• facebook
  • twitter
Monday, 15 December, 2025

ছাত্র রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্যকীর্তি নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে একটি বিশেষ দিক প্রায়ই আড়ালে থেকে যায়—তিনি ছাত্র হিসেবে কেমন ছিলেন

ড. রতন ভট্টাচার্য: সে এক মজার গল্প।সকালে স্কুল যাওয়ার আগে রবির পেটে নাকি খুব ব্যথা।ও স্কুল যাবে না। মা শুনেই এক গ্লাস তেতো সরবৎ পাঠিয়ে দিল। অগত্যা আর কি করা। তেতো গিলে স্কুল যেতেই হল রবিকে। অথচ এই স্কুল যেতে দেরি হচ্ছে বলেই একদিন তার কান্নাই থামছিল না। দাদা জ্যৌতিরিন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, এখন স্কুল যাওয়ার জন্য যত কাঁদছিস,একদিন স্কুল না যাওয়ার জন্য তার চেয়ে বেশী কাঁদবি”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্যকীর্তি নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে একটি বিশেষ দিক প্রায়ই আড়ালে থেকে যায়—তিনি ছাত্র হিসেবে কেমন ছিলেন, তাঁর শিক্ষাজীবন কেমনভাবে গড়ে উঠেছিল এবং সেই অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্য ও চিন্তাজগতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রবন্ধে আমরা ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বিশদ আলোচনা করব।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬১ সালের ৭ই মে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুর পরিবার ছিল তৎকালীন বাংলার অন্যতম প্রভাবশালী পরিবার।

Advertisement

এই পরিবারে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, দর্শন ও সমাজচিন্তার এক অনন্য পরিবেশ ছিল। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ছিল একেবারেই ভিন্নধর্মী।শৈশবে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নামক একটি বিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি নিয়মিত পড়াশোনায় মন বসাতে পারতেন না। বিদ্যালয়ের কঠোর নিয়মকানুন, যান্ত্রিক পাঠ্যপদ্ধতি তাঁর স্বাধীনচেতা মনকে একেবারেই আকর্ষণ করতে পারেনি। পরে তাঁকে পাঠানো হয় নরমাল স্কুলে, তারপর বেথুন স্কুলে। কিন্তু কোথাও তিনি স্থায়ীভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি।

Advertisement

ছাত্র রবীন্দ্রনাথের এই অস্থিরতা আসলে তাঁর সৃজনশীল মননের প্রতিফলন। তিনি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। তাঁর শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় যখন তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি কিছুটা নিয়মিত পড়াশোনা করলেও, তাঁর মন আসলেই টানত সাহিত্য, সংগীত ও প্রকৃতির দিকে। তিনি ক্লাসে বসে কবিতা লিখতেন, গান বাঁধতেন। শিক্ষকরা অনেক সময় বিরক্ত হতেন, কিন্তু তাঁর প্রতিভার ঝলক তখন থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় উচ্চশিক্ষার জন্য।

প্রথমে তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে আইন পড়তে ভর্তি হন। কিন্তু আইন পড়াশোনায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি বরং ইংরেজি সাহিত্য, সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। শেক্সপিয়র, মিল্টন, শেলী, কিটস প্রমুখ কবিদের রচনা তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। পাশ্চাত্য সংগীত ও নাট্যকলার সঙ্গে পরিচিত হন। এই বিদেশযাত্রা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে, তাঁকে বিশ্বমানবতার ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে।

তবে ছাত্র রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল পাঠ্যপুস্তকের বাইরে। তিনি প্রকৃতি থেকে শিখেছেন, মানুষের জীবন থেকে শিখেছেন, পারিবারিক পরিবেশ থেকে শিখেছেন। তাঁর বড় ভাই দিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ—এঁরা ছিলেন তাঁর প্রথম শিক্ষক। তাঁদের সাহচর্যে তিনি সাহিত্য, সংগীত, নাটক, দর্শন ও সমাজচিন্তার নানা দিক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে উঠেছিল, তা পরবর্তী সময়ে তাঁর শিক্ষাদর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা কেবল বই পড়া নয়, বরং জীবনকে জানা, প্রকৃতিকে জানা, মানুষের সঙ্গে মিশে অভিজ্ঞতা অর্জন করা। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি পরে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা মুক্ত পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারে।ছাত্র রবীন্দ্রনাথের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর অদম্য কৌতূহল। তিনি সবকিছু জানতে চাইতেন, সবকিছু নিয়ে ভাবতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় যখন তিনি মাত্র আট বছর বয়সী। ছাত্রজীবনেই তিনি নাটক লিখেছেন, গান রচনা করেছেন। তাঁর সৃজনশীলতা ছিল অফুরন্ত।

তাঁর ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সবসময় সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে পারে না। তাই তিনি পরে শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষা, যা ছাত্রদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখাবে, তাদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করবে। ছাত্র রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হলো—শিক্ষা কখনোই কেবল পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্গত শক্তিকে জাগিয়ে তোলা, তার সৃজনশীলতাকে বিকশিত করা। রবীন্দ্রনাথ নিজে ছাত্রজীবনে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সফল হতে পারেননি, কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতা তাঁকে বিশ্বকবি করে তুলেছে।

