বাংলা নিয়ে বিজেপি ভুল অঙ্ক কষছে : পার্থ চট্টোপাধ্যায়

তখনও জানা যায়নি বাংলা নিয়ে নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে নির্বাচন কমিশন। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে চাপানউতােরের রেশ অব্যাহত। মূর্তির প্রাণ-প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে। ঠিক সেই সময় এক অন্য মুডে পাওয়া গেল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথা রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।

Written by Debashis Das Kolkata | May 17, 2019 5:04 pm

পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Photo: IANS)

তখনও জানা যায়নি বাংলা নিয়ে নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে নির্বাচন কমিশন। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে চাপানউতােরের রেশ অব্যাহত। মূর্তির প্রাণ-প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে। ঠিক সেই সময় এক অন্য মুডে পাওয়া গেল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথা রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়-কে। বাংলার নির্বাচন নিয়ে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় তিনি খােলামেলা আলােচনা করলেন জেলার এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে, সাক্ষী এই সাংবাদিক। সেই আলােচনায় উঠে এল জঙ্গলমহল থেকে পাহাড়। তৃণমূলের প্লাস মাইনাস সবকিছুই।

৪২-এ ৪২ বর্তমান পরিস্থিতির উপরে দাঁড়িয়ে কি সম্ভব?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪২-এ ৪২ করার ডাক দিয়েছেন। বাংলার স্বার্থ, দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব সবচেয়ে বড় জরুরি। কেন্দ্রে যে সরকার গঠন হবে তার চাবিকাঠি থাকবে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে। তৃণমূল কংগ্রেসই পারে দেশের আমজনতার স্বার্থ রক্ষা করতে। ফলে ৪২-এর ডাক। মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তৃণমুলের পাশেই রয়েছে, আগামীতেও থাকবে।

বিজেপির পক্ষ থেকে একটা গেল গেল রব ভােলা হচ্ছে। বুথভিত্তিক সংগঠন যে দলের নেই, ২৩ আসন পাওয়ার দাবির কি কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে?

ওরা না পারে অঙ্ক কষতে, না পারে ইতিহাস, ভূগােল ঠিকভাবে জানতে। বাংলার ইতিহাস জানতে হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের গতি জানতে হবে। কিন্তু তা না করে বাংলা নিয়ে যা খুশি তাই বলছে। ইতিহাস, ভূগােল, অঙ্ক না জানার ফল এটা। ২৩ তাে দূরের কথা, যে দুটি আসন গতবার ছিল, এবার সেটাও থাকবে না।

ভারতী ঘােষের গাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার, দিলীপ ঘােষের আপ্তসহায়ক গ্রেফতার এক কোটি টাকা সমেত। কি বলবেন?

নােটবন্দির টাকাগুলাে গৃহবন্দি করে রেখেছে বিজেপি নেতারা। বিজেপি’র তহবিল বেড়েছে। সেই টাকা ছড়িয়ে বিজেপি জনমত নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করছে। এই দুই নেতার কাছ থেকে টাকা উদ্ধার, সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত করল।

প্রধানমন্ত্রী বারবার বাংলায় আসছেন। লােকে বলতে শুরু করেছে উনি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। কেন বাংলায় বারবার নরেন্দ্র মােদি? তবে কি বাংলায় বিজেপি’র কোনও সম্ভাবনা আছে?

উনি বুঝে গিয়েছেন দেশের আর অন্য কোনও জায়গায় গিয়ে প্রচার করার মতাে সুযােগ ওনার কাছে নেই। বিরােধীরা ঐক্যবদ্ধ। এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই লড়ছেন বিজেপিকে রুখতে। বাম-কংগ্রেস বিজেপি’র বন্ধু হয়ে গিয়েছে। সেকারণেই তৃণমূল কংগ্রেসকে দুর্বল করতে উনি বারবার আসছেন। বাংলার মাটি এবং মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। এখানকার সর্বস্তরের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই থাকবেন। কারণ বিপদে-আপদে তিনিই পাশে থাকেন। ফলে নরেন্দ্র মােদি যতবারই বাংলায় আসুন না কেন, বিজেপির কোনও লাভ হবে না। উল্টে মানুষ দেখছে তৃণমূলকে আটকাতে স্বয়ং আসরে নেমেছেন নরেন্দ্র মােদি। যিনি এখন বিজেপি দলের নম্বর ওয়ান। কিন্তু তিনিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পরাস্ত হবেন।

নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা কেমন এরাজ্যে?

