শতদল মিত্র
অরুণ, অরুণ দত্ত বলতে গেলে বড়লোকের বস্তিতেই থাকে। বড়লোকের বস্তিই। কেননা এখানে লোকেরা গলগল করে খায় আর কি ভোর, কি রাত— কী শীত, কী গ্রীষ্ম ট্র্যাকস্যুট আর গেঞ্জি খিঁচে থলথলে পাছা আর নেয়াপাতি ভুঁড়ি দুলিয়ে হনহন করে হাঁটে। বড়লোকি চালে এখানকার বাসিন্দারা অনেকেই দামী কুকুর পোষে। দামী বকলেস হাতে পেঁচিয়ে তারা সকালে, রাত্রে কুকুরকে পটি করাতে নিয়ে যায়। তখন এ বস্তির বেওয়ারিশ নেড়ি কুকুররা রাস্তায় শুয়ে ঝিমোতে ঝিমোতেই মুখ তুলে ঈর্ষায় বা হিংসায় এক-দুবার সমস্বরে ভুক ভুক ডেকে আবার রাস্তায় গলা নামিয়ে ঝিমোতে থাকে।
যাক গে, এখন প্রশ্ন হল অরুণ কি বড়লোক? অবশ্য এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর হয় না। যেহেতু বড়লোকত্বের মাপকাঠি সর্বদা আপেক্ষিক। তাই এটুকু বলা যায় যে এখানকার আপেক্ষিকতায় অরুণ তেমন বড়লোক নয়। তার গাড়ি নেই। গাড়ির ফান্ডাও নেই। আবার এখানে বা অন্য কোথাও তার বাড়তি আস্তানা নেই। সে প্রেমিকা পুষতে পারে না। ও হ্যাঁ, এখানে কোনও কোনও তালেবর ফ্ল্যাট কিনে রেখে দিয়েছে। উইকএন্ডে প্রেমিকা নিয়ে আসে।
Advertisement
এ হেন অরুণের পরিচয় দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে তার এখন যা বয়স সে বয়সে মানুষের লোভ বাড়ে আর ঘুম কমে আর সুগার-প্রেসার হাই থাকে এবং কোষ্টকাঠিন্য ভোগায়। অর্থাৎ অরুণ সিনিয়র সিটিজেন। সদ্যই এ অভিধা পেয়েছে সে। ফলে ব্যাঙ্কে ০.৫% সুদ বেশি পায়। সুদটুকুই ভরসা তার। কারণ ভারতবর্ষের বেশিরভাগ জনগণের মতোই সে পেনসনহীন। অথচ দিন দিন ব্যাঙ্কের সুদ যা কমছে! অরুণ আনমনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে দুঃখ, আনন্দ দুটোই তার বুক ফুঁড়ে উপড়ে আসে। ঘুম কম ছাড়া বুড়োমির কোনও লক্ষণ তার মধ্যে নেই। প্রেসার-সুগার এখনও হামলা চালায়নি তার শরীরে। তার যথেষ্ট খিদে পায়। খেয়ে হজমও করতে পারে সে। তাই লোভ আছে। আর এখানেই দুঃখ! ভোগ করার মতো যথেষ্ট টাকা তার নেই! মাসে একদিন, বড়জোর দুদিন হোটেলে ভালোমন্দ খায়। খুব হিসেব করেই তাকে চলতে হয়।
Advertisement
দুঃখের এ টানাপড়েন নির্ঘুম অরুণকে আর বিছানায় থাকতে দেয় না। তাকে উঠিয়েই ছাড়ে। সে বাথরুমে যায়। তারপর শব্দ না করে ব্যালকনিতে যায়। পাশের ঘরে তার বউ ঘুমোচ্ছে। ওর আলো-শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত হয়। অরুণ আলতো উঁকি মারে সে ঘরে। কুঁকড়ে ‘দ’ হয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে মানুষটা। ঘুমের মধ্যে মানুষ কেমন যেন অচেনা, অসহায়ও। ভাবে অরুণ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় সে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফিফথ ফ্লোরের উচ্চতা থেকে দেখে সামনের, পাশের টাওয়ারগুলোর কোনও কোনও জানলায় খাপছাড়া ভাবে চৌখুপি আলোর সাদা পোস্টার সাঁটানো যেন। একদম সামনের একটা পোস্টার কিছুটা সিপিয়া রঙের। সেখানে এক প্রায় নব্বই বুড়ি খাটে শোয়া। আধা উলঙ্গ। সারাদিন বুড়িটা শুয়েই থাকে। কখনও-সখনও একজন মহিলা খাটে