পুরীতে রথযাত্রার দিন পদপিষ্ট হয়ে ৫০০ জন জখম হয়েছিলেন। রবিবার ভোরে ফের পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে পুরীতে। এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। জখম হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। যদিও ওড়িশার আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, জখমের সংখ্যা ৬। সূত্রের খবর, গুন্ডিচা মন্দিরের সামনে রবিবার ভোর ৪টে থেকে ৫টার মধ্যে ব্যাপক ভিড় হয়েছিল। সেই ভিড় সামাল দিতে পারেনি পুলিশ। জগন্নাথ দেব, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে সেই সময় গুণ্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করানো হচ্ছিল। তখনই রথের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েন বহু পুণ্যার্থী। এর ফলে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে।
পুরী জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান দৈতাপতি রামকৃষ্ণ দাস মহাপাত্রমৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, ‘কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ঘটনাটি বেদনাদায়ক। এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। প্রশাসনের কাছে আমার আবেদন, ভক্তদের সুরক্ষার কথা ভেবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও মজবুত করা হোক।’
Advertisement
পুলিশ জানিয়েছে, রথযাত্রার শেষে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করানোর যে রীতি রয়েছে, সেটা দেখতেই ব্যাপক ভিড় হয়। পুরীর মূল মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। এই পথ পেরোতে গিয়ে বার বার আটকে যায় নন্দীঘোষ, তালধ্বজ, দর্পদলন – তিনটি রথ। এই তিন রথে ছিল জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার বিগ্রহ। শুক্রবার রথ গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। শনিবার রথ গুণ্ডিচা মন্দিরে পৌঁছলেও জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রাকে নামানো যায়নি। রাতভর তিনটি রথ ঘিরে বহু ভক্ত ভিড় করেছিলেন। একটা সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
Advertisement
ভোর সাড়ে ৪টে নাগাদ রথগুলি মন্দিরের দিকে এগোতে শুরু করতেই ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ভিড়ের মধ্যে পড়ে যান কিছু লোক। সেই সময় পদপিষ্ট হয়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে দু’জন মহিলা— প্রভাতী দাস এবং বাসন্তী সাহু। অন্য জন সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধ প্রেমাকান্ত মোহান্তি। ওড়িশার খুরদা জেলার বাসিন্দা ওই তিনজন রথযাত্রা উপলক্ষে এসেছিলেন পুরীতে। এই ঘটনায় বেশ কয়েক জন আহতও হন। তাঁদের উদ্ধার করে তড়িঘড়ি হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওড়িশার আইনমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ হরিচন্দন জানান, তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার উপর নজর রাখা হচ্ছে। গাফিলতির অভিযোগ মিললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ভোর ৪টার নাগাদ চরামালা কাঠ বোঝাই দুটি ট্রাক সারধাবালি এলাকায় প্রবেশ করে। দুটি ট্রাকের অপ্রত্যাশিত আগমনের ফলে ভক্তদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যার ফলে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। ভক্তদের থেকে অন্তত দু’কিলোমিটার দূরে অ্যাম্বুল্যান্স ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। নিহতদের একজনের স্বামীর অভিযোগ, ‘ঘটনাটি ঘটার সময় দমকল, উদ্ধারকারী দল, হাসপাতাল কোনও পক্ষের কোনও কর্মকর্তা হাজির ছিলেন না সেখানে, বারবার ডেকেও সাড়া মেলেনি বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।’
