শ্রী জয়দীপ
শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন কলকাতার বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। তাঁর বন্ধু সুবোধ মল্লিকের ১ লক্ষ টাকা বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজকে আর্থিক অনুদানের প্রথম শর্তই ছিল শ্রীঅরবিন্দকে কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে। শ্রীঅরবিন্দ শুধু কলেজের প্রশাসকই ছিলেন না তিনি জাতীয় শিক্ষার এক নতুন আদর্শ গড়ে তুলেছিলেন যার সারসংক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছিল কর্মযোগী পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধমালায়, সিস্টেম অব ন্যাশনাল এডুকেশন শীর্ষক রচনায়। ২০২০ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি (NEP) রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রবন্ধমালা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলে ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি রূপায়নকারী কর্মকর্তারা তা স্বীকারও করেন। এর থেকেই বোঝা যায়, শ্রী অরবিন্দের জাতীয় শিক্ষা আদর্শ বর্তমান সময়েও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি মনে করতেন প্রকৃত শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জন নয় বরং আত্ম-উন্নতি, আত্মনির্ভরতা এবং জাতীয় চেতনার বিকাশ। এই ভাবনা জাতীয় শিক্ষার এক মৌলিক ভিত্তি গড়ে তোলে, যা আজকের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে এক দিশারী হয়ে রয়েছে।
শ্রীঅরবিন্দ নিজে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতে, এই শিক্ষা ছিল পরিকল্পিত দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি, যা ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারের অনুগত নিম্নস্তরের আমলায় পরিণত করত। ব্রিটিশ শাসনের আগে বেশিরভাগ গ্রামে অন্তত একটি করে টোল ছিল, যেখানে ব্রাহ্মণ এবং অ-ব্রাহ্মণ নির্বিশেষে তরুণদের পাঠদান চলত। টোল হলো সংস্কৃত ও পালি ভাষায় সাহিত্য, বেদ, পুরান, উপনিষদ, ব্যাকরণ, অলংকার, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ব্রিটিশরা স্থানীয় ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়, যাতে ভারতীয়দের স্বশিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হয়।
শ্রীঅরবিন্দ ব্রিটিশদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে লিখেছিলেন—
“এই শিক্ষা ব্যবস্থা ভারতীয় মেধাকে নিস্তেজ ও দরিদ্র করে তোলে। এতে মৌলিক চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় এবং যান্ত্রিক অনুশাসনের মাধ্যমে জাতির অন্তর্নিহিত প্রতিভা দমিয়ে রাখা হয়।”
স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালের ১০ অক্টোবর প্রকাশিত কার্লাইল সার্কুলারের মাধ্যমে ছাত্রদের স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৮ নভেম্বর ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার পি সি লিয়নের সার্কুলারে আরও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয় — ‘বন্দে মাতরম’ উচ্চারণ, জাতীয়তাবাদী গান গাওয়া কিংবা জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়।
কার্লাইল সার্কুলারের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র বাংলায় জাতীয় শিক্ষার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯০৫ সালের ২৪ অক্টোবর আব্দুল রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জাতীয় শিক্ষার স্বাধীন ব্যবস্থার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর, ১৯০৬ সালের ১১ মার্চ ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন গঠিত হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে শ্রীঅরবিন্দ প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শ্রীঅরবিন্দ বরোদা রাজ্যের প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত থাকলেও জাতীয় শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর ৭৫০ টাকার চাকরি ছেড়ে মাত্র ৭৫ টাকায় কলকাতায় অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতীয় শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা আত্মনির্ভরশীল। জাতীয় চেতনা-সমৃদ্ধ এবং সত্যিকার অর্থে ভারতীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্মিত। তিনি জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছিলেন—
জাতীয় শিক্ষা এক বা দুটি বাক্যে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবে এর লক্ষ্য হলো অতীত ও বর্তমানের সমন্বয়ে একটি মহান জাতি গড়ে তোলা। শিক্ষা হবে এমন যা স্বনির্ভরতার চেতনায় মানুষ গড়বে, যন্ত্র নয়। ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাবনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় শিক্ষার আদর্শ সম্পর্কে শ্রীঅরবিন্দের ভাবনার প্রতি সমর্থন জানান। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
“ভারতে বিদেশীদের শিক্ষার উপর নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা একটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা, যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য হলো দেশের প্রকৃত সন্তানদের গড়ে তোলা, যারা ভারতের গ্রামগুলিকে সংগঠিত করবে এবং দেশকে নতুন আলোর পথে পরিচালিত করবে।”
শ্রীঅরবিন্দের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ধারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার প্রভাব বর্তমান জাতীয় শিক্ষা নীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও বর্তমান। তিনি যে আদর্শ গড়ে তুলেছিলেন, তা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর শিক্ষাদর্শ আজও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছে। জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্যে শ্রীঅরবিন্দের যে ত্যাগ ও অবদান, তা আজও ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অনুপ্রেরণা। তাঁর ভাবনা আজও শিক্ষানীতির নীতিগত ভিত্তি এবং শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।