• facebook
  • twitter
Sunday, 8 December, 2024

আধুনিক ভোগবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই আছে কুশিক্ষার গাঢ় অন্ধকার

শিক্ষার আলোতে পথচলাই শুধু নয়, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছিল যা এখনও সমান সচল, সরব, প্রবহমান।...লিখেছেন স্বপনকুমার মণ্ডল

বিশ শতকের আশির দশকে সাক্ষরতা অভিযানে দেওয়ালে বিজ্ঞাপন লেখা হত ‘সাক্ষরতার আলো/ ঘরে ঘরে জ্বালো।’ শিক্ষার আলোতে পথচলাই শুধু নয়, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছিল যা এখনও সমান সচল, সরব, প্রবহমান। প্রাক্-স্বাধীনতা থেকেই দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের অন্ধত্ব মোচন থেকে আত্মসচেতন, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির উদ্যোগ সবই লক্ষ করা যায়। আমজনতার মধ্যে শিক্ষার অভাববোধ থেকেই আধুনিক শিক্ষা জরুরি মনে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে উনিশ শতকের শিক্ষা বিস্তারে জ্ঞানের সঙ্গে বিশ শতকের বিজ্ঞানের সংযোগ ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

পুথিনির্ভর বিদ্যার (education) সঙ্গে হাতেকলমে শিক্ষার (learning) স্বাভাবিক বন্ধুত্ব বিদ্যাশিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনে। সেখানে বিদ্যার গৌরব ও শিক্ষার সৌরভ আধুনিক শিক্ষার বিস্তারকে ক্রমশ আধুনিক চেতনায় নিবিড় করে তোলে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও মনে হয়েছিল গ্রামের নিম্নবর্গের সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা শোষিত-শাসিত অসহায় মানুষের চোখ খুলে দিতে আধুনিক শিক্ষা একান্ত জরুরি। চোখ থাকতেও অন্ধ মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি ‘পল্লী-সমাজ’ (‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৯১৫, গ্রন্থকার ১৯১৬) উপন্যাসের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কথা তুলে ধরেন। উপন্যাসটির নায়ক তথা রুড়কি কলেজের ছাত্র রমেশ বাবার শ্রাদ্ধ করতে দীর্ঘদিন পরে কুঁয়াপুর গ্রামে ফিরে আসে। সেখানে সে পল্লিবাংলার অজ পাড়াগাঁর কুসংস্কারাচ্ছন্ন অসহায় প্রান্তিক মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগেই স্কুল খোলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।

সরকারি অনুদানে ও জমিদারির সাহায্যে চলা কুঁয়াপুরের ‘ছোটরকমের ইস্কুল’ই পাঁচ-সাত গ্রামের একমাত্র স্কুল। দুই-তিন ক্রোশ দূর থেকেও সেখানে পড়তে আসে। সেই অচল হয়ে পড়া স্কুলই আবার নতুন করে চালু করে রমেশ। শুধু তাই নয়, নিজেদের জমিদারির অধীনে থাকা মুসলিম অধ্যুষিত পিরপুরেও সে একটি নতুন স্কুল খোলে সে। এসবের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষা বিস্তারের মধ্যে নায়কোচিত গুণই শুধু প্রকাশিত হয়নি, শিক্ষার জরুরি চাহিদাও তাতে নিবিড়তা লাভ করে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর সমাজে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে শিক্ষা বিস্তার সম্ভব নয়, সে কথাও শরৎচন্দ্র পরবর্তীতে স্বীকার করেন। ১৯২৯-এর ঈস্টারের ছুটিতে রংপুর বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মিলনীর সভাপতি হিসেবে শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘যে শিক্ষা সভ্য জগতের প্রজারা দাবী করে, সে শিক্ষাবিস্তার গভর্নমেন্টের ঐকান্তিক চেষ্টা ব্যতিরেকে ব্যক্তিবিশেষের চেষ্টায় হয় না।’ অব্যবহিত পরের লাইনে তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘করতে মানা করিনে কিন্তু এখানে একটা night school, আর ওখানে একটা আশ্রম, বিদ্যাপীঠ যা করা হয়, তা ছেলেখেলার নামান্তর।’

সেক্ষেত্রে সময়ান্তরে দেশ স্বাধীন হয়, শিক্ষা বিস্তারে সরকারি উদ্যোগও ক্রমশ গতি লাভ করে। দেখতে দেখতে বিশ শতক পেরিয়ে একুশ শতকের ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির যুগে শিক্ষার আলো শিক্ষাক্ষেত্র থেকে অনলাইনে ঘরে-ঘরে হাতের মুঠোয় চলে আসে। শিক্ষা হার বেড়ে যায়, সাক্ষরতা অভিযানের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে, আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে ক্রমশ নিম্নবুনিয়াদী শিক্ষা থেকে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে নানা সুযোগসুবিধার ছড়াছড়ি। যেন শিক্ষা বিস্তারের মহোৎসব চারিদিকে। সরকারি অনুদান, সাহায্য, সহানুভূতি, উৎসাহ, উপহার, পুরস্কার সব মিলে সেই উৎসবের দিকে তাকালে তার আয়োজন যেন প্রয়োজনকেও ছাপিয়ে গেছে। অথচ সেই উৎসবের আলোর নীচেই তার অন্ত্যজ অন্ধকার জেগে ওঠে, বিস্তারের মধ্যেই বিস্তর ফাঁক ও ফাঁক প্রকট ভাবে বেরিয়ে পড়ে। তখন সাক্ষরতার সঙ্গে স্বাক্ষরতার পার্থক্য গুলিয়ে যায়। শিক্ষা আর শেখার ব্যবধান প্রকট হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শিক্ষার আধারে কুশিক্ষার আঁধারকেই আলো মনে হয়!

