কল্যাণ ভট্টাচার্য
“তুমি বলবে যে আমি ভৌ ভৌ করছি, কিন্তু
তুমি জানো না, আমার ভেতরে অনেক কুকুর, আর
এখন তারা এত হিংস্র হয়ে উঠেছে যে
আমি তোমাদের সাবধান করে দিতে চাই, কারণ
যে কোনও মুহূর্তে তারা তোমাকে চিরে
নাড়িভুঁড়ি বের করতে পারে, আর
আমি এটাও জানি যে, তোমার ভেতর থেকে
এখন লাল রক্তের একটি ফোঁটাও বেরোবে না,
কারণ তুমি এখন একটা আরশোলা, আর
সেই জমির সঙ্গে সেঁটে গেছ,কিন্তু
তুমিও দেখে নিও, উপরে নীল আকাশের সঙ্গে
লেপ্টে থাকা তোমার সেই চাঁদকে
এখন আমি রুটি বানিয়ে দেবো, কারণ
চাঁদ-তারা থাকা সত্ত্বেও
তুমি কারও জন্যে আলো থাকতে দাওনি”…
(এটা কবিতা নয়/ একগুচ্ছ রাওয়েল পুষ্প)
সাংঘাতিক এ দৃশ্য! এ কি রাওয়েল পুষ্পর মুখোমুখি আরেক রাওয়েল পুষ্প! তিনি তো কবিতাই লিখতে চেয়েছেন! চারপাশের নানা জীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত রাওয়েল পুষ্প যেন নিজেকেই ছিঁড়েখুঁড়ে আরেক রাওয়েল পুষ্পকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থের অনুবাদক শ্যামল ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন “রাওয়েল পুষ্পর কবিতার আকাশ প্রায়ই আক্রোশের মেঘে জলদগম্ভীর। এই আক্রোশ মানবতার নিরিখে নানা সামাজিক টানাপোড়েনের ফুটন্ত বুদ্বুদ। অনেক ঘটনা তাঁকে কষ্ট দেয়। নিজের সময়ের অনেক অসঙ্গতি এবং বৈষম্যকে সরাসরি আক্রমণ করেন। সেজন্যই তিনি উচ্চকিত। কোথাও কোথাও ব্যঙ্গ তাঁকে ক্ষুরধার করে। মানবিক করুণাই তো তাঁর এই আক্রোশ আর ব্যঙ্গের মূল শক্তি। এই শক্তিই তাঁর ভাবনাকে বিবেকের ভূমিকা প্রদান করে নতুন মাত্রা দান করে। আক্রমণ একটি উত্তরদায়িত্ব এবং বিবেকের তাড়না থেকে। আর এই তাড়নাই তো সৃষ্টির বড়ো উপাদান।”
প্রায় দুশো বছরের উপর বিদেশি শাসনের অবসানের পর এদেশের মানুষ এক সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ দেখার বাসনায় যখন বারংবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন কবি রাওয়েল পুষ্প স্বয়ং সেখান থেকে মুক্ত হতে পারেন না, সে কথা তাঁর পরিবারের জীবন যন্ত্রণার কথা থেকেই আমরা জানতে পারি। সেই আঘাত ব্যক্তি ও পরিবার ছাড়িয়ে যখন অনন্ত মানুষের ভিড়ে আছড়ে পড়ে তখন কবিমনও আর্তনাদ করে ওঠে। সেই আর্তনাদই কবিকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। কবি তখন নিজেকেই ছিন্নভিন্ন করেন। চলে নিজের উপর নিজের পোস্ট মর্টেম। তাই ‘এটা কবিতা নয়’ কবিতায় কবি বলতে পারেন— “আমরা এখনও বদলাইনি/ তখন তুমি চোখ লাল করে পরামর্শ দিলে যে/ এখন নিজেদের কলমের কালি বদলে দাও, আর/ নিজেদের মস্তিষ্কে কিলবিল করতে থাকা/ বুকে হেঁচড়ে যাওয়া পোকাগুলিকে পিষে দাও”…। কবিতার এমত বজ্রনির্ঘোষ পঙ্ক্তিগুলি আমাদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আমাদের ভাবতে শেখায়। দিকনির্দেশ করে।
