেলে আজ যা করেছে! ওর শিক্ষা দেওয়া সত্যিই যেন আজ সার্থক।
এখানেই থেমে থাকেনি ওরা। স্টেশনে, ফুটপাতের সমস্ত শিশুদের শিক্ষিত করার অঙ্গীকার নিয়েছে ওরা। চায়ের দোকান, রোল সেন্টারে খাটতে খাটতে যে শৈশব ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে, তাদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছে কৃশানুরা।
ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কৃশানুর মনে হয়, এরাই হয়তো কোনোদিন হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের দেশনায়ক।
Advertisement



