আর্দ্র বাতাস থেকে বিদু্যৎ কি নতুন যুগের সূচনা করবে?

Written by SNS March 24, 2024 4:14 pm

অসীম সুর চৌধুরী
আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই পৃথিবী জুড়ে কয়লা ও খনিজ তেলের মতো চিরাচরিত জ্বালানির সংকট আসন্ন৷ যদিও সৌর বিদু্যৎ ও বায়ুচালিত বিদু্যতের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে কিন্ত্ত শুধুমাত্র এদের সাহায্যে ওই জীবাশ্ম জ্বালানির ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়৷ এই নিয়ে বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী সবাই খুব চিন্তিত৷ অনেক গবেষণা চলছে নতুন বিদু্যতের উৎস আবিষ্কারের৷ বছর তিনেক আগে এরকমই এক গবেষণার ফলাফল বিজ্ঞানীদের আশার আলো দেখিয়েছে৷ যেখানে বলা হয়েছে, জলীয় বাতাস থেকে বিদু্যৎ বানাবার হদিশ৷ যেমন আমরা বৃষ্টির সময় আকাশে জড়ো হওয়া মেঘপুঞ্জের মধ্যে বিদু্যৎ জমা হতে দেখি৷ আর্দ্রতা বা জলীয় বাতাস থেকে যদি আমরা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বিদু্যৎ তৈরি করতে পারি তবে সেটা এক নতুন যুগের সূচনা করবে৷ কীভাবে ভেজা বায়ু থেকে বিদু্যৎ তৈরি হচ্ছে আর এর ইতিহাসই বা কী? এটাই এখন বিশদে আলোচনা করব৷

১৭৫২ সালের ১৫ জুনের ঘটনা৷ আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের আকাশে মেঘের ঘনঘটা৷ ঝড়বৃষ্টিও শুরু হয়েছে৷ সবাই যখন নিজেদের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি তাঁর ছেলেকে সঙ্গে করে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন৷ আকাশে তখন ঘনঘন আলোর ঝলকানি, আর সঙ্গে বজ্রপাতের শব্দ৷ ওই ঘুড়িওয়ালা ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে অনেকে ভাবছিলেন, কে এই পাগল লোকটা যে এই আবহাওয়ায় ঘুড়ি ওড়াতে যাচ্ছে৷ আসলে ওই ভদ্রলোক ঘুড়ির সাহায্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করতে চাইছিলেন যা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে৷ ঝড়বৃষ্টির সময় আকাশে যে আলোর ঝলকানি ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়, তা যে বিদু্যতের কারণে ঘটে তখনও সেটা জানা ছিল না৷ কিন্ত্ত সেই ভদ্রলোক এটাই ধারণা করেছিলেন৷ তাঁর তৈরি ঘুড়িটা ছিল একটু অদ্ভূত ধরনের৷ বিরাট বড় ঘুড়িটা ছিল সিল্কের তৈরি আর কাঠামোটা লোহার তার দিয়ে বানানো৷ সুতোগুলো ছিল সিল্কের৷ একটা শেডের নীচে দাঁড়িয়ে সেই ভদ্রলোক ঘুড়িটাকে অনেক উঁচুতে পাঠিয়ে দিলেন, প্রায় নিকটতম মেঘের কাছাকাছি৷ তিনি একটা ধাতব চাবি কাছাকাছি সুতোর সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন৷

সিল্ক ও ধাতু উভয়ই বিদু্যৎ পরিবাহী, আর ভেজা অবস্থায় আরও বেশি৷ তাই মেঘের থেকে বৈদু্যতিক চার্জ ঘুড়ি ও সুতোর মাধ্যমে চাবিতে জমা হচ্ছিল৷ এটা অনুমান করে সেই ভদ্রলোক ওই চাবিটাতে হাত ছোঁয়ালেন৷ আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল দুর্ঘটনা৷ প্রচণ্ড বৈদু্যতিক শক খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলেন৷ কিন্ত্ত এই দুর্ঘটনায় তিনি যে শারীরিক কষ্ট পেয়েছিলেন, তাকে ছাড়িয়ে গেল তার মানসিক আনন্দ৷ কারণ সেই ঘটনার ফলে প্রমাণ করা গেল যে মেঘের মধ্যে জলীয় বাতাস থেকে বিদু্যৎই তৈরি হয়৷ সেই ভদ্রলোক ছিলেন একই সঙ্গে বিজ্ঞানী, লেখক, প্রকাশক, কূটনীতিক, দার্শনিক প্রভৃতি নানা গুণের অধিকারী৷ তিনি হলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন৷

