দীপককুমার মাইতি
সকাল দশটা। বিমল ও মিনু গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে নামে। বিমল মালপত্তর নামিয়ে রাখতেই ভ্যান চালক দিনু এগিয়ে আসে— বাবু, তোন্নে আইসচু! চ, ভ্যানে উঠি পড়। বউদি তোনকে লিতে পাঠইছে।
বলেই তাদের মালপত্তর ভ্যানে তুলতে তুলতে তাদের দিকে তাকায়— বাবু, তোর অউ পুটলাটা বেজায় ভারী। কী অত আনছু?
বিমল হাসে— আর বলবে না কাকা, তোমার বউমা রান্নাপূজার সব গুছিয়ে বাজার করেছে। কোনও কিছু বাদ যায়নি।
দিনু মিনুর দিকে তাকায়— মা-লক্ষ্মী ইলিশ আনছো তো? তোমার শউর আউজকার দিনে ভোর নু সবু বাজারে ঘুরি ঘুরি সেরা ইলিশ আনথন। মা-মনসা যে ইলিশ খুব ভল পান।
বিমলের স্মৃতিতে জেগে ওঠে আজকের দিনে বাবার ইলিশ মাছ আনার কথা। কাছে পিঠে সব বাজারে ঘুরে ঘুরে সেরা ইলিশ আনবেনই। সে দিনুকে আশ্বস্ত করে— সে আর বলতে। সকালে উঠে আমাকে বাজারে পাঠিয়েছিল। দিনুকা কাল দুপুরে খেতে আসবে।
—তোকে আর কইতে হবেনি। আইজ ভোরে তোন্নে আইসবু বলি খিড়কি পুকুরে জাল দিতে ডাকথালা তোর মা। মাছ ধরার পর বউদি কাল ভোগ খাইতে ডাকছন।
উৎসাহিত মিনু জানতে চায়— কাকা কী কী মাছ ধরেছেন?
মিনু আর দিনু বকবক করতে করতে চলেছে। বিমলের মন কিন্তু শঙ্কিত। সে আসতে চাইছিল না। মনে পড়ে গতকালের কথা। সকালে দু’জনে চায়ের টেবিলে চা নিয়ে বসে। মিনু চায়ে চুমুক দিয়ে তার দিকে তাকায়— কাল রান্নাপুজো। বাড়িতে পুজো করবেন মা। যাবে না?
রেগে ওঠে বিমল— আবার বাড়ি যাওয়ার নাম করছো? অপমানিত হওয়ার শখ হয়েছে?
ম্লান হাসে মিনু— তিনি তোমার মা। আমি তাঁর একমাত্র ছেলের বউ। বাড়িতে পুজো। তাঁর উপর রাগ করে বসে থাকা কি উচিত?
—দেখো, মা হোক আর বাবা হোক, আমি কোন অন্যায় কথা বরদাস্ত করি না।
—আমাদের চার বছর বিয়ে হল। এখনও আমি মা হতে পারলাম না। তিনি মা, উতলা তো হবেন। তাঁরও তো নাতি বা নাতনির মুখ দেখতে ইচ্ছে করবেই। এতে দোষের কী আছে?
—ডাক্তারবাবু তো বলেছেন অপেক্ষা করতে। তোমার বা আমার কোনও দোষ নেই। মা আবার বিয়ের কথা ভাবেন কীকরে? তোমাকে বাঁজা বলে খোঁটা পেতে হল।
—সেই পুরানো কথা! বলি মা কি তোমাকে আবার বিয়ের কথা বলেছেন? বা আমাকে বাঁজ়া বলে খোঁটা দিয়েছেন!
—ছোটখুড়ি বিদ্রুপ করেছিল। মা তো ছোটখুড়িকে বারণ করতে পারত।
—আমরা থাকি না। ছোটখুড়িরাই তো খোঁজ খবর রাখেন। তাই চুপ ছিলেন।
বিমল রেগে ওঠে— ছোটখুড়ির তার বোনের মেয়ে পারুলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। তাই তিনি চক্রান্ত করছেন। মা কি জানেন না? মৌন থাকেন কেন?
মিনু ওর হাত চেপে ধরে— আমার খুব ইচ্ছে এবার রান্নাপুজোয় বাড়িতে যাই। মা একা একা সব সামলান। আমার তো যাওয়া উচিত, তাই না!
বিমল তার দিকে তাকায়— মা তোমাকে ডেকেছেন? রান্নাপুজোয় যাওয়ার জিদ করছো কেন?