হেলান দিয়ে বসায়। খাওয়ায়। হয়তো মেয়ে বা বউমা কিংবা আয়াই। অন্য কাউকে তো ও ঘরে দেখতে পায় না অরুণ! সভ্যতার অভিশাপ! ভাবে সে। পরক্ষণেই ভাবনাটাকে সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দেয়। অরুণ মুহূর্তে বাঁচতে ভালোবাসে। চোখ ভাসায় সে দূরে। কমপ্লেক্সের বাইরে মেন রোড। তার ওপর মেট্রোরেলের ফ্লাই ওভার। ওপারে ইএসআই হাসপাতাল। তার উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে পূর্ণিমার নাগরিক ফরসা চাঁদটা কার্নিক মেরে ঝুলে আছে। আর হাসপাতালের পাশেই একটা ছোটোলোকের বস্তি। সেখানে একটা ক্লাব আছে। সে ক্লাবে রাত গুলজার করে ডিজে বক্স গাঁক গাঁক করে গান ছুঁড়ছে দিগ্বিদিক। এত রাতেও। তাতে ঝোলা চাঁদটা হালকা উড়ো মেঘের ফাঁকে মুখ লুকিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে যেন। অন্তত অরুণের তেমনই মনে হল। সন্ধেয় অরুণ হাঁটতে হাঁটতে কৌতূহলেই ওদিক পানে গিয়েছিল। দেখে সে-ক্লাবের চিলতে মাঠ জুড়ে হাঁড়ি-হান্ডার তোড়জোড়। রাত্রে দোল উপলক্ষে ফিস্ট।
হ্যাঁ, আজ দোল পূর্ণিমা। অরুণের বড়লোকের এ বস্তিও সকাল থেকে দোলে মজে ছিল। প্রথমে বুড়ি-আধ বুড়িদের প্রত্যেক বছরের সেই বস্তাপচা কয়েকখানি রবীন্দ্রগান সম্বল। তারপর ছোটো ছোটো মেয়েদের রবীন্দ্রনাচ। এটা অরুণের ভালো লাগে। সঙ্গে মালপোয়া আর ঠাণ্ডাই। এরপরে এগারোটা বাজতেই আসল মচ্ছব। ডিজে ছোকরার মাইক হাতে আহ্বান— হ্যাল্লো গাইজস! লেটস ডান্স!! হোলি হ্যায়!!! ফোয়ারা বসিয়ে জলের ঝর্নায় রেন ওয়াটার ডান্স। মেয়ে-মদ্দা, কচি-ধেড়ের জলে ভিজে উদ্দাম নাচ। অরুণ চোখ নামিয়ে তার একদম নিচের রাস্তায় তাকায়। ফ্যাকফ্যাকে এলইডি স্ট্রিটলাইটের হড়পা বানে জ্যোৎস্না কোথায় যে ভেসে গেছে! না, সভ্য নগরে জ্যোৎস্না নামে না! ভাবে অরুণ। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে একটা পরিত্যক্ত টবে সিগারেটের শেষটা গুঁজে দেয়। আর মুখ তুলতে গিয়ে উল্টোদিকের টাওয়ারের সেই সিপিয়া আলোর জানলার পোস্টারের ঠিক নিচের ফ্লোরটির জমাট অন্ধকার চোখ টানে তার। সেই ভাড়াটেটা বোধহয় চলে গিয়েছে। নতুন ভাড়াটে এখনও আসেনি হয়তো! মাসখানেক আগের ঘটনা। শীতের রাত। প্রায় দশটা। এ অসময়ে সভ্যতা বহির্ভূত চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে অরুণ ব্যালকনিতে উঁকি মারে। টাওয়ারের গেটের মুখে সিকিউরিটি, কমিটির দু-চার জন এবং একজন অচেনা মহিলা, সঙ্গে একটি বাচ্চা মেয়ে। আর পুলিশ। পুলিশই কৌতূহলী করে তোলে তাকে। জানে যে ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে ভদ্রলোক নিজের বউ-বাচ্চাকে ছেড়ে এখানে ভাড়া নিয়ে লুকিয়ে আছে। বউটি জানতে পেরে হানা দেয় পুলিশ ডেকে। সেই নিয়ে ঝগড়া, চেঁচামেচি, মারপিটও। প্রতিবেশির শান্তি নষ্ট। কমিটি থেকে ডেঁটে বলে দেওয়া হয় কোর্টে ফয়সালা করতে। এখানে ঝগড়া, মারামারি নয়। যতই হোক ভদ্রলোকের বস্তি! ঝগড়া, মারামারি কর, কিন্তু সাউন্ডপ্রুফ প্রসেসে। আওয়াজ যেন বাইরে না আসে! গায়ে কালশিটে পড়লে পমেটমের পুলটিশ লাগিয়ে মেকআপ করবে!
