অয়ন চৌধুরী
শহরটির নাম রচেস্টার। নিউ ইয়র্কের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই শহরটির সবুজ গালিচায় ঘেরা চরাচর, আর তার বুক চিরে চলে যাওয়া নির্জন কালো রাস্তাগুলি অনির্বাণের মনের উপর এমনভাবে আছড়ে পড়েছে যে, তার ভিতর যে অনুভূতিটা এখন হচ্ছে তার ঠিক কী নাম হতে পারে সে জানে না। তবু গাড়িটা যখন এসে থামল ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির গেটে, তার মনটা শুধু বিস্মিতই হল না, একবার মনে পড়ল তার পদ্মাপাড়ের গ্রামের কথা। সেই গ্রাম থেকে এই মার্কিন মুলুকে ইউনিভার্সিটি অফ রচেস্টার পর্যন্ত যে দীর্ঘ যাত্রাপথ সেই পথরেখা টেনে দিয়েছে তার সাহিত্যচর্চা।
Advertisement
আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গবেষক ও পণ্ডিতরা আসবেন। এবারে এই কনফারেন্সে অনির্বাণও ডাক পেয়েছে। সে বলবে তার গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার কথা। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে ভারী দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই ডেস্কে বসে থাকা একজন ছাত্রী উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে তুলল। সেই ছাত্রীর সঙ্গে কথাবার্তায় অনির্বাণ জানতে পারল এখানে ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো না কোনো দায়িত্বে যুক্ত থাকে, বিনিময়ে তারা কিছু পারিশ্রমিক পায়। তাদের পড়াশোনার খরচ তাতে কিছুটা হলেও মেটে। সেই ছাত্রীই অনির্বাণকে বুঝিয়ে দিল কোথায় তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এবং সেই ঘরের চাবি অনির্বাণের হাতে দিয়ে ছাত্রীটি তাকে অভিবাদন জানাল।
Advertisement
কনফারেন্সের উদ্যোক্তারা আগেই ইমেলে জানিয়ে দিয়েছিল যে, একটি ঘরে দু’জনের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। দুটি আলাদা বিছানা থাকবে। বিষয়টিকে অনির্বাণ বেশ আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিল এই কারণে যে, এতে বিশ্বের অন্য প্রান্তের একজন গবেষকের সঙ্গে কথাবার্তা হওয়ার বাড়তি সুযোগ পাওয়া যাবে। চাবি খুলে ঘরে ঢুকে অনির্বাণ দেখল এখনও তার রুমমেট এসে পৌঁছয়নি। হয়তো রাতে আসবে অথবা কাল সকালে।
বেশ বড় ঘর। পরিপাটি ব্যবস্থা। বড় একটি জানলা। পর্দা সরাতেই মন ভালো হয়ে গেল ওর— জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীখ্যাত ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির চূড়া। উপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের চলাচল। একটি বিমান খুব কাছ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে সাদা মেঘের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বিমানবন্দর খুব কাছে বলে এত নীচ দিয়ে গেল বিমানটি যে, বেশ বড় দেখালো। মনে হল যেন লাইব্রেরির চূড়ায় আর একটু হলেই ধাক্কা খেত।
