• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

গত দেড় দশকে স্থূলতার হার, প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে দ্বিগুনের বেশি এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে চারগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। কী এর প্রতিকার, জানাচ্ছেন ড. পুলক কুমার জানা, এম ডি (কমিউনিটি মেডিসিন), অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, তাম্রলিপ্ত গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ।

প্রতীকী চিত্র

গবেষণা বলছে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জন স্থূলতায় আক্রান্ত ছিল। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলতার হার দ্বিগুনের বেশি হয়েছে এবং কিশোরদের স্থূলতা চারগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। আশঙ্কার বিষয়টি হল, ২০৩০ সালের মধ্যে স্থূলতার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ, বছরে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছতে পারে। ২০৬০ সালের মধ্যে তা ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সময়ে বহু মানুষের মধ্যেই রয়েছে স্থূলতার প্রবণতা। জেনে নেওয়া যাক বিষদে।

স্থূলতা বা ওবিসিটি কী ?
স্থূলতা, শরীরের অতিরিক্ত চর্বির পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয়, যেখানে বিশেষভাবে চর্বির বিতরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। পেটের চারপাশে চর্বি জমা হওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তুলনায় নিতম্বের চারপাশের চর্বি, বৃহত্তর কোমরের পরিধি যা পেটের চর্বির ইঙ্গিত দেয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ হিসাবে স্বীকৃত।

Advertisement

সাধারণত, শরীরের ওজন সূচক (BMI) ১৮.৫ থেকে ২৫ পর্যন্ত স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। তবে, এশীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১৮.৫ থেকে ২৩ BMI পরিসীমা সুপারিশ করা হয়। এর কারণ এশীয়দের কম BMI স্তরেও শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে, যা তাদের দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

Advertisement

কীভাবে স্থূলতার পরিমাপ করা হয়?
প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলতা নির্ণয়ের জন্য ব্যক্তির ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ করে BMI গণনা করা হয়। সূত্রটি হল- ওজন (কেজি) ÷ উচ্চতা (মিটার স্কোয়ার)। কেন্দ্রীয় এবং ট্রাঙ্কাল স্থূলতা নির্ণয়ের জন্য কোমরের পরিধি ও কোমর-নিতম্ব অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে, পুরুষদের জন্য কোমর-নিতম্ব অনুপাত ০.৯ এবং নারীদের জন্য ০.৮-এর বেশি হলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, পুরুষদের জন্য ৯০ সেমি এবং নারীদের জন্য ৮০ সেমি কোমরের পরিধি, দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, কেন্দ্রীয় স্থূলতা দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রবণতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, বিশেষত মেটাবলিক সিনড্রোমের সঙ্গে। মেটাবলিক সিনড্রোম তখনই বিদ্যমান থাকে যখন নিম্নলিখিত পাঁচটি মানদণ্ডের মধ্যে অন্তত তিনটি পূরণ হয়।
কোমরের পরিধি ৪০ ইঞ্চির বেশি (পুরুষদের ক্ষেত্রে) বা ৩৫ ইঞ্চির বেশি (মহিলাদের ক্ষেত্রে)

রক্তচাপ ১৩০/৮৫ mmHg-এর বেশি
উপবাসের ট্রাইগ্লিসারাইড (TG) স্তর ১৫০ mg/dl-এর বেশি
উপবাসের উচ্চ-ঘনত্বের লিপোপ্রোটিন অর্থাৎ HDL কোলেস্টেরলের স্তর ৪০ mg/dl-এর কম (পুরুষদের ক্ষেত্রে) এবং ৫০ mg/dl-এর কম (মহিলাদের ক্ষেত্রে)

উপবাসের রক্তে শর্করার স্তর ১০০ mg/dl-এর বেশি
এটি মেটাবলিক সিনড্রোমের একটি গুরুত্ব পূর্ণনির্ণায়ক, যা বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