এ সব স্মৃতির উস্কানির মাঝেই অরুণও এবার তার নৈঃশব্দে সেঁধোবে ভাবে। এমনই সময়ে একসঙ্গে তিনটে ঘটনা ঘটে যায়। বাইরের বস্তির ডিজে বক্স বন্ধ হয়। সেই সঙ্গে পাশের টাওয়ারের গেটে জোমাটোর একটা ডেলিভারি বয় তার স্কুটার স্ট্যান্ড করে। ছেলেটি খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঢুকে যায় ভেতরে। ফোন টিপে সময় দেখে অরুণ। রাত পৌনে দুটো। এত রাতে খাবারের দোকান খোলা থাকে! আর খায়ই বা কারা! ভাবে সে। তক্ষুনি তার সে ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে ইএসআই হসপিটালের গেটে একটা অ্যাম্বুল্যান্সের হুটার নীল আলো উগড়ে আছড়ে পড়ে অরুণের মনে এ প্রশ্ন উসকে দিয়ে, কোনো চাকরিচোর বা গরুচোর মন্ত্রী কি এলো! হুটার আচমকা স্তব্ধ হলে নিশুতি রাত অন্য শব্দে জেগে ওঠে সহসা এ বস্তিতে। করাতকলের খরর খরর আওয়াজ তুলে এসি মেশিনগুলো দেমাকে জানান দেয় যে এটা বড়লোকের বস্তি। মার্চ মাসের মাঝামাঝি। এখনও গরম তেমন পড়েনি। তবুও এসি! এখনকার বাসিন্দাদের গরম সত্যিই বেশি! টাকার গরম! হয়তো! ভাবনারা ঘাই তোলে অরুণের মনে। অরুণ আপাতত নৈঃশব্দ্যে সেঁধোয়।
অরুণ জল খায়। বিছানায় শরীর এলিয়ে অভ্যাস বশে ফোন অন করে ফেসবুকে যায়। কবিতা আর কবিতা! যার বেশিরভাগই অরুণ বুঝতে পারে না আজকাল। সে কি তবে বুড়োই হয়ে গেল তবে! আর তার এ ভাবনা আদল পেল কি পেল না হাতের ফোনটি স্মার্টলি কেঁপে ওঠে। হোয়া মেসেজ। নন্দিনীর।
—এখনও ঘুমোওনি! রাত জেগো না আর। ঘুমিয়ে পড়।
—তুমিও তো ঘুমোও নি! আর কত পড়বে? শুয়ে পড় এবার। আমার না হয় ঘুম আসে না।
—হ্যাঁ, শোব এবার। তুমিও ফোন রেখে শুয়ে পড়। ঠিক ঘুম আসবে।
এই বলে নন্দিনী একটা ভালোবাসার ইমোজি পাঠায়। অরুণও পাল্টা পাঠায়। এদের জন্য খুব মায়া হয় অরুণের। এ সরকার নন্দিনীদের প্রজন্মের সব চাকরি চুরি করে বসে আছে। পড়াশুনোই সত্যিই ব্রিলিয়াণ্ট নন্দিনী। অবশ্য নন্দিনীর আরও একটা গুণ আছে। যে কারণে অরুণ ভালোবেসে ওকে ভীষণ। খুব ভালো লেখে সে। এ বয়সেই পরিণত বেশ। পাঁচ-ছ বছর আগে ফেসবুকে ওর লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ভালোলাগা।
যেটা আগে বলা হয়নি, অরুণের আরেক পরিচয় সে লেখক। বাজারি না হলেও সাহিত্যিক মহলে তার নাম আছে। তবে তার সম্পর্কে অভিযোগ সে নাকি কঠিন! সবচেয়ে বড় যেটা, তার পি-আর খুব খারাপ। কোথাও যায় না সে।
নন্দিনীই তো অনুযোগ করে, —তোমার কিন্তু মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভায় যাওয়া উচিত।
—কী হবে গিয়ে। সময় নষ্ট। পয়সা নষ্ট। ওরা টাকা দেবে? তার চেয়ে পার্কে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখব, সেও অনেক কাজের। অরুণ হেসে উত্তর দেয়।
—আপনার কিন্তু আরও একটু বেশি লেখা উচিত। এত কম লিখলে…। নন্দিনীর অনুযোগের শেষ নেই যেন!
