• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

শিক্ষায় দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি

ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর এদেশে ক্ষমতা লাভ ও প্রসারের সঙ্গে তাঁদের প্রশাসনিক কাজে ইংরেজি জানা কর্মচারি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।...লিখেছেন বিমলকুমার শীট

ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর এদেশে ক্ষমতা লাভ ও প্রসারের সঙ্গে তাঁদের প্রশাসনিক কাজে ইংরেজি জানা কর্মচারি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। তাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্কুল কলেজ। প্রসার ঘটে পাশ্চাত্য শিক্ষার। সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য দরকার ছিল পুস্তকের। কিন্তু দেশীয় ভাষায় পাঠ্যপুস্তক পাওয়া ছিল দুষ্কর। বিশেষ করে বিজ্ঞানচর্চার। ফলে ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে ছিলেন বাঁকুড়ার যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬)। সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বহু শাখাতেই ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় তিনিই ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। এই গুণী মানুষটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৬ সালে সাম্মানিক ডিলিট প্রদান করে।

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি কটক রেভেনশা কলেজে চাকরির সূত্রে দীর্ঘ তিরিশ বছর স্থায়ীভাবে ওড়িশাবাসী হয়েছিলেন। এই সময়টি (১৮৮৯-১৯১৯)ওড়িশায় আধুনিক শিক্ষা প্রসারের পর্ব। যোগেশচন্দ্রের কটকে বাসকালীন ১৮৮৭ সালে তাঁর লেখা ‘সরল পদার্থবিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়বার কটকে এসে রচনা করেন কেমিস্ট্রির পাঠ্যপুস্তক। ১৮৯০ সালে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানী থেকে ‘রসায়ন প্রবেশ’ প্রকাশ পায়। এর ভূমিকায়, তিনি জানান -“বাঙ্গালা আপার প্রাইমারী পরীক্ষায় বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু উক্ত পরীক্ষার্থী অল্প বয়স্ক বালকদিগের উপযোগী একখানিও বিজ্ঞান গ্রন্থ এ পর্যন্ত রচিত হয় নাই। সেই অভাব দেখিয়াই এই রসায়ন প্রবেশ প্রণীত হইল”। এটি রসায়নের প্রথম বাংলা পাঠ্যবই। এতে জড়পদার্থ, দ্রবীকরণ, বায়ু, জল, অঙ্গারক, গন্ধক, অম্ল ও ক্ষার, চুন ও মৃত্তিকা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা আছে। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সরল রসায়ন (তেজঃ সাহিত্য)’। এর প্রথম খন্ড তেজঃ, দ্বিতীয় খন্ড অজৈব রসায়ন, তৃতীয় খণ্ড জৈব রসায়ন এর ভূমিকায় যোগেশচন্দ্র বলেছেন- “—গত বৎসর এখানকার মেডিক্যাল স্কুলে আমাকে ঐ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হইয়াছিল। কিন্তু প্রচারিত কোন পুস্তকে ঐ ঐ বিষয় ছাত্রদিগের উপযোগী করিয়া লিখিত হইতে না দেখিয়া আমার তৎ তৎ বিষয় লিখাইয়া দিতে হইয়াছিল। লেখাগুলি এখানে ওখানে কিঞ্চিৎ বিস্তৃত করিয়া পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইল”। পরে ইংরেজি ভাষার আরও একটি পাঠ্য পুস্তক ‘Practical Chemistry For Beginners’ বের করেন। এই বইটি অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় ছাত্রদের কথা ভেবে তিনি লিখেছিলেন। এটি কন্নড় ভাষাতে অনুবাদের প্রস্তাব ছিল।

Advertisement

সেকালে পদার্থবিজ্ঞানেরও ছাত্রপাঠ্য ভাল ছিল না। তাই ‘সরল পদার্থবিজ্ঞান’ বের হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে রসায়ণ বিদ্যার পাঠ্যবই লেখার জন্য যোগেশচন্দ্রের কাছে অনুরোধ আসে। তিনি ওড়িয়া ভাষায় একটি প্রাইমার ‘বিজ্ঞান প্রবেশ’ রচনা করেন। এটি উচ্চ প্রাথমিক পরীক্ষার ছাত্রদের জন্য লেখা হয়েছিল। এটি ওড়িয়া ভাষায় পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ্যপুস্তক। এছাড়া ওড়িয়াতে ছিল তাঁর আরও ৩টি বই রসায়ন প্রবেশ, সরল পদার্থবিজ্ঞান ও সরল প্রাকৃত ভূগোল।

Advertisement

কটকে থাকাকালীন যোগেশচন্দ্র রায়ের সম্পাদিত ‘পত্রাবলী’ প্রকাশিত হয় (১৯০৩ সাল)। দেবনগরীতে এর উপ আখ্যাপত্রে লেখা আছে “গৃহিনী সচিবঃ সাথী মিথঃ/ প্রিয় শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ”। প্রথম সংস্করণের মূল্য এক টাকা। ২০টি পত্রে তিনটি অধ্যায়ে বইটি সম্পূর্ণ। বিজ্ঞাপনে লেখক বলেছেন “কয়েক বৎসর পূর্বে আমার কোন বন্ধুর সহিত এদেশে সাধারণ জ্ঞান বিস্তার সম্বন্ধে কথাবার্তা হয়। এ বিষয়ে তাহার আগ্রহ ছিল। এই হেতু সাধারণ পাঠক পাঠিকার উপোযোগী

