• facebook
  • twitter
Thursday, 14 August, 2025

কলেজে কলেজে শূন্য আসন এক অশনি সঙ্কেত

চলতি বছরে এ রাজ্যের কলেজগুলিতে বিজ্ঞানের মূল বিষয়, দর্শন, এমনকি অর্থনীতিরও এক বিপুল সংখ্যক আসন শূন্য পড়ে আছে।

বাংলার উচ্চশিক্ষায় যেন ভাটার টান। চলতি বছরে যেমন এ রাজ্যের কলেজগুলিতে বিজ্ঞানের মূল বিষয়, দর্শন, এমনকি অর্থনীতিরও এক বিপুল সংখ্যক আসন শূন্য পড়ে আছে। প্রসঙ্গত, এই বছরই প্রথম কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে স্নাতক স্তরে কেন্দ্রীয় ভাবে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। জানা গিয়েছে, লক্ষাধিক পড়ুয়া কেন্দ্রীয় ভাবে পোর্টালে প্রবেশ এবং নাম নথিভুক্তকরণ করেছিল। কিন্তু তার পরেও

এত বেশি আসন ফাঁকা থেকে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের।
অবস্থা এমনই যে, কলেজগুলিকে পুরনো পদ্ধতিতে কলেজের নিজস্ব পোর্টালের মাধ্যমে নতুন করে ফাঁকা আসন পূরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বেশ কিছু বছর ধরেই আসন ফাঁকা থাকার বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। কলকাতার কিছু নামী কলেজকে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে আসনসংখ্যাও কমাতে হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় এমন অনাগ্রহের একাধিক কারণ। অনেকে ২০২৩ সালে রাজ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-র প্রয়োগের প্রসঙ্গ তুলেছেন। চার বছরব্যাপী স্নাতক স্তরের পড়াশোনার বিষয়টি নিয়ে এখনও প্রশ্ন অনেক, নিঃসন্দেহে। এখানে শিক্ষার্থীরা তিন বছর পর পড়ায় ইতি টানলেও সে ডিগ্রি লাভ করবে, দু’বছর পর পড়া ছাড়লে লাভ করবে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট। কিন্তু কর্মজীবনে এই ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট কত দূর উপযোগী হবে, ধোঁয়াশা কাটেনি। তবে পশ্চিমবঙ্গের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা থাকার ছবি নতুন শিক্ষা নীতি প্রয়োগের পূর্ব থেকেই দেখা গিয়েছিল। অর্থনৈতিক কারণটি বোঝা সহজ। কর্মসংস্থানের সঙ্কট দীর্ঘ দিনের বাস্তব। কলেজ-শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর যে মানের কর্মসংস্থান হওয়া উচিত, দীর্ঘ দিন তার অভাব প্রকট।

কোভিড-উত্তর কালে সেই সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। শিক্ষা-অন্তে চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় প্রথাগত পড়া চালিয়ে যাওয়া অপচয় মনে করা হচ্ছে। কোভিডকালে অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে যেতে না পারায় বহু শিক্ষার্থী শিক্ষার পথ ছেড়ে উপার্জনে প্রবৃত্ত হয়েছিল। কোভিড-পরবর্তী যুগে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি আসেনি, উচ্চশিক্ষায় অনীহাও অব্যাহত থেকেছে। লক্ষ্যণীয়, এই সময়কালে রাজ্যের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে এই শিক্ষালয়গুলি বাজার উপযোগী বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করে, যাতে শিক্ষা-অন্তে শিক্ষার্থী দ্রুত চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই নগদ অর্থের বিনিময়ে এই কলেজগুলিতে ভিড় বেড়েছে। অন্য দিকে, সংরক্ষণ নীতিও আসন খালি থাকার জন্য কিয়দংশে দায়ী। রাজ্য স্তরে আসন সংরক্ষণের হার ৪৫ শতাংশ।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই সংরক্ষিত আসনের এক বড় অংশ ফাঁকা থেকে যায়। জনজাতি ও প্রান্তিক শ্রেণিকে শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসার জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তা যাতে ফলপ্রসূ হয়, তার জন্য সরকারকে আগ্রহী হতে হবে। উচ্চশিক্ষায় এই ক্রমবর্ধমান অনাগ্রহ বিশেষ উদ্বেগের কারণ। এমনিতেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিকাঠামোগত সমস্যায় ধুঁকছে। শিক্ষার্থীরাও মুখ ঘোরালে তার আঘাত সার্বিক ভাবে রাজ্যের শিক্ষায় পড়তে বাধ্য। মানবসম্পদ যেখানে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভর, সেই পরিস্থিতিতে এমন বিপদসঙ্কেত রাজ্য সরকার ঠিকমতো পড়তে পারছে কি?দেশে শিক্ষার বেহাল পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গেলে সাধারণত প্রথমেই আসে দুর্নীতির কথা। স্বাভাবিক, কেননা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি ভারতের শিক্ষাজগৎকে এক বিরাট বিপদের মধ্যে এনে ফেলেছে। কিন্তু এও ঠিক, যে দেশের কিছু কাল আগেও উচ্চশিক্ষার জন্য রীতিমতো আন্তর্জাতিক সুনাম ছিল, আজ তার উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের অত্যন্ত মলিন দশার কারণ কেবল দুর্নীতি নয়— নীতিও বটে! নীতি, এক অন্য অর্থে, প্রশাসনিক অর্থে।