মিনু হাসে— তুমি হাসালে। আমি বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ। আমাকে কি তিনি পান-সুপারি দিয়ে নেমন্তন্ন করবেন? তাছাড়া ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন বেহুলার কথায় চাঁদ সওদাগর মনসা পুজো করেছিলেন। পরের দিন তিনি সপ্তডিঙা ও তাঁর সাত সন্তানকে ফিরে পান। তাই তো ভাদ্রমাসের সক্রান্তির দিন রান্না করে মা-মনসাকে পরের দিন পুজো দিতে হয়। পরের দিন বাড়িতে অরন্ধন। জনশ্রুতি, ‘ভাদ্রে রাঁধে আশ্বিনে খায়/ যে বর মাগে সেই বর পায়।’
হো হো করে হাসে বিমল— এতক্ষণে বুঝলাম। হাতে, কোমরে মাদুলি আংটি পরেও হল না। শেষে মা-মনসার দুয়ারে ধরনা দিতে চাও? তোমার এই কুসংস্কার আর মানতে পারছি না।
মিনতি করে মিনু— কী করি বলো, তোমার মত নাস্তিক হতে পারলাম কই। এবার কিন্তু সন্তানের জন্য মানত নয়। অন্য বর চাইব।
—তা কী বর শুনি! সতীন আনার বর চাইবে?
—সরকারি চাকরির পরীক্ষা পাশ করে বসে আছো। প্রায় আট মাস হল এখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এলো না। তোমার জন্য মানত করেছিলাম। চিঠি এলে নিজে ভোগ রান্না করে পুজো দেব।
হেসে ওঠে বিমল— তা চিঠি না পেয়ে পুজো দেবে? মানে মা-মনসাকে ঘুস দেবে?
ভ্যানের হর্নের শব্দে বিমলের চিন্তায় ছেদ ঘটে। তাকিয়ে দেখে বাড়ির সামনে ভ্যান দাঁড়িয়ে। হর্নের শব্দ পেয়ে তার মা গিরিজা বেরিয়ে আসে। বিমল নেমে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে— মা ভালো আছো?
গিরিজা তার মাথায় হাত রাখেন— বাবু তোকে কেমন রোগা লাগছে কেন? শরীর ভালো তো?
মিনু গড় হয়ে গিরিজাকে প্রণাম করে। তিনি দু’হাত দিয়ে মিনুকে তুলে ধরেন— এতদিনে মায়ের কথা মনে পড়ল! তোর চোখের কোনেও কালি কেন?
মিনু ম্লান হাসে— মা, শরীরের আর কী দোষ। সারাদিন ঘুরে ঘুরে টিউশন পড়াই দু’জনে। রাত না হলে বিশ্রাম কই। বাড়ি আসতে তো ইচ্ছে করে। কিন্তু টিউশন বন্ধ করলে অভিভাবকদের মুখ হাঁড়ি হয়।
গিরিজা মিনুর হাত শক্ত করে ধরেন— চল ভিতরে চল। দিনু মালপত্তর সব ভিতরে নিয়ে আয়। বেলা হয়েছে, এখানেই খেয়ে নিবি।
গিরিজা অনেক মাল দেখে অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকান— বাবু, এতসব কী এনেছিস?
মিনু হাসে— মা, রান্নাপূজার জন্য ফলমুল, সবজি, নারকেল, খেসারির ডাল, ময়দা, চিনি, মুগডাল, তৈজপত্র সব বাজার করে এনেছি। পুজোর জন্য আর বাজারে যেতে হবে না।
দিনুর উৎসাহিত গলা— বউদি, মা-লক্ষ্মী ইলিশ বি লিশচন।
তার কথার ধরন দেখে সবাই হেসে ফেলে। সকলে উঠোনে বসে গল্প করছে। কাজের মাসি সরবত আনে। সরবতে চুমুক দেয় মিন— মা, কচুশাক, মান, ডাঁটি শুদ্ধ শালুক ফুল এনে রেখেছেন? না দিনু খুড়োকে আনতে বলব!