বিমানের শব্দটা অনির্বাণের কানে বর্ষাকালের পদ্মার ফুঁসে ওঠা জলরাশির গর্জনের মতো শোনালো। জানলা দিয়ে লাইব্রেরির চূড়াটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনির্বাণ। কত কিছু যে ওর মনে পড়ল! মনে মনে দুই অধ্যাপককে সে ধন্যবাদ জানাল, যাঁদের উৎসাহ ছাড়া এই দিনটির স্বপ্ন সে হয়তো কখনোই দেখতে পারত না। আর মনে পড়ল হিয়ার কথা, যে সবচেয়ে কঠিন সময়েও তার হাত ছাড়েনি। সাহস জুগিয়েছে যে-কোনো পরিস্থিতিতেই। এই ভাবনার ঘোর কাটতেই সে ঠিক করল, কোন বিছানাটি সে নেবে। স্নান সেরে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার।
২
ঘুম ভাঙতেই অনির্বাণ দেখল ঘরের চেয়ারে বসে বই পড়ছে এক সুদর্শন যুবক। অনির্বাণ বুঝল এই তার রুমমেট। তারা একে অপরকে অভিবাদন জানাল। জানা গেল, তার নাম মিখাইলো। বয়স তিরিশের ঘরে, মানে প্রায় অনির্বাণের সমবয়সী। সে এসেছে ইউক্রেন থেকে। ইউক্রেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বাইবেলের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে। প্রথম সাক্ষাতেই ওর মনে হল মিখাইলো বড় মিশুকে একজন মানুষ। তার চওড়া হাসিখানা তার দিলখোলা স্বভাবটিকে যেন আরও খানিক প্রস্ফুটিত করে তুলল।
বিছানা ছেড়ে অনির্বাণ ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে গেল। ফিরে এসে দেখল মিখাইলো দু’কাপ কফি বানিয়েছে। একটি কাপ এগিয়ে দিল অনির্বাণের দিকে। সেই শুরু হল সখ্যতা। এরপর কথায় কথায় একে অপরের সম্পর্কে অনেকটাই জানা হয়ে গেল। মিখাইলো বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছে। ওর স্ত্রী অ্যালিস একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। ওদের এক মেয়ে। বয়স এক বছর। মিখাইলো ফোনের গ্যালারি থেকে ছবি বের করে অ্যালিস ও তাদের ছোট্ট মেয়েটির ছবি দেখালো। দেখালো অ্যালিসের আঁকা ছবি। অনির্বাণও বলল তার গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, পদ্মাপাড়ের গল্প। মিখাইলো শুনে রোমাঞ্চিত হল যে, পদ্মার এপারে দাঁড়িয়ে ওপারে বাংলাদেশ দেখা যায়। এইসব গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে গেল। দরজায় কলিং বেল বাজল। কিম উইলকিনসন, এই কনফারেন্সের অন্যতম উদ্যোক্তা, দেখা করতে এসেছেন গেস্টদের সঙ্গে। তাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চেয়ে কিছু বাক্যালাপ করে চলে গেলেন উইলকিনসন। ঘড়িতে তখন সন্ধে সাড়ে আটটা অথচ ঝলমলে রোদ। ঠিক হল ক্যাম্পাসটা একটু ঘুরে দেখা যাক। অনির্বাণ ও মিখাইলো দু’জনেই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
এখন রোদটা একটু পড়ে এসেছে। সবুজ ঘাসের গালিচায় গোটা ক্যাম্পাসটি ঢাকা। মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। আর রাস্তার পাশে পাশে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব সুন্দর সব বিল্ডিং। এগুলিই সম্ভবত বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট। হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা হল দু’জনের। বিশ্বের ইতিহাসের কত তথ্য যে মিখাইলোর নখদর্পণে, তা জেনে অনির্বাণ খানিক বিস্মিত হল। এমন আত্মপ্রতিভ যুবক সে খুব কম দেখেছে। তার আত্মবিশ্বাস দেখে ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারল না অনির্বাণ। মিখাইলো জানিয়েছে, ও পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছে। মিশেছে অনেক মানুষের সঙ্গে, বিভিন্ন দেশের গবেষক ও পণ্ডিতদের সঙ্গে। কিন্তু মানুষ হিসেবে অনির্বাণের মধ্যে একটা সততার পরিচয় পেয়েছে ও। আর এই সহজ সত্যটুকুই ওকে অনির্বাণের সঙ্গে মিশতে সাহায্য করেছে।
