হঠাৎ করেই মনে হল মুখটা যেন একদিকে একটু বেঁকে গেছে। সুস্থ শরীর কিন্তু সুস্থ নয় মনে হচ্ছে। যেন খাবার এবং জল গিলতেও অসুবিধা হচ্ছে। খাবারটা মুখের একদিকে আটকে আছে, চিবোতে মুখের একদিকে আটকে আছে এবং বেশ কষ্ট হচ্ছে। কোনও ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাঁর এমনটা হয়েছে তাঁর একদিকের চোখের পাতা বন্ধ হচ্ছে না সহজে। এগুলো দেখে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। এই সমস্যাকেই বলে বেলস পলসি। চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রচলিত পরিভাষায় ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালিসিস। এটা এক ধরনের স্নায়বিক সমস্যা।
বেলস পলসি কী ?
বেলস পলসি এমন এক ব্যাধি যা মুখের পেশিতে হঠাৎ দুর্বলতা সৃষ্টি করে। মুখের এই পক্ষাঘাতের নিশ্চিতভাবে কোনও কারণ জানা না থাকলেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভাইরাল সংক্রমণ ছাড়াও এর অনেক কারণ রয়েছে।
প্রতিরোধ কী? চিকিৎসাই বা কী?
নার্ভের সমস্যার কারণে এই শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। কোনও কারণে ব্যথা-যন্ত্রণাতেও সম্ভাবনা তৈরি হয় এই অসুখের। এটি এমন একটি অবস্থা, যার ফলে মুখের পেশিগুলি দুর্বল হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। মুখের পেশির সঙ্গে যুক্ত স্নায়ুগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে, স্নায়ুর পথকে সংকুচিত করে দেয়। এর কারণেই নিউরনের সংকেত বহন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
এই জটিলতাই হল বেলস পলসি। এটি সাময়িক কিন্তু সারতে সময় নেয়। তবে সময় যা-ই লাগুক না কেন চিকিৎসা এবং ব্যয়ামের মাধ্যমে এটি সাধারণত পুরোপুরি নির্মূল হওয়া সম্ভব।
বেলস পলসি দু’ধরনের। মুখের একপাশে কপাল থেকে থুতনি অবশ হলে মোটর নিউরন টাইপ অফ ফেসিয়াল পলসি হয়। আবার কপালের অংশ বাদে, চোখ থেকে নিচের অংশ প্যারালাইজড হলে সেটাকে বলে আপার মোটর নিউরন টাইপ অফ ফেসিয়াল পলসি।
কারণ কী ?
যখন আমাদের সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন বেলস পলসির সম্ভাবনা দেখা দেয়। যদিও একেবারে নির্দিষ্ট করে এই রোগে আক্রান্ত হবার কারণ এখনও বলা যায় না। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল বা বিষাক্ত সংক্রমণের কারণে রোগটি হয়। যেমন এইচআইভি, হার্পিস সিমপ্লেক্স, হার্পিস জোস্টার, সাইটো মেগালোভাইরাস এবং এপস্টাইন বার ভাইরাস ইত্যাদির সংক্রমণ। হার্পিস জোস্টার, এইচআইভি বা ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের মতো ভাইরাল।
সংক্রমণের কারণে নার্ভ ফুলে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক সময়। এছাড়া ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ এবং উপরের শ্বাসযন্ত্রের বা আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টের সংক্রমণ হলে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত গর্ভবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি রয়েছে। অতিরিক্ত জ্বর, ঠান্ডা-লাগা, সর্দি-কাশি, কান-পাকা ইত্যাদির কারণেও বেলস পলসি হতে পারে। এছাড়া মাথায় আঘাত, টিউমার, স্ট্রোক থেকে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মধ্যকর্ণে সংক্রমণের কারণে হতে পারে ফেসিয়াল পলসি। আঘাতজনিত কারণে হতে পারে এই ফেসিয়াল প্যারালিসিস। মস্তিস্কের স্ট্রোক এর অন্যতম কারণ। ফেসিয়াল টিউমারের কারণে আসতে পারে নানা জটিলতা। কানের অপারেশন পরবর্তী ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি ইত্যাদি কারণেও এই রোগ হতে পারে।
উপসর্গ
বেলস পলসি হলে সাধারণত মুখের একদিকের বা একপাশের পেশি আক্রান্ত হয়। তবে অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে মুখের দু’পাশের পেশিই আক্রান্ত হতে পারে।
পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু চোখ বন্ধ করা যাবে না। মুখের এক পাশ থেকে লালা ঝরতে থাকে। চোখ জ্বালা করতে পারে। অনেক সময় ড্রাই আইজের সমস্যা দেখা দেয়।
এই রোগটির ফলে মুখের স্নায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যে-সব কাজকর্ম, সেগুলোর উপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। মুখের যে-দিকের অংশ আক্রান্ত হয়েছে তা খুলতে, হাসতে এবং চিবিয়ে খেতে কষ্ট হয়।
কারও কারও ক্ষেত্রে মুখের ওই অংশে ব্যথাও হতে পারে, বিশেষ করে চোয়াল এবং মাথায় ব্যথা অনুভব হয়।
জিভের সামনের অংশটিও প্রভাবিত হয়। ফলে জিভের স্বাদগ্রহণে সমস্যা দেখা দেয়। মুখের ভেতরটা শুকনো হয়ে থাকে।
এটা যে-কোনও বয়সের নারী-পুরুষের হতে পারে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগ বেশি দেখা যায়। গর্ভাবস্থায়, ফুসফুসের সংক্রমণ হতে পারে, ডায়াবেটিস থাকলে হতে পারে। পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও ফেসিয়াল প্যারালিসিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
চিকিৎসা
বেলস পলসির চিকিৎসা নির্ভর করে যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর সেই রোগের কারণটা ঠিক কী এবং কতটা ঝুঁকি রয়েছে তার ওপর। চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ কার্যকরী। এছাড়াও অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন জাতীয় কিছু ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয় প্রয়োজন পড়লে। যদি উপসর্গ দেখে ডাক্তার সন্দেহ করেন যে, কোনও ভাইরাস সংক্রমণই এই রোগের কারণ- তাহলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওষুধের পাশাপাশি, ফিজিওথেরাপির একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এই রোগের চিকিৎসায়। রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে চিকিৎসক ব্যবস্থা নেন। তবে কিছু জটিলতা থাকে যেমন ট্রমার কারণে স্নায়ু সঙ্কুচিত হলে তখন অপারেশন ছাড়া গতি থাকে না। কারও কারও ক্ষেত্রে কয়েক মাসের মধ্যেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার কারও ক্ষেত্রে তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়।
এখন দীর্ঘ গবেষণায় নতুন নতুন পদ্ধতি আসছে এই রোগ নির্মূল করতে। যেমন ইলেকট্রিকাল নার্ভ স্টিমুলেশন পদ্ধতি, এক্ষেত্রে নিরাপদ এবং বেশ কার্যকরী।
৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় বেলস পলসিতে। ১০ শতাংশের কিছু দুর্বলতা থেকে যায়। যেমন, মুখ কিছুটা বাঁকা থেকে
যেতে পারে, সেক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির বড় ভূমিকা রয়েছে। দু-ধরনের থেরাপি হয়। মেকানিক্যাল থেরাপি অর্থাৎ আইআরআর, প্যারাফিন ওয়াক্স থেরাপি, আলট্রা সাউন্ড থেরাপি, ইলেকট্রিকরল স্টিমুলেশন। এবং ম্যানুয়াল থেরাপি, ইনফ্রা-রেড রেডিয়েশন থেরাপি, ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন থেরাপি, অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ ফেসিয়াল মাসল এক্সারসাইজ, স্পিচ বি-এডুকেশন থেরাপি, ব্যালুনিং এক্সারসাইজ, রিঙ্কলিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি যার অন্তর্গত।
কী করবেন
এই অবস্থা না-সারা পর্যন্ত নরম খাবার খেতে হবে। আপেল, পেঁপে, আঙুর, তরমুজ, স্ট্রবেরি, কলা খান। এসবে অ্যাটিঅক্সিডেন্ট আছে যা ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুকে সুস্থ করবে। ফ্রোজেন অথবা ক্যানজাত খাবার বাদ দিতে হবে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিজেকে সুস্থ রাখা। ঠান্ডা লাগতে না দেওয়া। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালো ঘুম বেলস পলসি হওয়ার ঘটনা কমাতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বেশ ফলপ্রসু।