বাংলায় বিধানসভা ভোট আসন্ন। তার আগেই আজ, সোমবার ঘোষণা হয়ে গেল বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া। সোমবার বিকেলে দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে দেশের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক জ্ঞানেশ কুমার জানান, মঙ্গলবার থেকেই সারা দেশে শুরু হচ্ছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজ। বাংলা-সহ ১২টি রাজ্যে হবে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর। তাই সোমবার রাতেই ১২টা থেকেই বাংলা-সহ ১২টি রাজ্যে ‘ফ্রিজ’ করা হচ্ছে ভোটার তালিকা।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বলেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পুরনো তালিকা সোমবার রাত ১২টা থেকেই স্থগিত বা ফ্রিজ করা হচ্ছে। যাতে আগামী সংশোধন পর্যায়ে নতুন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা যায়।‘ গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দেশের সবক’টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকদের নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক হয়।
Advertisement
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার এবং দুই নির্বাচন কমিশনার, এসএস সান্ধু ও বিবেক যোশী বৈঠকে উপস্থিতি ছিলেন। এসআইআর শুরুর আগে এই দ্বিতীয় প্রস্তুতি বৈঠকই ছিল শেষ বৈঠক। বিহারে এসআইআর-পর্ব শেষে বিধানসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এর পরে আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল, তামিলনাড়ু এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরিতে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা।
Advertisement
এদিন কমিশনের তরফে জানানো হয়, দ্বিতীয় পর্বে এসআইআর হবে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, গোয়া, গুজরাত, কেরল, লাক্ষাদ্বীপ, মধ্যপ্রদেশ, পুদুচেরি এবং আন্দামান নিকোবরে। জ্ঞানেশ কুমার আরও জানিয়েছেন, বিরাট কর্মযজ্ঞে আন্দামান ও নিকোবর, বাংলা, ছত্তিশগড়, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, পুদুচেরিতে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি বিএলও কাজে যোগ দেবেন।
এদিন কমিশন জানিয়েছে, এসআইআর –এর জন্য মঙ্গলবার থেকেই শুরু হবে এনুমেরেশন ফর্ম ছাপা। একই দিনে শুরু হবে বিএলওদের প্রশিক্ষণের কাজ। যা চলবে আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনুমেরেশন ফর্ম দেওয়া হবে। কেউ রাজ্যের বাইরে গেলে বা প্রবাসীরাও অনলাইনে ফর্ম পূরণ করতে পারবেন। অন্যদিকে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে ৯ ডিসেম্বর। এই তালিকা নিয়ে অভিযোগ থাকলে ৯ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে হবে। পরবর্তী পর্যায়ে ৯ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে অভিযোগ শোনা এবং খতিয়ে দেখার কাজ। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে ৭ ফেব্রুয়ারি।
জ্ঞানেশ কুমার জানিয়েছেন, ২০০৩ সালের এসআইআর-এ যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের আর কোনও কাগজ দিতে হবে না। নিজের নাম না থাকলেও যদি বাবা-মায়ের নাম থাকে, তা হলে আর কাগজ লাগবে না। কমিশনের সাইটে গিয়ে এই ‘ম্যাচিং’ ভোটারেরা নিজেরাই করতে পারবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। বিহারে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনীর কাজ ভালো হয়েছে বলেও সাংবাদিক বৈঠকে জানান মুখ্য নির্বাচন কমিশনার।