আসলে আমাদের ডিগ্রিধারী শিক্ষা এখন ডিগ্রিসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। তাতে বিদ্যা ও শিক্ষার যোগ আমাদের আসল শিক্ষা থেকেই বিয়োগ করে চলেছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি পরীক্ষা কেন্দ্র মনে হয়। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার্থী আর শিক্ষকশিক্ষিকাগণ পরীক্ষক। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কটাই বদলে গেছে। বিদ্যা লাভ থেকে শিক্ষা অর্জনের ধারণাই সেখানে উপেক্ষিত। সকলে ডিগ্রি নিতে আসে, নম্বরে মার্কশিট রাঙিয়ে জীবন রাঙাতে চায়। স্বাভাবিক ভাবেই কর্মসংস্থানমুখী বা চাকরিমুখী শিক্ষার প্রসারে ডিগ্রির চাহিদা বেড়েছে, নম্বরের প্রতিযোগিতা আরও তীব্রতর হয়েছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার অভিমুখটাই শিক্ষাবিমুখ। কী শিখলাম বা কতটা শিখলাম সেখানে গৌণ, আসল তার কাগুজে রেজাল্ট। শিক্ষাও সেখানে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। কী শেখা জরুরির চেয়ে কী করলে রেজাল্ট ভালো হবে সেদিকেই সবার নজর। সেজন্য শিক্ষায় মেডেজি, সাজেশন থেকে টেস্ট পেপার, প্রশ্নবিচিত্রার বিজ্ঞাপনে বেশি নম্বর তোলার টোটকার প্রতি টাটকা সতেজতায় শিক্ষার অভিমুখটিই পরীক্ষার মার্কশিট রাঙানোতেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সারা বছরের শিক্ষার প্রমাণপত্র ঘন্টাকয়েকের মধ্যেই প্রশ্নপত্রের উত্তরেই শংসাপত্র লাভ করে।

সেখানে শিক্ষা লাভের শংসাপত্রের সঙ্গে শেখার বাস্তবতার গড়মিল অত্যন্ত প্রকট। মার্কশিটের নম্বরে শিক্ষার প্রমাণ তো দূরস্থান, তার সম্পর্ক মেলাতে গিয়ে শিক্ষার্থীই বিস্মিত হয়। ‘কী করে এত নম্বর পেলাম’-এর বিস্ময় তার সাধারণ প্রশ্নের উত্তর না জানাতেই লোকের কাছে আরও বিস্ময়কর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সেই মার্কশিটের উপরে ভরসা থাকায় নিজেদের আভিজাত্য বোঝাতে আবার অ্যাডমিশন টেস্টের আয়োজন আমাদের প্রাপ্ত নম্বরের অযোগ্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যার প্রতি শিক্ষার্থীরই সন্দেহ জাগে, লোকের কাছে অবিশ্বাসের কারণ হয়ে ওঠে, তা দিয়েই আমাদের মার্কশিট রাঙানো শিক্ষা ব্যবস্থা ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে চলেছে। শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে সরকারের দৃষ্টি যত আন্তরিক, শিক্ষার ক্ষেত্রে তা ততটাই উদাসীন। স্কুলের পাকা দালান, পোশাক-আশাক, বইখাতা, এমনকি দুপুরের খাবার সবেতেই তার সুনজর। অথচ শিক্ষকের তীব্র অভাবেই তার কুনজর বেরিয়ে পড়ে। যেন উপযুক্ত শিক্ষা বাদে সেখানে সবকিছুতেই তার দরাজ দৃষ্টি। অন্যদিকে প্রাইভেট স্কুলের ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার পরিচয় আরও প্রকট। সবকিছু স্কুল থেকে কিনতে হবে, শুধু শিক্ষাটা বাইরে থেকে নিতে হবে। ঐটি সেখানে শুধু মেলে না।