—কম লিখলে বাংলা বাজারে টিকে থাকা যায় না, তাই তো! আরে, এই করে চল্লিশ বছর ভেসে তো আছি! আর তুমি তো পড়। সেটাই আমার বড় পাওয়া।
সত্যিই নন্দিনী তাকে বড্ড ভালোবাসে। মায়া দেয়। বিশেষ করে যখন সে লিখতে পারে না। অস্থির হয়। তখন অরুণ একটা ছায়ার জন্য ছটফট করে। তখনই নন্দিনী তাকে সেই ছায়া দেয়। না, অরুণের বউ তার লেখালিখিতে বাধা না দিলেও উৎসাহও কখনো দেয়নি। অরুণের মনে পড়ে যায় নন্দিনীর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হওয়ার দিন। করোনার পরে
প্রথম বইমেলা। অরুণই ওকে দেখে প্রথম।
—আপনিই তো কাকলি! পেছন থেকে ডেকেছিল অরুণ।
—অরুণদা, আপনি! ঘুরে চমকে ধাঁ করে প্রণাম করেছিল মেয়েটি।
মেলায় ওরা চারজন ছিল। কাকলি, অনিন্দিতা, দিব্যেন্দু ও সিদ্ধার্থ। চারজন মিলে একটা পত্রিকা চালায়। একমাত্র সিদ্ধার্থ চাকুরিজীবী, সরকারি স্কুলে পড়ায়। বাকি তিনজন বেকার। তবে দিব্যেন্দুই সবার বড়,
সে-ই প্রধান সম্পাদক, প্রাইভেট ট্যুইশনি করে। অসমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও চারজনে ভালো বন্ধু বেশ। অরুণের ভালো লাগে ওদের। বই, পত্রিকা কেনে অরুণ। দিব্যেন্দু চা খাওয়ায়। ফোটো ওঠে। দূরের বলে ওরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। সে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের, নাকি কাকলির পথ পানে! জানে না অরুণ। শুধু তার চোখদুটো চশমার আড়ালে অকারণ ঝাপসা হয়। কিছু দূরে গিয়ে কাকলি, কেবল কাকলিই মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে মায়া ভাসায়। কোন রসায়নে যে দুজন মানুষ বন্ধনে জড়ায়! কে জানে!
তবে সত্যিই তারা দু’জনে দিনে দিনে বন্ধনে জড়ায়। বিশেষ করে অরুণ। তার বুভুক্ষু পিতৃহৃদয় যেন জল পায়। সে কাকলিকে মেয়ে বলে ডাকে। কাকলিও সাড়া দেয়। হ্যাঁ, কাকলি তখনও নন্দিনী হয়নি অরুণের। গত বছর চৈত্রে ওর জন্মদিনে ফোনে কোন এক আবেগে অরুণ তাকে বলে, —দেখ তুমি আমার স্বপ্নে পাওয়া মেয়ে। তোমাকে নিজের করে পেতে চাই। আমি যদি তোমার নতুন একটা নাম দিই, যেটা শুধু তুমি আর আমি জানব! আর কেউ না!
—কী নাম?
