নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়
সেই সাতটি ভাইয়ের গল্পেই ফিরে আসি আরও একবার, আর সেই যে তাদের ছোট্ট বোনটি। পৃথিবীর সব দেশে, সমস্ত সংসারের গল্পগুলোই একই রকম যে! হ্যাঁ, এই গল্পের শুরুতেও সুখেই ছিল তারা। অশান্তি আরম্ভ হল ভাইদের বিয়ের পর।
বউয়েরা খুব হিংসে করতো ভাইদের আদরের বোনটিকে। অনবরত বিষ ঢালত স্বামীদের কানে, ননদ না কি কাজকম্ম কিচ্ছু পারে না, খালি সাজগোজের দিকে নজর। ভাইগুলো বোকা বলেই বিশ্বাস করতো সে কথা, সংসারের ভেতরের খুঁটিনাটি আগে তো তারা দেখেনি!
সাত ভাই একদিন জঙ্গলে গেল শিকার করতে। তখন সন্ধে হয়ে আসছে, শিকার বেশি মেলেনি, এদিকে তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। উঁচু একটা গাছে উঠে এক ভাই অল্প দূরে একটা জলাশয় দেখতে পেল। সবাই মিলে সেখানে দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে, আশ্চর্য, জলাশয় যে আরও দূরে সরে যাচ্ছে! গভীর জলের আড়াল থেকে শোনা গেল কণ্ঠস্বর, এই জল তোমরা পাবে তখনই, যখন বলি দেবে একজন মানুষকে। শপথ করো, বলি এনে দেবে কয়েকদিনের মধ্যেই!
প্রাণের দায়ে শপথ করলো সাত ভাই— তেষ্টা মেটাল। এইবার বলি দেওয়া যায় কাকে? কেন, হাতের কাছেই যে আছে ছোট বোন, বউদের ননদ, দু’চোখের বিষ! ছোট দুই ভাই কিন্তু তখনও ওদের বোনকে আগের মতনই ভালোবাসে, আপত্তি জানালো তারা। ভেবেচিন্তে বড় পাঁচজনও মেনে নিল ওদের কথা। কীই-বা আসে যায়, জঙ্গলে তো আর শিগগির ওরা যাচ্ছে না।
কয়েকদিন বাদেই খুব অসুখে পড়লো বড় ভাই। কেউ বুঝে পায় না, সারবে কীভাবে। ওঝা ডাকা হল, অনেক দেখেশুনে তিনি বললেন, অপদেবতার ভর হয়েছে। কেউ নিশ্চয়ই কথা দিয়ে কথা রাখেনি, তাই তিনি রুষ্ট; কথা রাখলে তবেই অসুখ সারবে। ভয় পেয়ে, সঙ্গে সঙ্গে বোনকে বলি দেবার ব্যাপারে সায় দেয় ছোট ভাই। অপদেবতাকে মনে মনে বলে, এবারের মতন দাদাকে সারিয়ে দাও, তারপরই জঙ্গলে গিয়ে বলির ব্যবস্থা হবে! দাদা সেরে উঠলেন দুদিন বাদেই।
আবার সবাই শিকার খুঁজতে গেল সেই জঙ্গলে। বউদের বলে গেল, বোনের হাত দিয়ে ওদের খাবার যেন পৌঁছে দেয় দুপুরবেলা। বোন তো আর আসল কারণ জানে না! খাবার পরে, কলসি ভরে জল আনতে দাদারা যখন দীঘিতে পাঠাল ওকে, তখনও কিছু বোঝেনি। জলে কলসি ডুবিয়ে দেখে, কিছুতেই জল ঢুকছে না। হাঁটুজলে নামলো, তারপর কোমর অবধি, তবু কলসি ডুবছে না। এইভাবে নেমে যেতে যেতে যখন তার গলা অবধি জল, তখন দীঘির মাঝখান থেকে অপদেবতা দীর্ঘ হাত বাড়িয়ে ওকে গভীর জলে টেনে নিলেন।
দাদারা বাঁচল, বউদেরও হাড়ে বাতাস লাগলো। ওদের পথের কাঁটা দূর হয়েছে। বউদের হাসিমুখ দেখে দাদারাও খুশি। কেউ মনেও রাখল না কী সুন্দর এক ছোট্ট বোন ছিল ওদের, ছোটবেলার কতো খেলার সাথি।
দীঘির ধারে তরতর করে কদিন বাদেই বেড়ে উঠলো এক বাঁশ গাছ। ওখানে কাঠ কাটতে এসে এক কাঠুরিয়া খুব খুশি। কুড়ুলের কোপ মারতে গিয়েই শুনল, মানুষ মেয়ের গলায় কে যেন বলে উঠলো, মেরো না, ওপরে কোপ মেরো না! পারো তো গোড়ায় কোপ মেরে উঠিয়ে নিয়ে যাও! অবাক কাঠুরিয়া, নির্দেশ মেনে শেকড়সুদ্ধুই গাছটাকে নিয়ে চলল। বাড়িতে ধৈর্য ধরে কেটেকুটে বানাল একটা বাঁশের বাঁশি। যত্ন করে সুর তুলল তাতে।
কাঠুরিয়া সুর তুলতে জানে, যে শোনে, সে-ই মুগ্ধ হয়। অনেক ব্যথার মধ্যেও সেই সুর, কী যে মধুর! ওই বাঁশি তার সারাদিনের সঙ্গী। মাথার পাশে রেখে ঘুমোয় রাত্তিরে। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে কাঠুরিয়া ছেলে দেখে, ডানাকাটা পরীর মতন ফুটফুটে একটি মেয়ে, তার শিয়রে বসে আছে। অরণ্যের ছায়া মাখা মায়ায় জড়ানো তার চোখের দৃষ্টি, বিস্ময়ের চেয়েও বেশি সেই চোখে রয়েছে বেদনা মাখা স্নিগ্ধতা। কাঠুরিয়া ছেলের অবাক প্রশ্ন, তুমি কে?
সেদিন কোনও উত্তর দেয়নি সেই মেয়ে। তারপর থেকে প্রতি রাতেই সে তার নতুন বন্ধু কাঠুরিয়া ছেলের কাছে এসেছে, গল্প করেছে, গান শুনিয়েছে— আবার কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে ভোরের আলো ফোটার আগেই। পাশে পড়ে থেকেছে শুধু বাঁশিটা। কাঠুরিয়া একদিন জোর করে তার হাত ধরে রইলো। যাবে না! যেতে দেব না! এদিকে বাইরে ভোর হয়ে এলো। মেয়েটি আর কোথায় পালাবে?
সেই থেকে এই আজ পর্যন্ত, খুব আনন্দে দিন কেটে চলেছে ওদের। সুখে সংসার করছে। অবসর সময় ভরিয়ে তুলছে গান আর বাঁশির সুরে।