গিরিজা হেসে তার মাথায় হাত রাখেন— এ তো আমার শাশুড়িঠাকরুন এলেন। দিনুকে দিয়ে সকালে সব এনে রেখেছি। বাজারে ওকেই পাঠাতাম, তুই তো সব এনেছিস। যা তোরা স্নান সেরে খেয়ে নে। বাবু পুকুর ঘাট থেকে কয়েকটা মান পাতা ও কলা পাতা কেটে আনিস। খাওয়ার পর পুজোর কাজ শুরু করতে হবে।
মিনুর মিনতি ভরা গলার স্বর— মা, আমি এবার পুজোর ভোগ রান্না করতে পারব?
গিরিজা ওর দিকে তাকান— তুমি ঘরের বউ। কেন পারবে না! এ তো ভালো কথা। কিন্তু…
বিমলের মনে শঙ্কা— কিন্তু কী মা!
—এতটা পথ বাসে এলে। ভোগ রাঁধতে হলে উপোস থাকতে হবে। রাতে পুজো শেষ হলে খাওয়া। ধকল নিতে পারবে তো? থাক মা, আমি করে নেব।
হেসে ওঠে মিনু— মা আপনি এই বয়সে পারলে আমি পারব না! আমাকেও তো শিখতে হবে। পুজোর জন্য সকাল থেকে উপোসে আছি।
গিরিজা হেসে সস্নেহে বিমলাকে জড়িয়ে ধরেন।
২
মায়ের হাতে মৌরলা মাছের টক বিমল অনেকদিন পর খেল। খাওয়াটা বেশি হয়েছে। ভাদ্রে মাসের ভ্যাপসা গরম ছিল। দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। গরমের পর বৃষ্টির ঠান্ডার পরশে বিমল ঘুমিয়ে পড়েছিল। একটা চেনা সুগন্ধ তার নাকে ঝাপটা মারে। চোখ মেলে দেখে, লালপাড়ের সাদা শাড়ি পরে মিনু দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল অবিন্যস্ত হয়ে এলিয়ে রয়েছে। কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ, মুখে ঘামের বিন্দু চক চক করছে। একগাছি চুল তার মুখে পড়েছে। শাড়ির নিচে ব্লাউজ নেই। উন্নত যৌবন তাকে আকর্ষণ করছে। পারে না নিজেকে সামলাতে। লোভী হাত বাড়ায় মিনুর দিকে। সে ছিটকে পিছিয়ে যায়— আঃ কী করছ। ছুঁয়ে দেবে যে। ভোগ রান্না শেষ হয়নি। খালি অসভ্যতা! ছোটখুড়ি তোমাকে চা খেতে ডাকছেন। ছোটখুড়ো তোমার জন্য বসে আছেন।
কানে হাত দেয় বিমল— সরি, মা ঠাকরুন। তা কী ভোগ রাঁধলে?
মিনু হাতে কর গুনে গুনে বলে— নারকেল দিয়ে মুগডাল, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক, চিংড়ি দিয়ে গাঁটি কচুর তরকারি, লাবড়া, কাতলা মাছের ভাজা, আলু, পটল, বেগুন, কাকরোল ও কাঁচকলা পাঁচ রকম ভাজা ও চালতা চাটনি। এখন সরষে ইলিশ বাকি। মা পায়েস করছেন।
বিমল হাসে— কাল কি শুধু তরকারি খাব! ভাত রান্না করবে না?
—কিছুই জানো না দেখছি। মাটির হাঁড়িতে সবার শেষে ভাত করতে হয়। ফ্যান গেলে ঠান্ডা জল দিয়ে রাখতে হবে। কথা বলে আমার সময় নষ্ট করছ। পারুল চা করছে। যাও।
বিমল বিস্মিত হয়— পারুল কখন এলো?