কবি রাওয়েল পুষ্পর কাব্যভাষা প্রাঞ্জল। তাঁর কবিতায় স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের পরিবর্তে গদ্যছন্দের সুনিপুণ ব্যবহার সবিশেষ নজরে পড়ে। কিন্তু পাঠককে তাঁর পেলব লেখনীর গুণে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে জানেন। তাঁর কবিতায় থাকে নানাবিধ বিষয়বৈচিত্র্য। সুনিপুণ শব্দ ব্যবহারের অনায়াস অধিগম্যতা আছে। আছে কাব্যিক ইঙ্গিতময়তা, যা পাঠককে কাব্য-তন্ময়তা এনে দেয়। তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গ, অদ্ভুতত্ব, বীভৎস রসের লক্ষণও কবিকে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। কখনো তিনি স্পষ্ট, আবার কখনো তিনি অস্পষ্ট। একটা দোলাচল শাব্দিক বিন্যাসও লক্ষ্য করা যায়। আবার বেশ কিছু কবিতায় গাল্পিক উপাদানও বিশেষ লক্ষ্যণীয়।
যেমন ‘খুনের অভিযোগ’ কবিতায় একটা অদ্ভুতত্ব তথা অস্পষ্টতা আমরা লক্ষ্য করি।, কবিতায় প্রেম থেকে অপ্রেমে যেতে যেতে কবি বলে ওঠেন— “আমি রেগেমেগে একটি ছারপোকাকে/ পায়ের তলায় পিষে দিই।/ কিন্তু ততক্ষণে আমার উপর চেপে গেছিল/ সরাসরি খুনের অভিযোগ।” (খুনের অভিযোগ/ একগুচ্ছ রাওয়েল পুষ্প)।
মানবিক জীবন যন্ত্রণাকে তীক্ষ্ণভাবে তুলে ধরতে কবি কখনো কখনো রামায়ণ মহাভারতের মতো মিথকেও অনায়াসে ব্যবহার করেছেন। এই জীবন যন্ত্রণা শুধু সামাজিক অবক্ষয়কে কেন্দ্র করে নয়; স্বার্থপরতার কারণে পরিবেশ প্রকৃতির উপর মানুষের ক্রমাগত বর্বরতা কবিকে কী ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে তারই আলেখ্য তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। যেমন তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আমাকে গর্ভেই মেরে ফেল’-তে সরাসরি মহাভারতের মিথকে তিনি প্রয়োগ করেছেন এভাবে— “হে অশ্বত্থামা!/ এখন আর দেরি করো না/ নিজের তির বের করো/ জ্যা-তে চড়াও/ আরেকবার রেগে ওঠো/ এখন কোনও কৃষ্ণ তোমার পথ আটকাবে না!