• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

জুনোসিস আসলে কী ধরনের অসুখ? এর থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় কী?

উট, ছাগল, খরগোশ ইত্যাদি প্রাণীর শরীরে প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস ছিল। পরবর্তীতে এডিস ইজিপ্টাই মশা সেই প্রাণীগুলিকে কামড়ানোর ফলে মশার শরীরে এই ভাইরাসটি চলে আসে। এরপর সংক্রামিত এডিস ইজিপ্টাই মশা কোনও মানুষকে কামড়ালে তাঁর শরীরে ডেঙ্গু জীবাণু প্রবেশ করে।

প্রতীকী গ্রাফিক্স চিত্র

মানুষের শরীরে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাস বাসা বাধে, যা অন্য কোনও মানুষের শরীর থেকে আসেনি, এসেছে অন্য কোনও প্রাণীর শরীর থেকে। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাস মানবদেহকে আক্রমণ করলে তাকে জুনোসিস ডিজিস বলে।

জানা গিয়েছে, পশু, পাখি, পতঙ্গ বা সরীসৃপের শরীর থেকে বিভিন্ন উপায়ে এই ধরনের রোগ জীবাণু মানুষের শরীরে সংক্রামিত হয়ে থাকে। সারা পৃথিবীতে যত ধরনের সংক্রামক রোগ রয়েছে, তার মধ্যে ৬০ শতাংশ রোগই কোনও না কোনও সময়ে অন্যান্য প্রাণীর শরীর থেকেই মানুষের শরীরে এসেছিল।

Advertisement

যদিও প্রাণীটির দেহে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে এক প্রকার ইমিউনিটি থাকে। ফলে তাদের কোনও ক্ষতি হয়না। কিন্তু কোনওক্রমে একবার এই জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করলেই সমস্যা দেখা দেয়। অচেনা জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে অসুখ জটিল আকার ধারণ করে। নোভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনই হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত এই জীবাণুর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছিল না। ফলে দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শেষ ২০ বছরে আবিষ্কৃত হওয়া সংক্রামক রোগগুলির সিংহভাগই জুনোসিস। তাই গোটা পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে জুনোসিস অন্যতম মাথা ব্যথার কারণ।

Advertisement

এই রোগ মানুষের শরীরে কীভাবে ছড়ায়?
যে প্রাণীর দেহে জীবাণুটি থাকে, তাকে বলে উৎস বা রিজর্ভর। এই উৎস প্রাণী থেকে সরাসরি রোগ জীবাণু মানুষের শরীরে পৌঁছে যেতে পারে। যেমন– র্যাবিস ভাইরাসকে এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর দেহে র্যাবিস ভাইরাস থাকে। এবার সেই প্রাণী মানুষকে কামড়ালে মানুষের শরীরে পৌঁছে যায় র্যাবিস। এই বিশেষ ভাইরাসটির ক্ষেত্রে প্রতিবার সরাসরি রিজর্ভর-এর শরীর থেকেই মানুষের দেহে জীবাণু পৌঁছয়।

আবার অনেক সময় জীবাণু প্রাথমিক পর্যায়ে রিজর্ভর থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে পৌঁছয়। তারপর মানুষ থেকে মানুষে সেই জীবাণু ছড়াতে থাকে। এইচআইভি রোগটি এমনই একটি রোগ। প্রাথমিকভাবে বাঁদর, শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল এইচআইভি। আবার আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমেও ভাইরাসটি অন্য মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

অনেক সময় দেখা গিয়েছে, রিজর্ভর থেকে বাহকের (ভেক্টর) মাধ্যমে জীবাণু মানুষের শরীরে পৌঁছে যায়। যেমন– উদাহরণ হিসেবে ডেঙ্গুর কথা বলা যেতে পারে। উট, ছাগল, খরগোশ ইত্যাদি প্রাণীর শরীরে প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস ছিল। পরবর্তীতে এডিস ইজিপ্টাই মশা সেই প্রাণীগুলিকে কামড়ানোর ফলে মশার শরীরে এই ভাইরাসটি চলে আসে। এরপর সংক্রামিত এডিস ইজিপ্টাই মশা কোনও মানুষকে কামড়ালে তাঁর শরীরে ডেঙ্গু জীবাণু প্রবেশ করে। এভাবে পরবর্তী সময়ে মশার মাধ্যমে সংক্রামিত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষের দেহে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে।

জুনোসিস বৃদ্ধির কারণ
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্যাপক হারে বৃক্ষসংহার করা হয়েছে। এভাবে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করা হয়েছে। ফলে মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর সংস্পর্শে আসার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে।
২. খুব দ্রুত গোটা পৃথিবীতে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। ফলে মশা সহ অন্যান্য রোগ বাহকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের পেট ভরাতে প্রাণিজ খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে অসংখ্য মানুষ প্রাণিজ খাদ্যদ্রব্যের পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এই মানুষগুলি সরাসরি বিভিন্ন প্রাণীর সংস্পর্শে এসে নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
৪. বিশ্বের পরিবহণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন বিমানে চেপে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়া সম্ভব।
তাই খুব কম সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট জীবাণুতে আক্রান্ত ব্যক্তি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছে সেখানকার মানুষকে সংক্রামিত করছে। আবার অনেকসময় বিমানে চেপে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে সংক্রামিত মশা, মাছির মতো রোগের বাহকও।

কীভাবে জুনোসিস প্রতিরোধ করবেন?
১. প্রকৃতির প্রতি মানুষকে আরও যত্নবান হতে হবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন রোখার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য বৃক্ষরোপণ বাড়াতে হবে।
২. মশা, মাছির মতো রোগের বাহকগুলির বাড়বাড়ন্ত কমাতে হবে।
৩. প্রত্যেককেই রোগ সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৪. নিয়মিত হাত ধোওয়া, অকারণে চোখ-নাকে-মুখে হাত না দেওয়া, হাঁচি-কাশি হলে মুখে রুমাল দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৫. আরও গবেষণা চালাতে হবে, যাতে নতুন ওষুধ ও টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়।

Advertisement