অনেকটা হেঁটেছে ওরা। সামনেই একটা বেঞ্চ দেখা যাচ্ছে। সেখানেই একটু জিরিয়ে নেবে বলে বসে পড়ল ওরা। ওখানে বসেই ওরা দু’জনে দু’জনের সঙ্গে ফোননম্বর আদানপ্রদান করে নিল। একে অপরকে কানেক্ট করল সোশ্যাল মিডিয়ায়। আগামীকাল কনফারেন্সের প্রথম দিন। আগামীকাল অনির্বাণের প্রেজেন্টেশন। সেই নিয়ে বেশ কিছুটা কথা হল। যদিও অনির্বাণ সবকিছু খোলাখুলি জানাতে চায়নি একদিনের আলাপে। কত গবেষণার কত ধারণাই তো রোজ চুরি হয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের এসব ভয় নিয়েই মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। মিখাইলোর উৎসাহ জেগেছে এই বিষয়টি নিয়ে, নাকি স্রেফ সৌজন্য তা অনির্বাণ বুঝল না, কিন্তু সে বলল, সে চেষ্টা করবে অন্য কাজ সেরে অনির্বাণের প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত থাকতে।
এই দেশে রাত্রি দশটায় কেউ খাবার খায় না। সাড়ে সাতটার মধ্যে খাবারের সব দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার বেশ খিদে পাচ্ছে অনির্বাণের। প্যাভলভের পরীক্ষায় এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল। অভ্যাসমতো ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ পেটের ভিতর চিনচিন করে উঠল অনির্বাণের। সে কথা জানাল মিখাইলোকে, মিখাইলো একটা মৃদু হাসি হেসে বলল, ‘বাট ইউ উইল নট গেট ফুড নাও। আই হ্যাভ সাম প্রোটিন বারস উইথ মি।’ অনির্বাণ জানাল, সে আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য, এই যেমন এখন, কিছু ম্যাগির প্যাকেট এনেছে।
সেগুলোই ঘরে ফিরে বানিয়ে নেবে। তারপর দু’জনেই খুব হাসল। সেই হাসির রোলে একটা নতুন বন্ধুত্বের যেন ধীরে ধীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সাক্ষী থাকছে সদ্য জ্বলে ওঠা হলুদ বাতিগুলি আর প্রায় নিঃস্তব্ধ ইট-কাঠ-পাথরে তৈরি উঁচু-উঁচু সব অট্টালিকা। এবার উঠে পড়া দরকার। হাঁটতে হাঁটতে ওরা মিলিয়ে গেল সবুজের অন্ধকারে যেখানে হলুদ বাতিগুলি খানিক ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
৩
অনির্বাণের প্রেজেন্টেশনের পর সকলেই অনির্বাণকে অভিবাদন জানাচ্ছে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সকলের সামনে আনার জন্য। অনির্বাণও সকলকে ধন্যবাদজ্ঞাপন করছে। দারুণ একটা আলোচনা হল। শ্রোতারা তো ছিলেনই, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন পণ্ডিতও এই আলোচনা শুনতে এসেছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন, অনির্বাণও দারুণ উত্তর দিয়েছে। সবশেষে মিখাইলো এসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘প্রাউড অফ ইউ, মাই ফ্রেন্ড।’ সত্যি বলতে অনির্বাণ আশা করেনি মিখাইলো এই আলোচনা শুনতে আসবে। কিন্তু যখন অনির্বাণের প্রেজেন্টেশন শুরু হওয়ার মুহূর্তে প্রায় দৌড়ে এসে ঢুকল মিখাইলো এবং ঢুকতে ঢুকতেই খুব নীচু গলায় বলল, ‘বেস্ট অফ লাক’ তখন মনটা ভালো হয়ে গেল অনির্বাণের। এখন অনির্বাণ যেন মধ্যমণি। সকলে তার সঙ্গে এসে করমর্দন করছে, কথা বলছে। কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে উত্তর দিচ্ছে অনির্বাণ। এখন বাইরে টি-ব্রেক চলছে। হল থেকে বেরিয়ে সেদিকেই গেল অনির্বাণরা।
