দরিদ্র ১৬ যুবতীই ছিল মহানন্দের ১৫ বছরের শিকার

Written by SNS August 14, 2023 3:24 pm

পানজি, ১৪ অগাস্ট– ১৯৯৪ থেকে ২০০৯ একে একে লেখা হয় ১৬ তরতাজা যুবতীর মৃত্যুর দিন। তাদের একটাই দোষ ছিল তারা প্রত্যেকে ছিল গরিব। তাদের প্রত্যেকের ওপর নজর পড়েছিল মহানন্দের। শুরু গোয়ার রাজধানী পানাজি থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে শিরোদা থেকে। ২১ বছরের দর্শনা নায়েক থেকে শুরু আর ৩০ বছরের যোগিতায় শেষ। যোগিতায় মহানন্দের বিরাম লাগে কারণ পুলিশ ততদিনে মহানন্দের করিজুরি ধরে ফেলে। যদিও সেই বিরাম লাগাতে সময় লেগে যায় ১৫ বছর। তার মধ্যে প্রাণ চলে যায় ১৬ যুবতীর। প্রত্যেকে গলায় তারই ওড়নার ফাঁস দিয়ে খুন করে মহানন্দ। তার আগে নিজের লালসার শিকার করে তাদের।

ভারতের সিরিয়াল কিলিং-এর ইতিহাসে কুখ্যাততম খুনিদের তালিকায় বেশ উপরের দিকেই নাম থাকবে মহানন্দের। ১৯৯৪ সালে গুলাবিকে দিয়ে শুরু, তারপর একের পর এক মেয়েকে খুন করেই গেছে সে। শেষ খুনটা করেছিল ২০০৯ সালে। টানা ১৫ বছর ধরে তার বিকৃত লালসা এবং লোভের শিকার হয়েছিলেন ১৬ জন তরুণী। তার টার্গেট ছিল ২০-৩৫ বছর বয়সি অত্যন্ত গরীব ঘরের তরুণীরা। বাসস্ট্যান্ড, বাজার, কারখানা, সমস্ত জায়গা থেকে মানসিকভাবে দুর্বল এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের খুঁজে খুঁজে বের করত সে। তারপর তাদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে খুন করত।

গুলাবি এবং দর্শনার পর তার হাতে খুন হয়েছিলেন বাসন্তী গৌড়ে নামে ১৯ বছরের একজন তরুণী। তিনি গৃহ সহায়িকা হিসেবে কাজ করতেন লোকের বাড়িতে। ১৯৯৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৫০ হাজার টাকা বাসন্তীকে দেওয়ার নাম করে শান্তিনগর এলাকার একটি নির্জন জায়গায় তাঁকে ডেকে এনে খুন করে মহানন্দ। বাসন্তীর মৃতদেহের হদিশটুকুও পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।

২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল পুলিশের জালে ধরা পড়ে কুখ্যাত এই খুনি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ‘শিকার’দের কাছে মহানন্দ নিজেকে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিত। এমনকী, তরুণীদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নাম অবধি পাল্টে ফেলত সে। গুলাবির কাছে তার পরিচয় ছিল গোবিন্দ। আবার যোগিতার বেলায় সে হয়ে গিয়েছিল যোগেশ। কিছু কিছু তরুণীকে সে বলত, তার বাবা তাঁদের পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করেছেন। এই কথাতেই গলে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যেতেন অনেকেই। তার শুধু একটাই শর্ত ছিল। যতদিন না তার বাবা এবং বোনের সঙ্গে প্রেমিকার আলাপ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই সম্পর্কের ব্যাপারে মুখ খোলা যাবে না। তার কথা মতো তাই করতেন হতভাগ্য তরুণীরা। তারপর একদিন  ‘শুভ’দিনে বাবা আর বোনের সঙ্গে দেখা করার কথা ঠিক হত। প্রেমিকাকে সেদিন সবচেয়ে দামি গয়না, পোশাক পরে সেজেগুজে দেখা করতে বলত মহানন্দ। যাঁরা তার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আসন্ন বিয়ের আনন্দে দেখা করতে চলে যেতেন, তাঁরা কেউই আর বেঁচে ফিরতেন না। গয়না এবং সম্মান তো যেতই, খোয়াতে হত প্রাণটুকুও। 

পানাজি থেকে ৪০কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে শিরোডা, পোণ্ডা, বিচোলিম, মারগাঁও, কুইপেম-সমস্ত জায়গায় মহানন্দের হাড়হিম করা কীর্তির চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়েছিল। প্রত্যেকটা খুন করার পরেই আগে মৃতদেহ থেকে গয়না খুলে নিত সে। তারপর পরিবারে কারও অসুস্থতার দোহাই দিয়ে বিক্রি করে দিত সেই গয়না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মহানন্দর ‘ভিকটিম’রা প্রত্যেকেই এতটাই গরীব ছিল যে তারা ভাল উকিল পর্যন্ত যোগাড় করতে পারত না। ফলে শুরু হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যেত মামলা।

১৯৯৫ সালে মহানন্দর তৃতীয় খুন এবং ২০০৩ সালে চতুর্থ খুনের মধ্যে আট বছরের লম্বা বিরতি ছিল। কিন্তু তারপর থেকে নির্বিচারে খুন করতে শুরু করে সে। ২০০৫ সালে তিনজন, ২০০৬ সালে একজন, ২০০৭ সালে পাঁচজন এবং ২০০৮ সালে ২ জনকে খুন করে সে।

শেষ খুনটা সে করেছিল ২০০৯ সালে। সেই বছরের জানুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ আচমকাই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন ৩০ বছরের যোগিতা নায়েক। তাঁর সঙ্গেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল ৮০ হাজার টাকার গয়না। ১৫ জানুয়ারি ঠিক দর্শনার মতোই কাজু গাছের ডাল থেকে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনাও হয়তো ধামাচাপা পড়ে যেত। কিন্তু যোগিতার পরিবারের লোকজন পোণ্ডা থানায় আসা নতুন ইন্সপেক্টর চেতন পাতিলের কাছে মেয়ের মৃত্যুর বিচার চেয়ে দরবার করেন। 

সেই ২৫ বছর বয়স থেকে শুরু। মহানন্দের বর্তমান বয়স ৫৪ বছর। গত ১৪ বছর ধরে জেলেই জীবন কাটাচ্ছে সে। যোগিতা হত্যা-রহস্যের কিনারা হওয়ার পরেই উন্মত্ত জনতা তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই ঘটনার পর তার স্ত্রী, যিনি একজন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, তাঁকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। এখনও পর্যন্ত তার দ্বারা হওয়া দুটি হত্যাকাণ্ড আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যান্য মামলাগুলির শুনানি চলছে এখনও।