গোবিন্দ মুখার্জি
দেশব্যাপী নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র রামমন্দির, যেসব মন্দিরে নিত্য রামের পুজো হয়ে থাকে। তারই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায় রামরাজাতলার রামমন্দিরের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। রামের পুজো করা হতো বলেই এই এলাকার নামকরণ হয় রামরাজাতলা। ‘বিশেষ’ এই কারণেই যে, এই মন্দিরে টানা ৪ মাস ধরে রাম-সীতার পুজো করা হয়ে থাকে। আর এই ৪ মাস ব্যাপী পুজোকে কেন্দ্র করে রামরাজাতলায় মেলার আয়োজন করা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসের রামনবমীতে মেলা শুরু হয় এবং শেষ হয় শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবারে। এই ৪ মাস ধরে রামকে দেখতে পান ভক্তরা। এটিই পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মেলা। পুজোকে ঘিরে এই প্রথা অনুসরণ করা হয়ে আসছে গত প্রায় ৩০০ বছর ধরে।
Advertisement
ভাগীরথীর পশ্চিমে হাওড়া জেলার এই এলাকার পরিচিতি ছিল সাঁতরাগাছি গ্রাম হিসেবে। শোনা যায়, জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে প্রতিদিন রামের পুজো করতেন। জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী দাবি করতেন, রামের উপাসনা করার জন্য তাঁর এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। এরপর তিনি এক স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর শুরু হয় রাম-সীতার পুজো। লিখিত পুস্তিকায় দেখা গিয়েছে প্রায় তিনশো বছর আগে থেকে এই পুজো হয়ে আসছে। জমিদার বাড়ির রামের পুজোর খ্যাতি ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ায় এই এলাকারও নামকরণ হয়ে যায় রামরাজাতলা।
Advertisement
জমিদার অযোধ্যারামের পুজোর খ্যাতি ৩০০ বছর পরও অটুট থাকলেও বারোয়ারিভাবে রামের পুজো শুরু করাটা এত সহজ ছিল না। গ্রামে তখন ঘটা করে সরস্বতী পুজো করতেন গ্রামবাসীরা। সরস্বতী পুজোর অনুরাগীদের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে, তাঁরা রামের পুজোর শুরু হলে আপত্তি জানান। তাঁদের যুক্তি ছিল, গ্রামে বহুদিন ধরে সরস্বতী পুজো হয়ে আসছে, ফলে এই পুজো বন্ধ করা যাবে না। এছাড়াও রামের পুজো থেকে সরস্বতী পুজো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক। অনেক তর্কবিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হয় যে, রামের পুজো করা হবে, তবে সরস্বতীকে রাম ও সীতার উপরে রাখতে হবে। এছাড়াও সরস্বতী পুজোর দিনই রামের প্রতিমা নির্মাণের সূচনা হবে বাঁশ কাটা এবং প্রারম্ভিক পুজোর মধ্যে দিয়ে। এই বিষয়ে সকলে সহমত হওয়ার পরই অযোধ্যারাম গ্রামেরই বিশিষ্ট বাসিন্দা সৌমিক আদক চৌধুরীর বাড়ির কাছে রামের পুজো শুরু করেন। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত সরস্বতী পুজোর দিন ষষ্ঠীতলার নির্দিষ্ট বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটার পরে চৌধুরীপাড়ায় শিবমন্দিরে বাঁশ পুজোর মাধ্যমে রাম-সীতার মূর্তি গড়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়।
রাম নবমীর দিন এখানে ২২ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট লম্বা কাঠামোয় তৈরি সুবিশাল মাটির রাম-সীতা ও অন্যান্য মোট ২৬টি বিগ্রহের পুজো শুরু হয়। শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার গঙ্গায় নিরঞ্জন হয় রামের মূর্তি।তবে বছরের প্রতিদিন যাতে রাম-সীতার দর্শন পুণ্যার্থীরা করতে পারেন তার জন্য ঠাকুরের নতুন মন্দির তৈরি করে সেখানে মূর্তিস্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরের মাহাত্ম্যে দক্ষিণ পূর্ব রেল শাখায় স্টেশনের নামকরণও হয়েছে রামরাজাতলা।
শহরের কাছেই পর্যটকদের এক অন্যতম আকর্ষণীয় ‘ডেস্টিনেশন’ হয়ে উঠেছে রামরাজাতলার রাম-সীতার পুজো। ঐতিহ্যবাহী এই পুজোর আস্বাদ পেতে আগ্রহী পর্যটকরা, যাঁরা এখনও সেখানে পা রাখেননি, একদিনের জন্য অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন রামরাজাতলার রাম-সীতা মন্দিরে। মন্দির খোলা থাকে সকালে সাড়ে ন’টা থেকে রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত।
কীভাবে যেতে হবে এক ঝলক দেখে নেওয়া যায়— হাওড়া ময়দান থেকে ৫২ নম্বর বাস যাচ্ছে রামরাজাতলায়। হাওড়া রেলস্টেশন থেকে দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। হাওড়া স্টেশন থেকে রামরাজাতলা রেলস্টেশন, হাওড়া-খড়গপুর লাইন।
Advertisement



