অর্পিতা ঘোষ পালিত
সারাদিন মালার মন ভালো নেই। রান্না আর অন্য কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। আজ দুর্গা-ষষ্ঠীর দিন সাত সকালে ছেলেটাকে বকেছে। ও কি ইচ্ছে করে বকেছে, ওর মন কে বুঝবে? গলায় আটকে থাকা কান্নার দলা বকুনি হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। পুজোতে বাবলুর জন্য এখনো কিছুই কিনতে পারেনি, হাতে সেরকম পয়সা নেই। মালা তাই অন্যমনস্ক, একটু বেশিই চুপচাপ।
রোজকার মতো মালা সকালে বাসি কাজ সেরে, স্নান করে। তারপর ঠাকুরকে নকুলদানা আর জল দেয়। মালার ঠাকুর বলতে, লক্ষ্মীর ফটো আর ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব, সারদা মা আর বিবেকানন্দ, তিনজনের একটা ফটো। বরুণ আর ওর বিয়ের পর বেলুড় মঠ আর দক্ষিণেশ্বর বেড়াতে গিয়েছিল, তখন বেড়ানোর স্মৃতি হিসেবে ফটোটা কিনে এনেছে। শাশুড়ি-মা ফটোটাকে লক্ষ্মীর পাশে বসিয়ে দিয়েছেন। মালা পুজো শেষ করে শাশুড়ি-মাকে লিকার-চা করে দিয়ে বাবলুকে এক গ্লাস ছাতু গুলে দেয়। তারপর কাজে বেরোবে বলে শাড়ি পরে। ও বাড়ির মাসিমা সেদিন গল্পে গল্পে বলছিলেন, ঘাটকোল পাতা খেতে ভালোবাসেন, অনেকদিন খাননি। কাল শাশুড়ি-মাকে বলেছিল, ঘাটকোল পাতা নিয়ে আসতে। শাশুড়ি-মা এনে সেগুলোকে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রেখেছে। সেখান থেকে অর্ধেকটা নিয়ে ওর ব্যাগের মধ্যে ভরে। বাকি অর্ধেকটা শাশুড়ি-মা রান্না করবে। বাবলু ছাতু খেয়ে চৌকিতে বই নিয়ে পড়তে বসেছে। পড়ার দিকে মন না দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
মালা সেটা লক্ষ্য করে বলে,
—‘পড়া বাদ দিয়ে, আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী দেখছিস?’
সাহস পেয়ে বাবলু বলে— ‘মা, সবাই বন্দুক নিয়ে পটকা ফাটাচ্ছে। আমাকে একটা বন্দুক কিনে দাও-না, আমিও ফাটাবো।’
—‘আমার যেন পয়সার গাছ আছে, ঝাড়া দিলেই ঝুরঝুর করে পড়বে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি, তার ওপর শখ-আহ্লাদ। ওই সব বাদ দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।’
আর কথা না বাড়িয়ে, দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে মালা তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বাইরে পা বাড়ায়। ওদের পাড়ার গলির মুখে ছোট মাঠটায় দুর্গা পুজো হচ্ছে। মন্ডপে কালকেই দুর্গা প্রতিমা চলে এসেছে। এই সাত-সকালেই মাইক বাজছে। এখনও সেরকম ছেলে-পিলে আসেনি। একটু পরেই সবাই জড়ো হবে। বাবলুর বয়সী ছেলেরা খেলনা পিস্তল দিয়ে পটকা ফাটাবে। মালা ভাবে, বাবলু ছোট। ওরও ওদের দেখাদেখি পটকা ফাটাতে ইচ্ছে হয়েছে। ওর কাছে বাবলু সে-রকম কিছু তো আবদার করেনি, সামান্য একটা বন্দুক। সেটাও ও দিতে পারছে না। টানাটানির সংসারে খুশির জন্য শুধু স্বপ্ন দেখা যায়। ছোটো ছোটো খুশিগুলো কেনা যায় না। বাবলু ছোটো, ও কীকরে বুঝবে যে, সহায়-সম্বলহীন মায়ের একমাত্র সম্পদ, অবলম্বন ও। ওকে নিয়েই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে মালা।