কতকগুলি প্রবন্ধ লিখিতে তাহাঁকেই অনুরোধ করি। তাহারই ফলস্বরূপ তিনি পত্রচ্ছলে কতকগুলি প্রবন্ধ লিখিয়া আমার নিকট প্রেরণ করেন। অধিকাংশ প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ ছিল। তন্মধ্যে ২০ খানি পত্ৰ যথাসম্ভব সম্পূর্ণ করিয়া পত্রালী নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হইল। —বন্ধুর নামটি জানা যায় নি”।

একটি পত্রে আছে “কবি, প্রকৃতির চর্চা করেন, বৈজ্ঞানিকও তাই করেন। প্রকৃতির বর্নণা করিয়া কবি সুখ পান, বৈজ্ঞানিকও প্রকৃতির অনুসন্ধানে বিমল আনন্দ অনুভব করেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক যেভাবে প্রকৃতির চর্চা করেন এবং করিয়া আনন্দ পান, তাহার তুলনায় কবির আনন্দ অকিঞ্চিৎকর। বৈজ্ঞানিকগণকে জিজ্ঞাসা কর, সকলেই একবাক্যে প্রকৃতিচর্চার মাদকতা শক্তির সাক্ষ্য দেবেন”। দীনেশচন্দ্র সেন ‘ভারতী’ পত্রিকায় সমালোচনায় বলেছেন – “বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্য সম্বন্ধে সুখপাঠ্য পত্রালী”। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মন্তব্য “আমাদের দেশে সাধারণ মধ্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার করিতে হইলে এই ধরনের পুস্তকেরই প্রয়োজন”।

যোগেশচন্দ্র তাঁর ‘সরল রসায়ন’ (১৮৯৮) গ্রন্থে প্রাঞ্জল ভাষায় ছাত্রদের উপযোগী করে বিজ্ঞানের আলোচনা করেছেন। যেমন- “তেজঃ। Radiant Energy. তেজের অর্থ। – সূর্য্য হইতে আমরা যে কেবল তাপ পাই, এমন নহে। তারপরে সঙ্গে সঙ্গে আলোক আসে। সেই আলোকে দিবা ভাগে যাবতীয় বস্তু দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু সকল স্থলে তাপের সঙ্গে আলোক পাই না। অন্ধকার গৃহে উত্তপ্ত লৌহ দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ তাহা হইতে তাপ বিকীর্ণ হয়। কিন্তু লৌহ খন্ডটি অতিশয় উষ্ণ হইলে তাহা হইতে আলোকও বিকীর্ণ হয়। তবেই বিকীর্ণ তাপ এবং আলোকের প্রকৃতি এক বলিয়া বোধ হয়। আমাদের শরীরে উহাদের ক্রিয়ার অবশ্য সাদৃশ্য নাই। আমাদের সর্বাঙ্গের ত্বক দ্বারা তাপ অনুভব করিতে পারি, কিন্তু কেবল চক্ষু দ্বারা আলোক অনুভব করি। তড়িতের প্রকৃতিও আলোকের মত। এজন্য বিকীর্ণ তাপ, আলোক এবং তড়িতের সাধারণ নাম তেজ”। তিনি কটক মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্রদের উপযোগী করে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ণ বিদ্যার পাঠ্য বইগুলি লিখেছিলেন। মেডিক্যাল স্কুলে (তখন ‘কলেজ’ বলা হত না) বাংলার মাধ্যমে শিক্ষাদান চালু হয় ১৮৫২-৫৩ সাল থেকে। মহেন্দ্ৰনাথ ভট্টাচার্যও ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার মান অনুসারে ‘রসায়ন’ রচনা করেন।

রাজা বিজয়চন্দ্র মহতাব বাহাদুরের উদ্যোগে বর্ধমানে যে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন হয় তাঁর বিজ্ঞান শাখার সভাপতি হন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। এই সভায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা যাতে ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের উত্তর বাংলা ভাষায় লিখতে পারে সেই প্রস্তাব নেওয়া হয়। যোগেশচন্দ্র বলেন, কটক মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্রদের বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে এর সুফল মিলেছে। সভায় তিনি বিজ্ঞান প্রচারের অন্তরায় বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, প্রথমত ব্যয়সাধ্য ইউরোপীয় বিজ্ঞান শিক্ষা ভারতবর্ষের মতো নির্ধন দেশে কষ্টসাধ্য। দ্বিতীয়ত – দেশে বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র বা শিল্প কারখানা না থাকায় মূর্ত বিজ্ঞান প্র্যাকটিক্যাল কার্যকর হচ্ছে না। তৃতীয় অন্তরায় হল বিদেশী ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা। মাতৃভাষায় তা না শেখায় বিদেশী বিজ্ঞান আমাদের কাছে বিদেশী থেকে যাচ্ছে।

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা এক স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। তিনি জীবন বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক প্রবন্ধ বাংলায় লিখেছেন। ‘সরল প্রাকৃত ভূগোল’ গ্রন্থও লেখেন। ‘ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভূগোল পাঠনা’ তাঁর অসাধারণ গবেষণা। পরে পরে অন্যান্যরা দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে এসেছেন। ফলে উপকৃত হয়েছে পাঠককুল।

Advertisement