দুটোই কন্ট্রোল করছে বিজেপি এবং আরএসএসের লােকজন। প্রশ্ন উঠছে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে। মানুষ যাতে বুথমুখী হয়ে ভােটদান করেন সেই কাজটা সুনিশ্চিত করাই ছিল কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাজ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ একটি দলকে ভােট দেওয়ার কথা বলছে। নির্বাচন কমিশনের রিমােৰ্ট কন্ট্রোল অন্য কোথাও থেকে পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা বজায় না রাখলে কমিশনের প্রতিও মানুষ আস্থা হারাবে। দেশের সমস্ত সাংবিধানিক পদগুলিকে মােদি এবং অমিত শাহ নিজেদের মতাে করে চালাচ্ছেন, যা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়। মানুষ সবকিছু দেখছে ইভিএমে এর জবাব দেওয়া শুরু করেছে। ১৯ মে সেই জবাব দেওয়ার কাজ শেষ হবে।

প্রশ্ন: কলকাতায় ভােট ঢুকল। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেসব কাউন্সিলর তাঁদের ওয়ার্ডে লিড দিতে পারবেন না, তাঁরা আগামীতে টিকিট পাবেন না। এই নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য উঠে আসছে। লােকমুখে খবর আসছে বেশ কিছু জায়গায় কাউন্সিলর-বিরােধী গােষ্ঠীতে যারা রয়েছেন, তারা কাউন্সিলরদেরকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। দলের সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। আমাদের সবাই এক পরিবারের মতাে। প্রার্থীকে জয়ী করানাের দায়িত্ব একা কাউন্সিলরের নয়, দলের অন্য অংশকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। কাউন্সিলরের বিরােধিতা করা মানে, আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে উঠেছে, তার বিরােধিতা করা। সংঘবদ্ধভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। দলের কোনও অংশ যদি কাউন্সিলরের ওপর দােষ চাপিয়ে দায় এড়াতে চায়, সেটাও দল খতিয়ে দেখবে। সবাই এক হয়ে কাজ করে প্রার্থীকে জয়ী করবে, এটাই দলের বার্তা।

সাতসকালে বেরিয়ে রাত্রি দুটোর সময় বাড়ি ফিরছেন। মােবাইল বেজেই চলেছে। এত পরিশ্রম। ক্লান্তি লাগছে না?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিকদের কাছে ক্লান্তির কোনও জায়গা নেই। একজন কো-র্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছি। জঙ্গলমহলে যাচ্ছি। আবার নদিয়ায়ও। সেই সঙ্গে কলকাতায় বসে সংযােগ রক্ষা করছি। কোথাও কোনও ধরনের খামতি থাকলে তা এত মেটানাের জন্য নির্দেশ দিচ্ছি দলীয় নেতাদের। প্রচণ্ড গরম, কিন্তু সবাই মাঠে রয়েছেন। ফলে ক্লান্তির কোনও জায়গা নেই। সারা বছর ধরে মানুষের পাশে থাকার অভ্যাস রয়েছে। সেকারণেই কাজের চাপ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর মধ্যেও এক অন্য ধরনের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই কাজ করছি। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের পরিশ্রম কিছুই নয়।

মুকুল রায় চলে যাওয়ায় আপনাদের ক্ষতি হয়েছে?

এ নিয়ে বেশি বলব না। শুধু এটুকুই বলব, দলটা সংঘবদ্ধ হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে ঐক্য হয়েছে, যা হয়েছে ভালাে হয়েছে।

কমিশনে দাবি-দাওয়া নিয়ে ধরনা দেওয়া থেকে শুরু করে পুরাে বিজেপি’র মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছেন মুকুল। তৃণমূলে মুকুলের অভাব বােধ করছেন না?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তৃণমূল কংগ্রেসে প্রথম এবং শেষ কথা। তাঁর ছবি ছাড়া দলের কেউ জিততে পারেন না। ফলে মুকুল রায় নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালাে। একটা কথা বলতে পারি, মুকুল রায় চলে যাওয়ায় তৃণমূল বেঁচেছে।

২০১৪-এর চেয়ে ২০১৯ লােকসভা ভােট আপনার চোখে ঠিক কেমন?