রেজাল্টসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রের অভাব মোচনে টিউশন থেকে কোচিং সেন্টারের চাহিদা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। সেখানে পরীক্ষা বৈতরণী পারের আয়োজন আরও সক্রিয়তা লাভ করে। যা ছিল বিদ্যালয়ের সম্পদ, তাই অচিরেই বাজারজাত পণ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বাজারে রেজাল্টটাই যখন জরুরি, তখন তাতে শিক্ষাক্ষেত্রগুলি নম্বর উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়। যে নম্বর ছিল মূল্যায়নের একক, তাই সময়ান্তরে অবমূল্যায়নের আধার হয়ে ওঠে। আর সেই আধারে অচিরেই আঁধার নেমে আসে। শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের বিপুল চাহিদায় উচ্চফলনশীল নম্বরধারীদের দৌরাত্ম্য স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কম নম্বরধারীরা সেখানে পিছিয়ে পড়ে, নিঃস্ব হয়ে যায়। সেখানে ধনীর শিক্ষার আড়ম্বরে গরিবের দারিদ্র প্রকট হয়ে ওঠায় শ্রেণী বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আবার পাশফেল তুলে দিয়ে সবাইকে পাশ করাতে গিয়ে সাক্ষরতার হার এগিয়ে যায়, শিক্ষা পিছিয়ে পড়ে। অন্যদিকে শিক্ষার লক্ষ্যও আমাদের সামাজিক সম্পর্ককে ভেঙে ফেলে। লেখাপড়া শিখে বড়লোক হওয়ার ছকবন্দি ধারণা আরও প্রকট, আরও চাহিদাসম্পন্ন। সেখানে শিক্ষার প্রসারে স্বার্থপর ভোগী বড়লোকের সংখ্যা যত বেড়েছে, সামাজিক দূরত্ব তত শ্রীবৃদ্ধিমান, স্বাভাবিক ভাবেই সম্পর্ক তার ততই ভেঙে পড়ে। শিক্ষায় আত্মসম্মান অহঙ্কারী করে তোলে, বড়লোকিতে তার প্রকট প্রকাশ।

অন্যদিকে শিক্ষার স্বাধিকারবোধ উগ্র হয়ে ওঠায় সমাজকে অস্বীকার করার প্রবণতা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনই আত্মকেন্দ্রিক চেতনায় প্রতিবেশী থেকে আপন জনকেও পর করে তোলে। সেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতাই উপেক্ষিত। অন্যদিকে পরিবারেও এসেছে বিচ্ছিন্নতাবোধ। বাবা-মাকেও বড়লোক সন্তান পর করে তোলে, আত্মীয়স্বজনকেও চেনে না। ভোগী জীবনের আত্মসর্বস্ব প্রকৃতি আধুনিক শিক্ষার অন্যতম বিশেষত্ব। সেক্ষেত্রে যে শিক্ষা মানুষের জীবনে আলোর দিশারি হয়ে ওঠার কথা, তাই ক্রমশ অন্ধকারের পথে এগিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এই শিক্ষা শিক্ষার্থীর মনে আত্মবিশ্বাস জোগাতে পারে না, ক্রমশ আরও দুর্বল করে তোলে, প্রতিযোগিতামুখর জীবনকেই দুর্নীতিতে সামিল করে। অর্জনের অভাবে আত্মবিশ্বাস জাগে না, আবার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য দুর্নীতি সক্রিয়তা লাভ করে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে সুযোগ্য করে তোলে, আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে রাখে। সেই শিক্ষার অভাব আজ চারিদিকে। সমাজে সীমাহীন দুর্নীতির মূলেও শিক্ষার আদর্শচ্যূতি অত্যন্ত প্রকট। সেখানে শিক্ষা সহযোগিতার আদর্শকে বঞ্চিত করে শুধু প্রতিযোগিতার মন্ত্র শেখায়, তা প্রতিযোগী মানসিকতা গড়ে তুললেও সহযোগী মানুষ গড়ে তোলে না। কেননা ‘বাঁচো ও বাঁচাও’-এর মধ্যেই মানুষের সভ্যতা এগিয়ে চলে, মানবিকতাবোধ জেগে থাকে।

প্রতিযোগিতা তো দক্ষতা বা যোগ্যতাই শুধু প্রমাণ করে না, ক্রমশ স্বার্থপর দৈত্যে পরিণত করে। মানুষ মানুষের জন্য’র আদর্শ সেখানে ব্যাহত হয়। এজন্য জরুরি সহযোগিতার শিক্ষাও। তবেই শিক্ষায় পূর্ণতা আসবে। তা না হলে সমাজে শুধু বৈষম্য বাড়বে না মানুষের ভেতরের পশুটিও আরও সহিংস হয়ে উঠবে, সময়ে সেই পশুটিকেও হারিয়ে দৈত্যের আবির্ভাব ঘটবে। কেননা বনের পশুরা আহারের বেশি শিকার করে না, মানুষ তার সীমাহীন ক্ষুধায় দুর্নীতির রাজত্ব শ্রীবৃদ্ধি করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা রুজিরোজগারের অভাব পূরণ করতে না পারলেও অনন্ত ক্ষুধা জাগিয়ে তোলে। আর সেখানেই শিক্ষার অভাবে দুর্নীতির পাহাড় ক্রমশ পর্বত হয়ে উঠছে, ভাবা যায়!