গরিবের মেয়ে মালা। ওর বাবা রিকশা চালায়, সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে বাড়ি ঢুকে দুটো ভাত খেয়ে আবার রিকশা নিয়ে বের হয়। গরিব হলেও ওদের সংসারে সুখের কমতি ছিল না। মালারা দুই বোন। ও বড় হওয়াতে একটু বেলার দিকে রোজ বাজারে যেতো। বেলা হলে জিনিসের দাম একটু কম হবে ভেবে। বরুণ বাজারে সবজি বিক্রি করতো। ভাঙা বাজারে যেটুকু পড়ে আছে, সেগুলো কম দামে বেচে দিতো। কেননা সবজির কেনা দাম উঠে এসেছে, যা পড়ে আছে সেটুকু সবই লাভের।
মালা বাজারে গিয়ে, রোজ বরুণের কাছ থেকে সবজি কিনতে কিনতে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার পথে দু’জনে গল্প করতে করতে হাঁটে। কিছুটা যাবার পর দু’মাথার মোড়, সেখান থেকে দু’জনে দু’দিকে বাড়ির পথে যায়। বরুণের সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। তারপর দু-বাড়ির মতে ছোট করে অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয় দু’জনের। স্বামী শাশুড়িকে নিয়ে সুখেই সংসার করতো মালা। দেশে করোনা এলে ওর বাড়ির সবাই আক্রান্ত হয়। মালা এবং ওর শাশুড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেও, শাশুড়ির হার্টের প্রবলেম দেখা দেয়। বরুণের বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ায় ও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি ওকে। বরুণ মারা যাওয়াতে দিশেহারা হয়ে যায় মালা। কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না। কতদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তারপর ক্লাবের ছেলেরা বেশ কিছুদিন খাবার দিয়েছিল। অনেকে চাল ডাল প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়েছিল। সেভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তখন বিভিন্ন ধরনের কাজ করে, ঠোঙা বানিয়ে দোকানে দোকানে দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতো মালা। একজনের পরামর্শে কাজের মেয়ে দেওয়া হয় যে সেন্টার থেকে, সেই সেন্টারে নাম, ঠিকানা, ফটো জমা দিয়ে আসে।
মিনতি দেবীর বাড়িতে গত একবছর ধরে কাজ করছে মালা। দোতলা এই বাড়িতে মিনতি দেবী একাই থাকেন। আগে চাকরি করতেন, এখন অবসর নিয়েছেন। মালা শুনেছে, ওঁর স্বামী নাকি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। ওঁর একমাত্র ছেলে এবং বউমা ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে। এখানে আগে যে কাজ করতো সে নাকি চুরি করতো, তাই তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন মিনতি দেবী। গত বছর পুজোর সময় মাসিমার ছেলে আর বউমা এসেছিল। সেই সময় কাজের মেয়ে পাওয়া যায় যে সেন্টার থেকে, সেখান থেকে ওরা মায়ের কাজের জন্য মালাকে নিয়ে আসে।