—নন্দিনী।
—বাহ! সুন্দর নাম। আমি নিলাম।
নন্দিনী! আমার নন্দিনী! গুনগুন সুরে বাতাস গেয়েছিল সে নাম। আর বৃষ্টি নামিয়েছিল। সে মরসুমের প্রথম কালবৈশাখী। ধরিত্রী বহুদিন পর জল পেয়ে শীতল হয়েছিল। অরুণও। জল বসত করেছিল তার চোখে।
সেই থেকে কাকলি অরুণের নন্দিনী। আপনি থেকে কখন যে তুমি!
অরুণ মজা করে বলে, —তুমি আমাকে ভালোবাসলে কেন বল তো! ফিরিয়ে দিতেও তো পারতে!
—কী করি! তুমি যে ভালোবাসা দিলে আমাকে! মেয়েরা ভালোবাসা বুঝতে পারে।
আর এক হড়পা বান ডেকেছিল অরুণের মনে। বানে ঘাই জেগেছিল— ওর নন্দিনী আছে, নিজের নন্দিনী! কিন্তু ও যে অনেক দূরে থাকে। বর্ধমানের কাছে কোনও এক গ্রামে। অরুণ ইচ্ছে হলেই দেখা করতে পারে না। আর নন্দিনীও কলকাতাও আসে কম। কখনও কখনও তীব্র মনখারাপে অবসাদে ডোবে। ফোন করে, হোয়াটস অ্যাপ করে। সাড়া না পেলে অস্থির হয় অরুণ। কী যে বন্ধনে জড়াল সে এ বয়সে! তবুও এ বন্ধন ভালোবাসে সে। একবার অভিমানে বলেছিল অরুণ, —আমি তোমার পিতা নই, পুত্র নই, এমন কি প্রেমিকও নই। তুমি আমার কথা ভাববে কেন!
থমকে ছিল সে মেয়ে। তারপর থেমে থেমে বলেছিল সে, —তুমি আমার সব।
সজল ছিল যেন সে উচ্চারণ! বৃষ্টি নেমেছিল অরুণের মনেও, —তুই আমার মেয়ে। আমারই।
সেই বইমেলার পর আবার দু’জনের দেখা হয়েছিল হঠাৎই কলকাতার এক সাহিত্যসভায়, যে দুয়েকটা সভায় অরুণ না করতে পারে না। ওরা চারজনই ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে ডেকে নিয়েছিল। ওদের চারজনকে খুব ভালো লাগে অরুণের। নন্দিনী তার পাশে অরুণকে বসিয়েছিল। সারাক্ষণ অরুণের হাত নিজের কোলে রেখে হাত বুলিয়েছিল অরুণের নন্দিনী পরম মায়ায়। সে মায়ায় ডুবে গিয়েছিল অরুণ।
সে মায়া আজ রাতেও যেন ঘুম নামিয়ে আনে অরুণের চোখে। আর তখনই বালিশের পাশে রাখা ফোনটা শব্দহীন কম্পনে জেগে ওঠে। অরুণকে জাগায়। সে ঘুমচোখে ফোনে দিব্যেন্দুকে ফুটে উঠতে দেখে। দু’দিন আগে ওদের বন্ধু কাকলির জন্মদিনে ওরা ওর বাড়ি গিয়েছিল। তার ছবি পোস্ট করেছে দিব্যেন্দু। অরুণও ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল তার নন্দিনীকে। বড় দূরে থাকে যে তার নন্দিনী! ওর বাড়ি যেতে গেলে রাত্রিবাস করতে হবে। সেটা সম্ভব নয়। এক কাচ-কাচ বেদনা গলায় ছায় অরুণের। দিব্যেন্দু লিখেছে কাকলি ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো। তাই সে অবলীলায় তার চুল টানতে পারে। গাল টিপতে পারে। এক আধবুড়ো লোক কেন অরুণের নন্দিনীর চুল টানবে, কেন গাল টিপবে! অরুণের নন্দিনী তো পূর্ণ যুবতী। কাঁচ ক্ষত রক্ত ঝরায় অরুণের বুকে। পিতার সংশয়! নাকি নিঃস্ব পুরুষের যৌন ঈর্ষা! জানে না অরুণ!
কিশোরী রানুর বিয়ের পরদিন ভোরবেলায় তার ভানুদাদা কেন গিয়েছিল রানুর বাড়ি! জানে নাই ভানুও!
Advertisement