একটা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মিখাইলো বলল, আজ এত ভালো প্রেজেন্টেশনের জন্য সন্ধেবেলা তারা কোনো রেস্তোরাঁয় যাবে, আর সেটা স্পনসর করতে হবে অনির্বাণকেই। কনফারেন্স মানে তো আর শুধু গবেষণা, প্রেজেন্টেশন নয়, শহরটাও ঘুরে দেখা দরকার। সেখানকার মানুষজন, তাদের সংস্কৃতি, জীবন সবকিছুর সঙ্গে মিশে যাওয়া দরকার। আর মিখাইলোর মতো একজন সঙ্গী পেলে সেই অন্বেষণ আরও প্রাণ পাবে। এমনিতেও অনির্বাণের মন এখন ফুরফুরে। এতদূর আসা যেন সার্থক হল, এমন সফল একটা প্রেজেন্টেশনে। ফলে সে রাজি হয়ে গেল।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাইরে এসে তারা একটি বাসে উঠে পড়ল। অনির্বাণ দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল শহরটা। মিখাইলোকে দেখে মনে হল তার চোখ যেন এরকম দৃশ্যে অভ্যস্ত। অনির্বাণ খুব বেশি না ভেবে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল।
এই শহরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে ওরা এসে বসল একটি রেস্তোরাঁয়। এরপর সময় কোথা দিয়ে যে বয়ে গেল ওরা কেউই টের পেল না। এ-কথা সে-কথায় ওদের জীবনের নানা গল্পে মুখরিত হয়ে রইল সেই সন্ধ্যা। অন্য একটি দেশের রেস্তোরাঁয় বসে একজন ভিনদেশি বন্ধুর সঙ্গে এরকম একটি সন্ধে কাটাচ্ছে ভাবলে একটা আশ্চর্য রোমাঞ্চ হচ্ছে অনির্বাণের। তবু ওর মনে হল এটা জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলির মধ্যে একটি। যে গা থেকে আজও পদ্মাপাড়ের সাদা বালির চিহ্ন মুছে যায়নি সেই গায়ে আজ মার্কিন মুলুকের শুষ্ক হাওয়া এসে লাগছে। এ যেন এখনও বিস্ময়! টাকা মিটিয়ে যখন ওরা রেস্তোরাঁ থেকে বেরলো তখন রাত্রি সাড়ে এগারোটা বাজে।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে ওরা বেশ কিছুটা দূরে আছে এখন। গুগল ম্যাপে দেখল অনির্বাণ। ততক্ষণে মিখাইলো একটি গাড়ি বুক করে ফেলেছে। মিনিট সাতেকের মধ্যেই এসে পড়বে। ওরা যখন ওদের ঘরে ঢুকছে তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। এরপর আরও কতক্ষণ যে ওদের গল্প চলল, কে আগে ঘুমিয়ে পড়ল সেসব আর কেউই মনে করতে পারেনি।
৪
আজ কনফারেন্সের তৃতীয় দিন, আজই শেষ হচ্ছে কনফারেন্স। অনির্বাণ রেডি হয়ে নিল। আজ মিখাইলোর প্রেজেন্টেশন। মিখাইলো আগেই বেরিয়েছে। প্রেজেন্টেশনের আগে ও লাইব্রেরিতে বসে একটু দেখে নিতে চায় প্রস্তুতি। গত দু’দিন ওরা প্রচুর ঘুরেছে। আনন্দে-মজায় কীভাবে যে দুটো দিন কেটে গেল অনির্বাণ বুঝতেই পারেনি। তবু এরই মধ্য যতটা কথা হয়েছে ওর গবেষণার বিষয়ে, তাতে অনির্বাণ এটুকু বুঝেছে যে, ওই বিষয়ে মিখাইলোর অসাধারণ দখল রয়েছে। এতটাই মনোমুগ্ধকরভাবে ও প্রকাশ করতে পেরেছে যে, অনির্বাণেরও ওই বিষয়ে উৎসাহ জেগেছে। সঙ্গে ওর অসম্ভব আত্মবিশ্বাস তো আছেই। কাজেই ওর প্রেজেন্টেশন নিয়ে অনির্বাণও খানিক আত্মবিশ্বাসীই বটে।