স্থূলতার কারণ কী ?
স্থূলতা মূলত শক্তি-গ্রহণ (খাদ্য থেকে) এবং শক্তি-ব্যয়ের (শারীরিক কার্যক্রম থেকে) মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়। প্রতিদিন আমরা যে-ক্যালোরি গ্রহণ করি, তা কিলো ক্যালোরি (kcal) এককে পরিমাপ করা হয়, যেখানে ১ কেজি = ৭৫০০ ক্যালোরি। যদি একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ২৬২০ ক্যালোরি গ্রহণ করেন এবং তার দৈনিক প্রয়োজন ২৩২০ ক্যালোরি হয়- তবে প্রতিদিন ৩০০ অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করলে, ২৫ দিনে ১ কেজি ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে।

স্থূলতা সাধারণত বহুমুখী কারণ দ্বারা সৃষ্ট হয়। যেমন—অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মানসিক-সামাজিক কারণ এবং জিনগত কারণ। কিছু ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট কারণ থাকে যেমন— ঔষধ, রোগ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণেও স্থূলতা দেখা দিতে পারে।
বিশেষত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে অপুষ্টির দ্বৈত সমস্যা রয়েছে। একদিকে, শিশুদের অপুষ্টির ঝুঁকি থাকে, আবার অন্যদিকে, কম খরচে উচ্চ ক্যালোরি-যুক্ত, উচ্চ চর্বি ও উচ্চ চিনি-যুক্ত খাবারের কারণে স্থূলতার হার বাড়ছে।

স্থূলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত রোগগুলি কী ?
স্থূলতা বেশ কিছু দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য প্রধান ঝুঁকির কারণ। যার মধ্যে রয়েছে—
টাইপ ২ ডায়াবেটিস
উচ্চরক্তচাপ এবং কার্ডিও ভাসকুলার রোগ
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ
গলস্টোন
হাড় ও অস্থি সংক্রান্ত সমস্যা (অস্টিওআর্থ্রাইটিস)
মানসিক ও সামাজিক সমস্যা
কিছু বিশেষ ক্যান্সার যেমন—স্তন, ডিম্বাশয়, প্রোস্টেট, লিভার, কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি

শিশুদের ক্ষেত্রে স্থূলতা কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে ?
শৈশবে স্থূলতা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। স্থূল শিশুরা সাধারণত শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়।

স্থূলতা কমানোর উপায় ও প্রতিরোধ কী?
স্থূলতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে—
গর্ভধারণের পূর্ববর্তী সময় থেকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং স্থূলতা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা উচিত
গর্ভধারণের আগে মায়ের স্বাস্থ্যকর ওজন নিশ্চিত করা
পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ এবং যথাযথ পুষ্টি সরবরাহ করা
শারীরিক কার্যক্রম বজায় রাখা
ধূমপান, অ্যালকোহল ও অন্যান্য ক্ষতিকর অভ্যাস এড়ানো
জন্মের পর প্রথম ৬ মাস একমাত্র মাতৃদুগ্ধ পান করানো এবং ২৪ মাস বা তার বেশি সময় ধরে স্তন্য পান চালিয়ে যাওয়া।
এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং পরবর্তী জীবনে স্থূলতা ও সংশ্লিষ্ট রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

এছাড়া সাধারণভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। চর্বি, পরিশোধিত শর্করা (চিনি) ও উচ্চ ক্যালোরি-যুক্ত খাবার গ্রহণ কমিয়ে, জটিল শর্করা ও আঁশ-যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। এগুলি রক্তে গ্লুকোজ, কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। প্রচুর শাক সবজি ও ফল খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করে।

সপ্তাহে বেশির ভাগ দিন অন্তত ৬০ মিনিট মাঝারি বা দ্রুত হাঁটা (৫-৬ কিমি/ঘণ্টা), সাইকেল চালানো (১৬ কিমি/ঘণ্টা), নৃত্য, যোগব্যায়াম, বাগান করা, শিশুদের সঙ্গে খেলা বা তীব্র গতিতে দৌড়নো (৭কিমি/ঘণ্টা), দ্রুত সাইকেল চালানো (১৬ কিমি/ঘণ্টা), রোজ সাঁতার কাটা, ভারী ওজন তোলা, প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলা এবং শারীরিক অনুশীলন করা উচিত।
চিকিৎসকদের উচিত নিয়মিত রোগীদের ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাপন সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করা।

স্থূলতা প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রনযোগ্য। সুতরাং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করতে হলে সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যক্রম, পর্যাপ্ত ঘুম, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জনের বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে।

Advertisement