২০১৪ সালে দেশজুড়ে মােদির মিথ্যাচারকে অনেকে সত্যি বলে মনে করেছিল। কিন্তু পাঁচ বছরে আচ্ছে দিন আসেনি। মানুষ তার অভিজ্ঞতায় সবকিছু উপলব্ধি করেছে। আচ্ছে দিনের বদলে বিপন্নতা বেড়েছে, সর্বক্ষেত্রে। সেকারণে ২০১৯-এর নির্বাচন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের আমজনতা নরেন্দ্র মােদিকে মসনদে ফিরতে না দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। তারই পরীক্ষা চলছে। ইতিমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষ ইভিএমে তাদের রায় দিয়ে দিয়েছে। বাকি শেষ দফার ভােটেও মােদি-বিরােধিতা তুঙ্গে যাবে, এটা হলফ করে বলতে পারি। ফলে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা, গণতন্ত্রকে রক্ষা, ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের স্বার্থে দেশের সােচ্চার হওয়া মানুষজন মােদিকে এক্সপায়ারি প্রাইমমিনিস্টার বানিয়েই দিয়েছে। ২৩ মে মােদি এবং অমিত শাহদের গুজরাতে ফিরে যেতে হবে।

ঝাড়গ্রাম এবং নদিয়া, এই দুটি জেলার ওপর বিশেষ দায়িত্ব ছিল আপনার ওপর। ফল কেমন হবে?

ঝাড়গ্রাম লােকসভা আসনের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর আস্থা রেখেছেন। নদিয়ার দুটি আসনেও আমরা জয়ী হব। বিজেপি সিপিএমের সঙ্গে অনেক বােঝাপড়া করেও আমাদেরকে রুখতে পারেনি। ওদের অপচেষ্টা মানুষ মেনে নেয়নি।

ঝাড়গ্রামে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ফল আশানুরূপ হয়নি। তারপরও ভালাে ফল করা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?

জঙ্গলমহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের কথা জনগণের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছানাের মধ্যে খামতি ছিল। সেই কাজটা সুনিশ্চিত ভাবে করা যাচ্ছিল না। সেই কাজটা অনেকটাই করা গিয়েছে। উন্নয়ন দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করা গিয়েছে। সহজ সরল আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন অপপ্রচার করছিল বাম-বিজেপি’র নেতারা। বিজেপি’র অর্থ ব্যয় করে জনগণকে নিজেদের দিকে আনার জন্য চেষ্টা করছিল। কিন্তু মানুষ অর্থের প্রলােভনে পা দেয়নি। সেই সঙ্গে দলের বেশ কিছু জায়গায় সংগঠনের দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে। নিচুস্তরে নেতৃত্বের একাংশের প্রতি ক্ষোভও ছিল। নতুন নেতৃত্ব তুলে আনতে হয়েছে ওখানকার মানুষদের মধ্যে থেকে। বাম-কংগ্রেস-বিজেপি’র সঙ্গে মানুষ থাকতে চাইছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অগাধ আস্থা এখানকার মানুষজনের ছিল। সেই আস্থার ওপর ভর করেই ঝাড়গ্রাম শুধু নয়, জঙ্গলমহলে ভালাে ফল করবে তৃণমুল।

বামেরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

বামেদের ঘুরে দাঁড়ানাের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। বামেদের ভোট বিজেপি’তে যাচ্ছে। কোমর ভেঙে গেলে কি আর নাচা যায় বামেদের অবস্থা ঠিক তাই। ৩৪ বছর বাংলার অপশাসন আমজনতার অজানা নয়। ৩৪ বছর যারা রাজ্যটাকে শেষ করে দিল, তাদের সুশাসনের বার্তা মানুষ গ্রহণ করছে না। সে কারণে এরাজ্যে বামেদের কোনও সম্ভাবনা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও দেখতে পাচ্ছি না।

বিরােধীরা বিভিন্ন লােকসভা আসনে তৃণমূলকে হারাতে গােপনে কি একজোট হচ্ছে?

তৃণমূল কংগ্রেস সেই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটকানাের জন্য বিরােধীদের চক্রান্ত চলছে বিভিন্ন ভাবে। বাম-কংগ্রেস এজেটি হওয়া ছাড়াও বেশ কিছু জায়গায় বামেদের ভােট বিজেপিকে ট্রান্সফার করা হচ্ছে। আসলে এর সবকিছু হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রুখতে। কিছু লাভ নেই। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন বাম-কংগ্রেসকে মানুষ শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। ২০১৯-এর লােকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ হলে বড় ধরনের শিক্ষা পাবে এরাজ্যের বিরােধীরা।