স্বপ্নের ফুটবল তারকা মেসিকে নিজের চোখে এক ঝলক দেখার স্বপ্ন নিয়ে শনিবার হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী যুবভারতীতে ভিড় জমিয়েছিলেন। আশা ছিল, জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত উপভোগ করা। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় বিশৃঙ্খলা, ধাক্কাধাক্কি আর হতাশার ভিড়ে। ঘটনার পর থেকেই একাংশের রাজনৈতিক মহল সরাসরি নিশানা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রশ্ন উঠছে, যুবভারতীতে যা ঘটল, তার দায় কি সত্যিই তাঁর কাঁধে চাপানো যায়?
ঘটনার সময়সীমা খতিয়ে দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মুখ্যমন্ত্রী স্টেডিয়ামে পৌঁছনোর আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই অনুষ্ঠানটি ছিল সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত। রাজ্য সরকারের কোনও সরকারি কর্মসূচি ছিল না। আয়োজক সংস্থা যে সহযোগিতা চেয়েছিল, ক্রীড়াদপ্তর, যুবভারতী কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হয়েছিল। নজরদারি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও অনেক আগেই আয়োজকদের গাফিলতিতে দর্শকদের ক্ষোভ জমতে থাকে।
Advertisement
নির্ধারিত সময় অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যায় যুবভারতীতে প্রবেশ করেন লিওনেল মেসি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লুইস সুয়ারেজ ও রডরিগো ডি’পল। মাঠে ঢোকার মুহূর্তেই অতিরিক্ত ভিড় ও অব্যবস্থার কারণে কার্যত আড়ালে চলে যান মেসি। তিনি হাসিমুখে দর্শকদের উদ্দেশে হাত নাড়লেও গ্যালারিতে বসে থাকা বহু মানুষ তা দেখতেই পাননি। সেখান থেকেই শুরু হয় উত্তেজনা। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় নিরাপত্তার কথা ভেবে দ্রুত মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন মেসি।
Advertisement
এই অনুষ্ঠানেই উপস্থিত থাকার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু মাঠের পরিস্থিতি বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া বাতিল করা হয়। ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সামাজিক মাধ্যমে দীর্ঘ বার্তা দিয়ে ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, যুবভারতীতে যে অব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে তিনি স্তম্ভিত ও মর্মাহত। প্রিয় ফুটবলারের পাশাপাশি অসংখ্য দর্শকের কাছে তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। একই সঙ্গে টিকিটের টাকা ফেরতের নির্দেশ দেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম কুমার রায়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ঘটনার জন্য দায়ী বেসরকারি আয়োজককে পুলিশ গ্রেপ্তারও করে।
তবু এখানেই থেমে থাকেনি রাজনৈতিক বিতর্ক। কেন্দ্রীয় শাসক দলের একাধিক নেতা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে কটাক্ষ করেন। বিরোধী কংগ্রেস ও সিপিএম থেকেও একই সুরে আক্রমণ করা হয়। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতার দায় মুখ্যমন্ত্রীর।
কিন্তু অনেকের প্রশ্ন, বেসরকারি সংস্থার পরিকল্পনাহীনতার দায় এককভাবে মুখ্যমন্ত্রীর উপর চাপানো কি ন্যায়সঙ্গত? অতীতের দিকে তাকালেই দেখা যায়, কলকাতায় একাধিক আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আগেও এই মেসি কলকাতায় এসে খেলেছেন, তখনও রাজ্য প্রশাসন দক্ষতার সঙ্গে জনসমাগম সামলেছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সমস্যার গোড়ায় ছিল পুরো সফরের অবাস্তব পরিকল্পনা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার সফরে মেসির জন্য একের পর এক কর্মসূচি সাজানো হয়েছিল— মূর্তি উন্মোচন, সাক্ষাৎপর্ব, মাঠে প্রবেশ, সাংস্কৃতিক আয়োজন, প্রাক্তন খেলোয়াড়দের খেলা দেখা, স্পনসর ও বিশেষ অতিথিদের নানা দাবি পূরণ। এর পাশাপাশি ভক্তদের সঙ্গে করমর্দন ও ছবি তোলার জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এত অল্প সময়ে এত আয়োজন একজন মানুষের পক্ষে বাস্তবসম্মত ছিল না বলেই মত অনেকের।
অভিযোগ উঠেছে, দর্শকের আবেগের চেয়ে ব্যবসায়িক লাভকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। টিকিটের দাম থেকে শুরু করে মাঠের ভেতরে চড়া দামে জল বিক্রি—সব কিছুই সেই অভিযোগকে জোরালো করে। বিশৃঙ্খলার মাঝেই গ্যালারিতে রাজনৈতিক স্লোগান ও পতাকা দেখা যাওয়ায় বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়। যুবভারতীতে বিশৃঙ্খলার মাঝেই দেখা গিয়েছে গেরুয়া পতাকা, সঙ্গে জয় শ্রীরাম স্লোগান। তাই অনেকের ধারণা, মূল ব্যর্থতার জায়গা আড়াল করতেই মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে রাজনৈতিক আক্রমণ জোরালো করা হয়েছে।
Advertisement