এমনিতে মিনতি দেবীর বাড়িতে মালার সে-রকম কাজ নেই। সকাল আটটায় কাজে আসে, আবার রাত আটটায় নিজের বাড়ি ফিরে যায়। মিনতি দেবীকে মালা ‘মাসিমা’ বলে ডাকে। রান্না, বাড়ির সব কাজ, আর মাসিমার দেখাশোনা করা, সামান্য কাজ মালার। সে তো বাড়িতে থাকলেও করতে হতো। নিজের খাওয়াটাও এখানেই হয়ে যায় মালার। এই কাজের জন্য মাসে দশ হাজার টাকা পায়। কিন্তু পেলে কী হবে, প্রত্যেক মাসে শাশুড়ি-মায়ের ওষুধের পেছনে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যায়। এছাড়া বাবলু এখন ক্লাস ফোরে পড়ে, ওর প্রাইভেট টিচার, ঘরের খরচ তো আছেই। তাই মাস গেলে হাতে আর কিছুই থাকে না।
দুপুরে মিনতি দেবীর জন্য ডাইনিং টেবিলে ভাত বেড়ে, ওঁকে খেতে ডাকলো মালা। টেবিলে বসে মিনতি দেবী দেখলেন, সোনা মুগের ডাল, ঝিঙে পোস্ত, আলু-পটল ভাজা, চাটনি আর একটা কালচে সবুজ রঙের কী একটা।
মিনতি দেবী সেটা দেখিয়ে বললেন— ‘এটা কী রান্না করেছিস মালা।’ মালাকে উনি তুই করেই ডাকেন।
মালা— ‘খেয়ে দেখুন মাসিমা, কেমন হয়েছে। তারপর বলবেন।’
মিনতি দেবী ভাত মেখে এক গ্রাস মুখে দিলেন। দু’চোখ খুশিতে ভরে উঠলো। বললেন— ‘দারুণ হয়েছে! কতদিন পরে খেলাম। সেদিন তোকে বলেছিলাম, ঘাটকোল পাতা খেতে ভালোবাসি। অনেকদিন খাওয়া হয়নি। তোর ঠিক মনে আছে দেখছি।’
মালা— ‘আপনি ভালোবাসেন, আর সেটা রান্না করে দেবো না, তাই কখনও হয়।’
মিনতি দেবী সকাল থেকেই লক্ষ্য করছেন, পুজো-কালের দিনে মেয়েটা কেমন দুঃখ-দুঃখ মুখ করে আছে। মুখে হাসি নেই। তা সত্ত্বেও কোথা থেকে জোগাড় করে ঘাটকোল পাতা এনে, যত্ন করে পাতা রান্না করেছে। উনি ভালোবাসেন বলে। অন্যদিন মালা কাজের ফাঁকে নানান কথা বলে। আজ কী হলো ওর? ভাবলেন… মেয়েটার খুব বেশি বয়স না, কতো আর হবে ৩০/৩২ বছর। এক বছর ধরে তো মেয়েটাকে দেখছেন। বর্তমান যুগের মেয়েদের মতো মালা না। এরই মধ্যে অনেক দুঃখ কষ্ট ওকে সহ্য করতে হয়েছে। নিজে ছাড়াও একটা ছেলে আর শাশুড়ির সবদিক ওকেই সামলাতে হয়। মালাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘আজ কি তোর কিছু হয়েছে? দরকার ছাড়া কথা বলছিস না, কেমন যেন চুপচাপ আছিস।’
মালা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না, সকালের ঘটনা উগরে দিলো মাসিমার কাছে। সব শুনে মাসিমা চুপ করে থাকলেন। তিনি মালার জীবনের সব কথা ওর মুখ থেকে আগেই শুনেছেন। দুঃখী মেয়েটাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন ভেবে উঠতে পারলেন না।…
বিকেল পাঁচটা বাজলেই মিনতি দেবীর চা চায়। মালা চা আর বিস্কুট এনে দেয় মিনতি দেবীকে।
মিনতি দেবী চা খেতে বসে বলেন— ‘মালা শাড়ি পরে নে, আজ আর আটটা পর্যন্ত থাকতে হবে না তোকে।’ মালার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন— ‘এই টাকাটা ধর, এটা দিয়ে তোর ছেলে বাবলুকে পুজোয় জামা, জুতো আর পটকা কিনে দিবি, আর তুইও একটা শাড়ি কিনবি।’
মালা— ‘এখনো তো মাস শেষ হয়নি মাসিমা! এখনই টাকা দিচ্ছেন?’
