পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত এলাকায় এক হোটেলের ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া এক যুবকের দেহ ঘিরে রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। তদন্তে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। সূত্রের খবর, মৃত যুবকের নাম রাহুল দাস (২৫)। বাড়ি পার্ক স্ট্রিট থানার কলিল রোড এলাকায়। ময়নাতদন্তে প্রমাণ মিলেছে, গলায় কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে তাঁকে।
শুক্রবার সকালে রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের ওই হোটেল থেকে পচা গন্ধ বেরোতেই কর্মীরা বিষয়টি টের পান। সন্দেহ হওয়ায় খাটের বক্স খোলেন। বেরিয়ে আসে রক্তাক্ত মৃত দেহ। এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সকলে। সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয় পুলিশে। পার্ক স্ট্রিট থানার আধিকারিকরা এসে দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠান।
Advertisement
পুলিশ সূত্রের খবর, মৃত রাহুল দাস ওরফে রাহুল লাল কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। পিকনিক গার্ডেনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতেন তিনি। ২২ অক্টোবর বিকেলে দুই বন্ধুকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের ওই হোটেলে ওঠেন রাহুল। ভুয়ো আধার কার্ড ব্যবহার করে ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। রিসেপশনে জমা দেওয়া আধার আসলে তাঁর ভাইয়ের। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, রাতে তাঁদের মধ্যে একজন বাইরে যান, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ফিরে আসেন। এরপর কিছুক্ষণ পর দুই যুবক একসঙ্গে হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। রাহুলকে আর দেখা যায়নি।
Advertisement
পুলিশের ধারণা, মদ্যপানের সময়ই রাহুলের সঙ্গে বাকি দু’জনের বিবাদ বাধে। তার জেরেই রাহুলকে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে তাঁর সঙ্গীরা। এরপর প্রমাণ নষ্ট করতে আততায়ীরা খাটের ভিতর দেহ লুকিয়ে পালিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, হোটেল থেকে বেরোনোর সময় বেডশিট, মদের বোতল, এমনকি সিগারেটের বাডসও তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়, যাতে ঘরে কোনও প্রমাণ না থাকে।
তবে তদন্তকারীদের অনুমান, খুনটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, ‘এই হত্যাকাণ্ড কোনও আকস্মিক রাগের কারণে নয়। রাহুলকে টার্গেট করেই ফাঁদ পাতা হয়েছিল। অপরাধীদের খোঁজে আমরা একাধিক সূত্র পেয়েছি।’
এরপর ঘটে আরও এক রোমহর্ষক ঘটনা। হত্যার রাতের পরের দিনই এক দম্পতি সেই ঘরেই ওঠেন। মৃতদেহ রাখা বক্স খাটে সারারাত ঘুমিয়েছেন তাঁরা। অথচ তাঁদের অজান্তেই, খাটের বক্সে লুকিয়ে ছিল রক্তাক্ত দেহ! শুক্রবার সকালে দুর্গন্ধ বেরোতেই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
তদন্তে জানা গিয়েছে, রাহুলের অপরাধজগতের সঙ্গে যোগ ছিল। চুরি ও প্রতারণার মতো একাধিক মামলায় তাঁর নাম রয়েছে। পুলিশের সন্দেহ, ওই দুই ‘বন্ধুও’ অপরাধচক্রের সদস্য। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, পলাতক দু’জনই ওড়িশার বাসিন্দা। তাঁদের খোঁজে ইতিমধ্যেই রাজ্যজুড়ে তল্লাশি শুরু হয়েছে।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, ‘পুরো ঘটনাটাই অত্যন্ত কৌশল অবলম্বনে করা হয়েছে। খুনিরা পেশাদার অপরাধী বলেই মনে করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ, ফোন কল রেকর্ড, এমনকি আশপাশের দোকানের ক্যামেরা— সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
তদন্তে উঠে এসেছে আরও কয়েকটি প্রশ্ন। কেন মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন তাঁরা? কী কারণে রাহুলকে খুন করা হল— আর্থিক লেনদেন, না কি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ? খুনের সময় ঘরে থাকা অপর দু’জন কোথায় গেলেন? পুলিশ জানাচ্ছে, মোবাইল ফোনের লোকেশন ও কল রেকর্ড বিশ্লেষণ করে তাঁদের গতিবিধি অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
পার্ক স্ট্রিটের মতো অভিজাত এলাকায় এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে গোটা শহরজুড়ে যথেষ্ট চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ‘এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি। এত জনসমাগমের জায়গায় এমন ঘটনা হওয়া অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।’
এদিকে মৃতদেহ উদ্ধারের ২৪ ঘন্টা পরেও অধরা দুই অভিযুক্ত। তাঁদের ধরতে কলকাতা ও ওড়িশা দুই জায়গাতেই তল্লাশি চলছে। তদন্তে যতই সময় যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। অনেকে অনুমান করছেন, রাহুল লালের এই খুনের পেছনে বড় কোনও অপরাধচক্রের যোগসূত্র লুকিয়ে থাকতে পারে।
Advertisement