কনফারেন্স হলে পৌঁছে দেখা হল মিখাইলোর সঙ্গে। কেমন যেন একটু এলোমেলো দেখালো ওকে। স্টেজ-ফিয়ার? কী জানি, হতেও পারে। লোকের সঙ্গে কথা বলা আর স্টেজ থেকে কথা বলার মধ্যে যে আকাশপাতাল তফাৎ রয়েছে তা অনির্বাণের থেকে ভালো কেই বা জানবে। কারণ ওকে বিভিন্ন সাহিত্য-সভায় যেতে হয়, কখনও কখনও কথা-সমন্বয় বা সঞ্চালনার দায়িত্বও সামলাতে হয়। তবু বিষয়টিকে গৌণ ভেবে শেষ লাইনের একটি চেয়ারে বসল অনির্বাণ।
শুরু হল প্রেজেন্টেশন। তৃতীয় প্রেজেন্টার হিসেবে মিখাইলো যখন তার কথা শুরু করল তখন ও অনেকটাই ভেঙে গেছে ভিতর থেকে। কী হল মিখাইলোর! ওর কথা আটকে যাচ্ছে। গলা বুজে আসছে। যেন সে তার গবেষণার সমস্ত তথ্য ভুলে গেছে। একবার সে কাগজ দেখছে, কিছু বলার চেষ্টা করছে, আটকে যাচ্ছে। যেন কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছে না কী বলবে, কী করবে। অবাক লাগল অনির্বাণের। এ কী বিপর্যয়! সকাল পর্যন্ত তো এর কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।
কোনোরকমে তার কথা শেষ করে প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য অপেক্ষা না করেই, ‘এক্সকিউজ মি, আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল, আই হ্যাভ টু লিভ’ বলে সে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। অনির্বাণ অবাক হয়ে গেল এই কাণ্ড দেখে। ভিড় ঠেলে সে পিছু নিল মিখাইলোর। খুঁজতে খুঁজতে তাকে দেখতে পেল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির সামনে যে নির্জন খোলা মাঠটি আছে তারই এক কোণে একটি বেঞ্চিতে বসে থাকতে। অনির্বাণ বেশ কিছুটা দ্বিধা নিয়েই পিছনে এসে দাঁড়াল। বুঝতে পারল মিখাইলো চোখ মুছছে। হাতে ধরা মোবাইল ফোনটিতে একটি ভিডিও চলছে। তাতে দেখা যাচ্ছে অ্যালিসের উদ্বিগ্ন মুখ। তাদের ছোট্ট মেয়েটি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে চারপাশের ছোটাছুটিতে। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে তারা কোনো ফ্ল্যাটবাড়ির বেসমেন্টে লুকিয়ে আছে। চারিদিকে যুদ্ধ সাইরেন বাজছে। গোলাবর্ষণের আওয়াজ। অনির্বাণের কিছু বলার মতো সাহস হল না। খুব সন্তর্পণে সে সরে গিয়ে বসল ওর থেকে দূরের একটি বেঞ্চিতে। অনির্বাণের মনে পড়ল ও লক্ষ্য করেছে বিমানের শব্দে মিখাইলো দু’বার ঘুম থেকে চমকে উঠেছে। তখন ভেবেছিল হয়তো স্বপ্ন দেখেছে কিন্তু আজ বুঝতে পারছে স্বপ্ন নয়, ভয় পেয়েছিল মিখাইলো।
এই দৃশ্য দেখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল অনির্বাণের মন। ওর মনে পড়ল হিয়ার কথা। মনটা আরও উদাস হয়ে গেল। মনে হল হিয়াকে একবার সে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। পরক্ষণেই মনে হল এই বিপর্যয়ের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী, এই সভ্যতা দায়ী। এর আগে পদ্মাপাড়ের মানুষগুলির ঘর ভেসে যাওয়ার সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে মানুষের অসহায়তা ও বারবার দেখেছে। কিন্তু এই প্রথম মানুষের নিজের তৈরি করা বিপর্যয়ের সামনে মানুষকে এত অসহায় হয়ে যেতে দেখল ও। এক আশ্চর্য নির্জনতা চারিদিকে। শিরশির করে হাওয়া বইছে আজ। যেন এক বিষণ্ণ সাইরেন বাজছে কোথাও।
Advertisement