কমিশন জানিয়েছে, বুথ লেভেল অফিসার তিনবার করে প্রত্যেকের বাড়িতে যাবেন। প্রথমবার যদি ভোটার বাড়িতে না থাকেন, তাহলে দ্বিতীয়বার যাবেন। তারপরও না পেলে তৃতীয়বার যাবেন। এছাড়াও, যদি ভোটারের মৃত্যু হয়, বা স্থায়ীভাবে বাইরে চলে যান বা একাধিক জায়গায় নাম নথিভুক্ত থাকে তাহলে তাঁরা ফর্ম ফিল আপ করতে পারবেন না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সাংবাদিক বৈঠকে স্পষ্ট করে দেন, যাঁদের ঠিকানা, পোলিং স্টেশন বদল হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই নতুন এপিক নম্বর পাবেন। বিহারের ক্ষেত্রেও তাদের সবাইকে নতুন এপিক নম্বর দেওয়া হয়েছে। গোটা দেশেই এই নিয়মই কার্যকর হবে। বিশেষ নিবিড় সংশোধন আবহে এই বিষয়টি নিয়ে সংশয় উঠেছিল, যাদের ঠিকানার বদল এসেছে, তাদের কী হবে? কমিশন সূত্রে খবর, এরকম প্রচুর ঠিকানা বদলের আবেদন জমা পড়েছে। সেক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্ট করে দিয়েছে ঠিকানা বদল হলে, পোলিং স্টেশন পরিবর্তন হলে নতুন এপিক নম্বর তাঁরা প্রত্যেকেই পাবেন।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বললেন, ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন-এর সময় আধিকারিকরা সবার প্রথমে ‘এনুমারেশন ফর্ম’ প্রিন্ট করবে। তারপর ফর্ম বিএলও-রা ভোটারদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। সেই ‘এনুমারেশন ফর্ম’-র ভিত্তিতে ভোটাররা নিজেদের নাম যাচাই করবেন। শেষে, এসআইআর ভোটার তালিকায় কোনও ভোটারের নাম বা তার বাবা-মায়ের নাম থাকলে দিতে হবে না কোনও কাগজ।‘ রয়েছে অনলাইনের সুবিধা, বিশেষ নিবিড় সংশোধন-র আবেদন করা যাবে অনলাইনেই। যারা কোনও কারণে বাড়িতে থাকবেন না বা কর্মসূত্রে অন্য রাজ্যে থাকেন। তারা নিজেদের রাজ্যে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন।
এসআইআর নিয়ে বিজেপিকে প্রথম থেকেই নিশানা করছে বিরোধী দলগুলি। বাংলায় তৃণমূল, বিহারে আরজেডি, উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি থেকে শুরু করে তামিলনাড়ুর ডিএমকে এসআইআরের বিরোধিতা করেছে। এর আগে বিহারে এসআইএর নিয়ে তুমুল ঝামেলা দেখা গিয়েছে বিজেপি ও বিরোধীদের মধ্যে। বিহারে এসআইআর-এর পরে তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল ৬৫ লক্ষ নাম।
এসআইআর-এর পদ্ধতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও চলছে। বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করার অভিযোগও তুলেছে বিরোধীরা। যদিও সোমবারের সাংবাদিক বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্ট জানিয়েছেন, বিহারে এসআইআর- এর বিরোধিতা করে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। বিহারে ঠিকঠাক ভাবে এসআইআর হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশন।
চলতি মাসের শুরুতেই বাংলায় এসআইআর নিয়ে সরব হন তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে তৃণমূলের বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠান থেকে কুণাল বলেছিলেন, ‘এসআইআর নিয়ে এককাট্টা থাকুন। মাথার উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। তৃণমূল পরিবার সঙ্গে আছে। একজন আসল ভোটারের নাম যদি ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায় তাহলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এক লক্ষ লোক নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের অফিস ঘেরাও করা হবে।‘ সোমবার ফের সাধারণ নাগরিকের হেনস্থা হলে দিল্লিতে গিয়ে কমিশনের অফিস ঘেরাও করার হুমকি দিলেন কুণাল।
এই আবহেই সোমবার সারা দেশের জন্য এসআইআর ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন। বিহারের ক্ষেত্রে লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করা হয়েছে। যোগ্য ভোটারদের নির্বাচনের এক্তিয়ারে নিয়ে আসা এবং অযোগ্যদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া এসআইআর-এর মূল লক্ষ্য বলে সাংবাদিক বৈঠকে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। দীর্ঘ ২ দশক পরে ভারতে এসআইআর হচ্ছে। শেষবার এসআইআর হয়েছিল ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে।
Advertisement