/ আমার উপর দয়া করো/ আর আমাকে গর্ভেই মেরে ফেল । কারণ এখন কোনও পরীক্ষিৎ/ কোনও উত্তরার গর্ভে জন্ম নেবে না/ এখন তো বিকৃত মস্তিষ্ক নিয়ে/ পঙ্গুদের জন্ম হবে। যারা জন্ম নিয়েই আবার মৃত্যুর জন্য আকুল”…। যুগ যুগ ধরে একটা প্রশ্ন মানুষকে কুরে কুরে খেয়ে এসেছে— ধর্ম কী? ধর্মের সঠিক সংজ্ঞা বা অবস্থান সম্পর্কে মানুষ আজও দোদুল্যমান। কবি স্বয়ং ধর্মকে বোঝার জন্য কি হিন্দু পুজারি, কি মুসলমান মৌলভি আর কি গুরুদ্বারের জ্ঞানীজি সকলের কাছেই গন্ডিবদ্ধ সংকীর্ণ ধর্মের ব্যাখ্যা পান কিন্তু বিশ্বজনীন উদার ধর্মের কথা কেউ বাৎলাতে পারেন না। কিন্তু এক বুদ্ধিজীবীর কাছে ধর্মের সঠিক মূল্যায়ন পান; যেখানে সেই বুদ্ধিজীবী বলেন, ধর্ম সেটাই, যা আমাদের পরস্পরকে ভালবাসতে শেখায়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন লাশ পড়তে দেখেন কবি, তখন ধর্ম সম্বন্ধে তীর্যক এক শ্লেষ আছড়ে পড়ে তাঁর কবিতায় ধর্ম…। ‘‘এটুকু বলতেই লাশ থেকে/ একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে,/ আরে বোকা এটাও বোঝো না,/ আর বলো যে,আমার সম্পর্ক লেখার সঙ্গে!/ না জানলে শোনো—/ ধর্ম এমন জিনিস যা মানুষকে মানুষের প্রতি ঘৃণা/ আর পরস্পরের বুকে/ নির্দ্বিধায় ছুরি বসাতে শেখায়!” কবি রাওয়েল পুষ্পকে অভিবাদন জানাতেই হয়।
―‘জমির খোঁজ’ কবিতায় কবি নিজের সনাক্তকরণের ইতিহাস তুলে ধরেন। যেন নিজেকে নিয়েই মস্করা করছেন কবি। এও এক পোস্ট মর্টেম কবিতা। এখান থেকেই তিনি তাঁর উত্তরণ খুঁজে নেন।… “তারপর সর্বদাই এই ভয় থাকে যে/ সেই মাটি যখন খুশি আমার পায়ের/ নিচ থেকে সরানোও হতে পারে!/ সেজন্যেই চাই যে আমার পায়ের নিচে। সেই মাটি থাকুক, যার প্রত্যেক অংশে/ আমারই শরীর থেকে বেরিয়ে আসা/ স্বেদবিন্দুগুলির চমক থাকবে, আর/ তারপর শুধু তুমি কেন, আমি নিজেও। গর্বের সঙ্গে বলবো,/ আমার পায়ের নিচে যে মাটি আছে/ আমি সেই মাটির খোঁজে আছি।” এভাবেই কবি রাওয়েল পুষ্প এগিয়ে যান তাঁর নির্দিষ্ট কক্ষে।
তাঁর সনাক্তকরণের আরেকটি কবিতা ‘আমার অ্যালবাম’। এখানেও কবি রাওয়েল পুষ্পর মুখোমুখি আরেক রাওয়েল পুষ্প।… “আমার ছবিগুলি, আমার অ্যালবাম/ আর মুখ ভ্যাংচাতে থাকে/ আর ছিঁড়ে ফেলতে থাকে/ আমার সমস্ত কল্পনা চিত্র/ আমি অপলক দেখতে থাকি/ সে অট্টহাসি হাসতে থাকে/ তার হাসি আমার হৃদয়ে/ বিষাক্ত তির হয়ে খোঁচাতে থাকে। । তাকে একটা চড় মারারও সাহস করতে পারিনি”…। এখানে আসলে নিজের মুখোমুখি বস্তুত নয়, সত্যের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন কবি। আর এখানেই তিনি মহান।