—‘এটা তোর কাজের মাইনে না। পুজো উপলক্ষে তোকে কেনাকাটা করার জন্য দিলাম।’
—‘কিন্তু এখানে তো অনেক টাকা আছে মনে হচ্ছে…
—‘তুই আমার বাড়িতে কাজ করিস বলে কিন্তু টাকাটা দিলাম না। আমাকে মাসিমা বলে ডাকিস। মায়ের মতো যত্ন করিস। আমি যেসব খাবার খেতে ভালোবাসি। তুই খুঁজে সেগুলো নিয়ে এসে রান্না করে খাওয়াস। আমাকে ভালোবাসিস বলেই তো তুই এগুলো করিস। যারা শুধু কাজের জন্য থাকে, তারা দায়সারা ভাবে কাজ সারে মাস গেলে টাকা পাবে বলে। তুই সে-রকম না, মনে হয় যেন তুইও এ বাড়ির একজন সদস্য। সংসারের ভালো মন্দ সব কিছুই দেখিস। মাস গেলে মাইনে নিস ঠিকই। কিন্তু টাকা না নিলে তোর সংসার চলবে কীকরে।’
মালার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। কাঁদো- কাঁদো স্বরে বললো— ‘আপনিও তো আমাকে ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন। যে আমাকে ভালোবাসে তার জন্য একটু কিছু করলে খুব আনন্দ পাই। আপনি যেগুলো খেতে ভালোবাসেন সেগুলো রান্না করতে খুব ভালো লাগে। এছাড়া তো আমি আপনাকে কিছু দিতে পারবো না।’
—‘তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি গিয়ে বাবলুকে নিয়ে দোকানে যা। আর একটা কথা তোকে বলছি, বাবলুর ভবিষ্যৎ চিন্তা তোকে করতে হবে না। এখন থেকে ওর সমস্ত পড়ার খরচ আমি দেবো। ওকে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, বড় হতে হবে।’
—‘আমি অপয়া, পাপী মানুষ। তবু গত জন্মে নিশ্চয় কিছু পুণ্য করেছিলাম। সেজন্য আজ দুর্গা ষষ্ঠীর দিন মা দুর্গা, আপনার রূপে এসে আশীর্বাদের হাত রাখলেন আমার মাথায়।’
—‘আমি সাধারণ মানুষ, কোনও দেবতা না।’
—‘দেবতা, মানুষের কল্যাণের জন্য মানুষ রূপে জন্ম নেয়। যেমন— ঠাকুর রামকৃষ্ণ আর সারদা মা। ওঁরা দু’জনেই দেবতা।’
দু’হাত জোর করে ঠাকুর আর মার উদ্দেশে প্রণাম করে মিনতি দেবী বললেন— ‘বোকা মেয়ে, ওসব কথা বলতে নেই। ওঁরা সত্যিই মহাপুরুষ, দেব-দেবী। আমি এক নগণ্য মহিলা।’
—‘আমি মূর্খ, তবু জানি ঠাকুর রামকৃষ্ণ মহাপুরুষ আর মা সারদা দেবী জগদ্ধাত্রী। আমিও ওঁদের ভক্তি শ্রদ্ধা করি। আমার মনে হচ্ছে, আমার দুঃখ কষ্ট দেখে মা সারদা থাকতে পারেননি। উনি তো নিজের রূপে আসতে পারবেন না, তাই আপনার মধ্যে দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন।’
এরপর মালা মিনতি দেবীকে প্রণাম করে হাসি মুখে বাড়ির পথে এগোলো। বাড়ি ফিরে বাবলুকে নিয়ে দোকানে যেতে হবে। বাবলুর হাসি মুখটা ওর চোখের সামনে ভাসছে।
মালার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে মিনতি দেবী ভাবলেন, গরিবের মেয়ে বলে মালা বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেনি। তবুও আজ একটা খুব ভালো কথা বলেছে। রিটায়ার করার পর ওঁর ব্যাংকে টাকা আছে, মাসে মাসে পেনশন পাচ্ছেন। এছাড়া ছেলেও দিচ্ছে। তবু, মালাকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগে কোনোদিন কিছু ভাবেননি। এমনকি ওঁর ছেলের ব্যাপারে তো কোনোদিন কিছু ভাবেনইনি। ঠাকুর মা-ই হয়তো ওঁকে দিয়ে এই পুণ্যের কাজ করিয়ে নিয়েছেন। দু’হাত জোড় করে আর একবার ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব আর সারদা মায়ের উদ্দেশে প্রণাম করলেন মিনতি দেবী।