—অতশত জানি না বাপু। যাও। মেলা কাজ বাকি। আমি যাই।
বলেই চোখে শ্লেষ হেনে মিনু চলে যায়। বিমল ভাবে যাবে কিনা! তখনই শুনতে পায় ছোটখুড়ির গলা— মিনু, বিমলকে বলেছো! তিনি আবার ভাইপোর জন্য বসে আছেন।
—হ্যাঁ ছোটখুড়ি। ঘুমিয়েছিল। এখুনি যাবে।
ছোটখুড়ো বিমলকে খুব ভালোবাসেন। বিমল বাড়িতে এলে তার কাছে কলকাতার নানা খবর নেন। তাই সে ছোটখুড়োর বাড়িতে যায়। গল্প করে সন্ধ্যায় ফেরে। ঘরে ঢুকে শাঁখের শব্দ ও মনসার পাঁচালি পড়ার সুর শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে রান্নাঘরে চলে আসে। দেখে মাটির উনুন সুন্দর করে গোবর দিয়ে নিকানো। তার মধ্যে একটা মনসার ডাল রাখা। উনুন বেড়ি করে ডাঁটি ভেঙে শালুক ফুলের মালা জড়ানো। উনুনের চারিদিকে আলপনা আঁকা। উনুনের সামনে গোটা কলাপাতায় রান্না করা সবকিছু সাজানো রয়েছে। সামনে ঘটিতে জল রাখা। উনুনের সামনে তার মা, ছোটখুড়ি, খুড়তুতো বোন পিয়ালি ও পারুল বসে। উনুনের সামনে মাটির প্রদীপের আলোয় মিনু পাঁচালি পড়ছে— জয় জয় মনোসা জয় বিষহরি গো/ বন্দনা করি মাগো মনোসা চরণে/ জয় জয় মা মনোসা/ তারপরে বন্দনা করি শিবেরও চরণ…
প্রদীপের আলোয় মিনুর উন্মুক্ত ধবধবে খালি পিঠের পাশ দিয়ে ততোধিক ফর্সা একটি উন্নত পয়োধর দৃশ্যমান। চেষ্টা করেও সে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। মুখে প্রদীপের আলোর ছটা পড়ায় সুন্দরী মিনুর সৌন্দর্যের ছটায় বিমল আবার মোহাবিষ্ট। নজরে পড়ে পারুল তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি বিমল নিজের ঘরে ফিরে আসে। পিয়ালিও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে আসে— দাদা, বউদি, চিঁড়ে, দুধ, কলা রেখে গেছে। খিদে পেলে খেয়ে নিবি। ঘটিতে জল আছে। আর কিছু লাগবে?
বিমল জানে আজ রাতে এই সব খেয়ে থাকতে হবে। না-সূচক মাথা নাড়ে। কাল আজকের রান্না করা পদ জল দেওয়া বাসি-ভাতযোগে খেতে হবে। বই পড়তে থাকে। ঘুম পায় তার। সে খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মিনুর পড়া পাঁচালির সুর ভেসে আসে। সে চোখ বোজে।
মিনুর ডাকে বিমল চোখ খোলে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারে ভোর হয়ে আসছে। মিনু বলে— যাও তো মুখ ধুয়ে এস। চরণামৃত খেতে হবে।
বিমল ফিরলে তার মুখে চরণামৃত দেয় ও পুজোর ফুল তার বুকে ছুঁয়ে চলে যায়। কিছু পরে ফিরে আসে। তার কাছ ঘেঁসে বসে— জানো, আমার মা বিয়ে হয়ে এসে একটা কাঁঠাল গাছ লাগিয়ে ছিলেন। অনেক বছর হয়ে গেল গাছ বেশ বড় হল। কিন্তু কাঁঠাল আর ধরে না। শেষে বাবা ঠিক করলেন কাঁঠাল গাছ কেটে সেখানে অন্য গাছ লাগাবেন।
বিমল ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রেগে যায়— তোমার বাবা যা করেছিলেন, আমি তা করতে পারব না, ব্যস এই আমার শেষ কথা।
মিনু তার হাত ধরে— খালি মাথা গরম। শুনবে তো গল্পটা। গাছ কাটার সিদ্ধান্ত পাকা। অবাক ব্যপার সেই বছর গাছে ফুল এলো ও কাঁঠাল ফলেছিল। গাছটা আজও বেঁচে। সুস্বাদু প্রচুর কাঁঠাল ফলে প্রতি বছর।
বিমল হাসে— আমিও তো তাই বলছি, আমার কাঁঠাল গাছও ফল দেবে।
বিমলের হাত নিয়ে খেলতে থাকে মিন— জানো তো আজকের দিনে মনসা পুজো করে চাঁদ সওদাগর তাঁর সন্তান ও সপ্তডিঙা ফিরে পেয়েছিলেন। গত বছর মানত করেছিলাম। মনস্কামনা পূরণ হলে এবার নিজে ভোগ রান্না করে মা-মনসার পুজো দেব।
বলেই বিছানার নিচ থেকে দুটো খাম বের করে ওর হাতে দেয়। পরশু এসেছে। তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে রেখে দিয়েছিলাম।
বিমল বিস্মিত হয়ে খামদুটো খুলে একে একে পড়তে থাকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে মিনুকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজ়ে সপ্তডিঙা ও সন্তান পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে থাকে।