জাতীয় শিক্ষা নীতির বিবিধ আশ্চর্য সংশোধনে ও প্রয়োগে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে যে কত রকমের পঙ্কিল আবর্ত তৈরি করা হয়েছে, তা এখনও গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে না। কিছু তথ্য ও সমীক্ষায় কেবল সেই কৃষ্ণশৈলের চূড়াটুকু দৃশ্যমান। তেমনই কিছু তথ্য বলছে— দেশের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষকদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের দ্বারা স্বীকৃত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র‍্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক বা এনআইআরএফ-এর তথ্য অনুয়ায়ী— ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে পূর্ণ সময়ের পিএইচ ডি কোর্সের জন্য ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। প্রধানত জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব হায়দরাবাদ, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি স্থানেই পিএইচডি গবেষকদের সংখ্যা বেশ ভালোরকম কমেছে। কেন এই সঙ্কোচন?

কেননা, পর পর একাধিক নীতি পরিবর্তনের ফলে পাল্টে গিয়েছে গবেষণা করাতে সক্ষম অধ্যাপকদের সংখ্যা। কত জনকে একই সময়ে গবেষণা করানো যায়, সেই সংখ্যাটি বেঁধে দেওয়া হয়েছে প্রতি স্তরে, অর্থাৎ সহকারী, সহযোগী ও পূর্ণ অধ্যাপকের স্তরে। এও বলে দেওয়া হয়েছে, যে অধ্যাপকের নিজের পিএইচ ডি ডিগ্রি নেই, তিনি কারও গবেষণা উপদেশক হতে পারবেন না। এই নীতিও নেওয়া হয়েছে যে প্রারম্ভিক স্তরে সহকারী অধ্যাপক হতে গেলে পিএইচ ডি না থাকলেও চলবে। ফলে বহু সহকারী অধ্যাপকই এখন আছেন যাঁরা পিএইচ ডি না করেই পড়াতে এসেছেন, ফলত পিএইচ ডি করাতে অক্ষম। সব মিলিয়ে, গবেষক ছাত্রদের সংখ্যাই যাচ্ছে কমে। জেএনইউ-এর কথাই যদি ধরা যায়, ২০১৬-১৭ সালে মোট ছাত্রছাত্রীর ৬২ শতাংশ ছিলেন গবেষক, যেখানে ২০২২-২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, গবেষকের সংখ্যা কমলে সমস্যা কোথায়? উত্তরটি দুই ভাবে দেওয়া সম্ভব। এক, তা কমানোই কি বর্তমান শিক্ষানীতির লক্ষ্য? যদি তা হয়, তবে আলাদা কথা। কিন্তু ঘটনা হল, ইউজিসি-র কোনও নীতি নির্দেশিকায় এ কথা নেই। সে ক্ষেত্রে বিষয়টিকে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের বদলে আপতিক বা ঘটনাচক্র হিসাবে দেখতে হবে। অর্থাৎ তা হলে এটি সরকারি উচ্চশিক্ষানীতির ব্যর্থতা। আরও অনেক মনস্ক নীতি প্রবর্তন জরুরি, নয়তো এমন অবাঞ্ছিত ঘটনা আরও ঘটতে পারে। দুই, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সারস্বত ভাবনাকে ক্রমশ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, উৎকর্ষের দিকে চালিত করা। অকারণে সে পথে ব্যাঘাত ঘটলে দেশের সার্বিক শিক্ষামান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভবিষ্যৎ উৎকর্ষের পথে নিতান্ত অকারণ বাধা তৈরি হয়। শিক্ষাপ্রশাসকরা কি তা-ই চান? তাঁরা কি আদৌ অবগত যে তাঁদের এলোমেলো নীতির ফলে কত রকম সঙ্কট তৈরি হয়ে উঠছে?

News Hub