পুরীর এসপি বিনীত আগরওয়াল বলেন, ‘বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে দর্শন উপভোগ করছে। ঘটনাস্থলে আমাদের পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত চলছে।’ পুরীর জেলাশাসক সিদ্ধার্থ শঙ্কর সোয়াইন বলেন, ‘ভিড়ে ঠেলাঠেলিতে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া চলছে, রিপোর্ট আসার পরই মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে। ৯ জন আহত হয়েছেন। আহতদের প্রাথমিকভাবে চিকিৎসার জন্য জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’ পুরী জেলা সদর হাসপাতালের সিডিএমও অক্ষয় সৎপথী বলেন, ‘গুণ্ডিচা মন্দিরের রথের সামনে ভক্তদের বিশাল ভিড়ে জমে যায়। পদপিষ্টের মতো ঘটনা ঘটে। ১০-১১ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা চলছে।’ মৃত্যু নিয়ে কোনও কথা বলেননি তিনি।
আহত এক তরুণী বলেন, ‘সুভদ্রার রথের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আচমকা ঠেলাঠেলি শুরু হয়। বাঁ-পায়ে চোট লেগেছে। পরিবারের সদস্যরা সকলেই আহত।’ এরপরই সরকারের বিরুদ্ধে অব্যবস্থার অভিযোগ তুলেছেন তরুণী। তাঁর অভিযোগ, সেখানে কোনও সরকারি আধিকারিক, পুলিশ-প্রশাসন, এমনকী কোনও অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা ছিল না। ওড়িশার আইনমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ হরিচন্দন বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ জানতে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাঁদের গাফিলতিতে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, তাঁদের কড়া শাস্তি পেতে হবে। ভালো আবহাওয়া থাকায় অন্যান্য বছরের থেকে দেড়গুণ বেশি মানুষ এবার পুরীতে এসেছেন। তাই ভিড় নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা হয়েছে।’
পদপিষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে অপ্রত্যাশিত ভিড়ের কথাই বলেছে ওড়িশা সরকার। তবু স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রীমন্দিরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে দাবি, রথ সংলগ্ন ঘেরাটোপে বাড়তি লোকজনকে ঢোকার ছাড়পত্র দেওয়ার জন্যই ভুগতে হয়েছে এত মানুষকে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের হঠকারিতার ফলেই এত জনের জীবন নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রথযাত্রার সময় ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দর্শনের জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত পুরীতে আসেন। এই তীর্থযাত্রা দেশের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। পুরী জগন্নাথ মন্দির থেকে ভগবানদের বের করে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রী গুণ্ডিচা মন্দিরে, যেখানে তাঁরা কয়েক দিন অবস্থান করেন। এবারের রথযাত্রায় পুরীতে ১০ লক্ষেরও বেশি পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছিল। এতটাই ভিড় হয়েছিল যে রথের দিন, বলরাম ও সুভদ্রার রথ সামান্য এগোতে পারলেও, জগন্নাথের রথ এগোনো যায়নি। মন্দির ছেড়েই বেরতে পারেনি নন্দীঘোষ। রথযাত্রার দিনে ভিড় এবং ধাক্কাধাক্কিতে বহু ভক্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল।
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাজি দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লেখেন, ‘আমি এবং আমার সরকার সকল জগন্নাথ ভক্তের কাছে বিনয়ীভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন। মহাপ্রভু জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন মৃতদের পরিবারের সদস্যদের এই গভীর শোক সহ্য করার শক্তি দেন। এই অবহেলা অমার্জনীয়। নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি অবিলম্বে তদন্ত করা হবে এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।’
এদিকে এই ঘটনায় ওড়িশা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেডি নেতা নবীন পট্টনায়েক। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লেখেন, ‘রথযাত্রার দিন ভিড় নিয়ন্ত্রণে ভয়াবহ ব্যর্থতার মাত্র একদিন পর আজকের পদদলিত হওয়ার ঘটনা, যা শত শত আহতের ঘটনায়, ভক্তদের জন্য শান্তিপূর্ণ উৎসব নিশ্চিত করতে সরকারের স্পষ্ট অক্ষমতা প্রকাশ করে। ভিড় সামলানোর জন্য কোনও পর্যাপ্ত সরকারি ব্যবস্থাপনা ছিল না, যা কর্তব্যে অবহেলার দিকটি তুলে ধরে। রথযাত্রার দিন নন্দীঘোষ রথ টানতে অযৌক্তিক দেরিকে মহাপ্রভুর ইচ্ছা বলে অভিহিত করা হয়েছিল, যা প্রশাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ঢেকে রাখার এক আশ্চর্যজনক অজুহাত।’
Advertisement