তাঁর ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে আমরা দেখি স্বাধীনচেতা মন, প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা। এগুলো তিনি শিখেছিলেন ছাত্রজীবনে, বইয়ের বাইরে থেকে। রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিটি ছাত্রের মধ্যে একেকটি সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সবসময় সেই সম্ভাবনাকে চিনতে পারে না। তাই প্রয়োজন এমন এক শিক্ষা, যা ছাত্রদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখাবে, তাদের সৃজনশীলতাকে বিকশিত করবে।

আজকের দিনে ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে মনে করা জরুরি। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও অনেকাংশে পরীক্ষানির্ভর, যান্ত্রিক। ছাত্রদের সৃজনশীলতা বিকশিত করার সুযোগ কম। রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন আমাদের শেখায়, শিক্ষা হতে হবে মুক্ত, সৃজনশীল, মানবিক।ছাত্র রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক স্বাধীনচেতা, কৌতূহলী ও সৃজনশীল মানুষ। তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন হয়তো খুব সফল ছিল না, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে গড়ে তুলেছিল এক বিশ্বমানব হিসেবে। তাঁর ছাত্রজীবনের শিক্ষা তাঁকে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছে, তাঁর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ছাত্র রবীন্দ্রনাথ আমাদের শেখায়—শিক্ষা হলো মুক্ত চিন্তার বিকাশ, সৃজনশীলতার উন্মেষ এবং মানবিকতার চর্চা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্রজীবন আমাদের সামনে এক অনন্য শিক্ষা দর্শন তুলে ধরে। তিনি নিজে প্রচলিত পরীক্ষানির্ভর, যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় কখনোই স্বস্তি পাননি। বেথুন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কিংবা ইংল্যান্ডে আইন পড়াশোনার অভিজ্ঞতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কেবল বই মুখস্থ করা, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া—এসব দিয়ে মানুষের অন্তর্গত শক্তি জাগ্রত হয় না। তাঁর স্বাধীনচেতা মন বারবার বিদ্রোহ করেছে সেই গণ্ডিবদ্ধ শিক্ষার বিরুদ্ধে।এই অভিজ্ঞতা থেকেই ছাত্র রবীন্দ্রনাথের আদর্শ গড়ে ওঠে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা মানে হলো মুক্ত চিন্তার বিকাশ, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শেখা, মানুষের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা। পরীক্ষানির্ভর শিক্ষায় ছাত্ররা কেবল যান্ত্রিকভাবে তথ্য মুখস্থ করে, কিন্তু সৃজনশীলতা বিকশিত হয় না। রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন আমাদের শেখায় যে ছাত্রদের কৌতূহল, কল্পনাশক্তি ও স্বাধীন চিন্তাকে উৎসাহিত করতে হবে। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা তাঁর সেই আদর্শেরই বাস্তব রূপ। সেখানে ছাত্ররা মুক্ত পরিবেশে পড়াশোনা করত, প্রকৃতির কোলে বসে গান, কবিতা, নাটক, বিজ্ঞান, দর্শন শিখত।

পরীক্ষার চাপ নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ছিল মূল লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ছাত্রদের মধ্যে যে প্রতিভা লুকিয়ে থাকে, তা কেবল মুক্ত পরিবেশেই বিকশিত হতে পারে।আজকের দিনে যখন শিক্ষাব্যবস্থা এখনও অনেকাংশে পরীক্ষানির্ভর ও যান্ত্রিক, তখন ছাত্র রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি—শিক্ষা হতে হবে মানবিক, সৃজনশীল ও মুক্ত। ছাত্রদের কল্পনাশক্তি, শিল্পবোধ, মানবিকতা ও স্বাধীন চিন্তাকে বিকশিত করার সুযোগ দিতে হবে।

অতএব, পরীক্ষানির্ভর যান্ত্রিক ছাত্রদের সৃজনশীলতা বিকশিত করতে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবনের আদর্শ হলো—শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করা, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শেখা, এবং ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তাকে উৎসাহিত করা।
আজকের দিনে যখন আমরা প্রযুক্তিনির্ভর, প্রতিযোগিতামূলক সমাজে বাস করছি, তখন রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষা ও উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রয়োজন মানবিকতা, সৃজনশীলতা ও মুক্ত চিন্তার বিকাশ।

তাঁর সাহিত্য আমাদের শেখায় সহমর্মিতা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বজনীনতার বোধ।রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক কারণ তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে একজন মানুষ নিজের সংস্কৃতির শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেও বিশ্বমানব হতে পারে। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায় যে সত্যিকারের অগ্রগতি হলো মানবিক মূল্যবোধের চর্চা, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং মুক্ত চিন্তার প্রসার। তাই আজও তাঁর আদর্শ আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে আছে। লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান দমদম মতিঝিল কলেজ

Advertisement