বিগত ২০২০-২১-র ভয়ংকর করোনা সমগ্র পৃথিবীকে তছনছ করে দিয়েছিল এ কথা আমরা সবাই জানি। গোটা ভারতবর্ষ একটা লাশঘরে পরিণত হয়েছিল। কবি রাওয়েল পুষ্পর দুটি কবিতা ‘লাশঘরে বদলে যাওয়া দেশ’ ও করোনার গান তার সাক্ষ্য বহন করে। সেখানে তিনি মানুষের উদ্দেশে সোচ্চার হয়েছেন এভাবে “হে অসভ্য মানুষ, সরাসরি নতজানু হও/ আর এই শপথ নাও,/ ঈশ্বরের দেওয়া সুন্দর প্রকৃতিকে ভবিষ্যতে আর ধ্বংস করবে না!” আসলে অহংসর্বস্ব মানুষই নিজের হত্যাকারী। মানুষ আসলে যে রক্তবীজের দল তিনি এদুটি কবিতায় প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন। কবির চোখ থেকে সামাজিক কোনো ব্যাধিই আড়াল হতে পারেনি। সেইজন্যই তো বলা হয়, “যাঁহা না পৌঁছে রবি/ উঁহা পৌঁছে কবি”। আর এই ভয়াবহ করোনা সময়কে নিয়েই কবির তীর্যক শ্লেষ ঝরে পড়ে তাঁর ‘ঈশ্বর মরে গেছে’ কবিতায়। ঈশ্বর একটি ব্যক্তির নাম যে একটা খাবারের গুমটি চালাতো। আসলে সে মারা গেছে। সে সৎ, সরল মানুষ। আমাদের মাথার উপর যে ঈশ্বর তিনি আমার মুখে খাবার তুলে দেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। এই ঈশ্বরও কবির পরিবার ও তাঁদের প্রতিবেশীদের খাবার দিতো। এই কবিতায় গাল্পিক উপাদান লক্ষ্যণীয়। আর সেই ঈশ্বর মারা গেল! কবি তির্যক শ্লেষ দিয়ে যেন বলে উঠলেন, আসলে প্রকৃত ঈশ্বর যেন মারা গেল। দ্বৈত সত্তাকে একটি সত্তায় ভরে দিয়ে কবি যেন মস্করা করে উঠলেন ভয়াবহ সময়কে নিয়ে।
এই শ্লেষই আবার আছড়ে পড়ে যখন তিনি ‘ভালো, আপনার ফাঁসি হয়েছে ভগৎ সিং’ কবিতাটি লেখেন। ভালো নেই ভারতবর্ষের মানুষ। একথাই তিনি এই কবিতায় মূর্ত করে তোলেন। স্বয়ং ঈশ্বরকে নিয়ে মস্করা করে লোফালুফি করতে পারেন সম্ভবত কবিই। কবি রাওয়েল পুষ্প তাঁর ‘ঈশ্বর হওয়ার কী মানে” কবিতায় বলছেন— “কিন্ত আমি জানি না/ কখনও ঈশ্বরের কাছে কিছু চেয়েছি কিনা!/ কারণ আমার কিছু দরকার হলে/ তা তো ঈশ্বরের জানার কথা/ আর যদি তিনি না জানেন/ তাহলে ঈশ্বর হওয়ার মানে কী?” মোক্ষম প্রশ্ন তিনি পাঠকের দরবারে ছেড়ে রাখলেন। এমন কবিতা তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে আরো অনেক আছে, যা এখানে কলেবরের কারণে উল্লেখিত হলো না।
কবি রাওয়েল পুষ্পর কবিতায় শ্লেষ বা ব্যঙ্গ প্রধান উপাদান। ফলে পাঠক ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখার অবকাশ পায়। কবি আর পাঠক সেখানে একাকার হতে পারে। পাঠক যেন উপলব্ধি করে, আরে, এ কথা তো আমারই। তাঁর কাব্যিক উচ্চারণ ঋজু। ব্যঞ্জনাগর্ভ শব্দের বিন্যাস আছে, কিন্তু মোহময় অকৃত্রিম। কবির অভিজ্ঞতালব্ধ পথ পরিক্রমা বহুযোজনবিস্তৃত। এবং তা পাঠক উপাদেয় বলাই বাহুল্য।
একগুচ্ছ রাওয়েল পুষ্প
অনুবাদ : শ্যামল ভট্টাচার্য
প্রকাশক : ঈশপ, বাঁকুড়া / মূল্য : ৩০০ টাকা