পরে নানা গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, মেঘমুক্ত আকাশে আলোর ঝলকানি হলে যে বিদু্যৎ উৎপন্ন হয় তা কিন্ত্ত আমাদের ব্যবহূত বিদু্যতের থেকে আলাদা৷ সাধারণত আমরা বাড়িতে ২২০ ভোল্ট পরিবর্তিত প্রবাহ (এসি) ব্যবহার করি কিন্ত্ত মেঘের মধ্যে উৎপন্ন বিদু্যৎ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে৷ তবে এই বিদু্যৎ চরিত্রগতভাবে ডিসি অর্থাৎ সমপ্রবাহ৷ দেখা গেছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকের তাপমাত্রা নীচের তুলনায় কম থাকে৷ এই কারণে বেশিরভাগ সময়ে নীচ থেকে উপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়৷ উপরে ওঠার সময়ে মেঘের মধ্যে জলকণাগুলোর আকার বাড়তে থাকে৷ জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় এর অণুগুলো আর পারস্পরিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না৷ এরা তখন আলাদা হয়ে যায় এবং বৈদু্যতিক আধান বা ভোল্টেজের সৃষ্টি হয়৷ উপরে ভোল্টেজের মান নীচের অংশের চেয়ে বেশি হয় এবং একটা ভোল্টেজের পার্থক্য দেখা দেয়৷ এই কারণে উপর থেকে নীচের দিকে প্রচণ্ড বিদু্যৎ প্রবাহ ছুটে যায় যা আকাশে তীব্র আলোর ঝলকানি ও বজ্রপাতের সৃষ্টি করে৷

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ঘুড়ি পরীক্ষার অনেক যুগ পরে আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী ‘নিকোলা টেসলা’, যাঁকে আধুনিক এসি বিদু্যৎ ব্যবস্থার রূপকার বলা হয়, আর্দ্র বাতাস থেকে বিদু্যৎ বানাবার উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন৷ জলীয় বাতাস থেকে বিদু্যৎ তৈরি হওয়াকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘হাইগ্রো ইলেকট্রিসিটি’৷ কিন্ত্ত টেসলা তাঁর জীবদ্দশায় এই কাজটা করে উঠতে পারেননি৷ তাঁর মৃতু্যর (১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি) পরে কয়েক দশক ধরে এই ব্যাপারে গবেষণা আর খুব বেশি এগোয়নি৷

বিজ্ঞানী টেসলার মৃতু্যর প্রায় সাতাত্তর বছর পরে ‘হাইগ্রো ইলেকট্রিসিটি’ আবার খবরের শিরোনামে চলে এল৷ ২০২০ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জুন ইয়াও এবং একজন মাইক্রো বায়োলজিস্ট ডেরেক লাভলি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন৷ তাতে বলা হয়েছে, ওই গবেষকদেরদল এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া (যার নাম জিও ব্যাকটর) থেকে অতি ক্ষুদ্র প্রোটিন তার বানিয়েছেন৷ এই প্রোটিন বস্ত্তটার মধ্যে খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেক গর্ত আছে যা জলীয় বাতাস থেকে জলকণা নিয়ে তাদের আটকে রাখে৷ ওই জলকণা ও প্রোটিন বস্ত্তর মধ্যে ঘষা লাগলে জলের অণু থেকে চার্জ বার হতে থাকে৷ এইভাবে একসময় তারের মধ্যে দুটো স্তরে চার্জ জমা হয় (পজিটিভ ও নেগেটিভ) এবং তাদের মধ্যে বিভব পার্থক্য তৈরি হয়৷ ফলে বিদু্যৎ চলাচল শুরু হয়, তবে খুবই সামান্য পরিমাণে৷

জুন ইয়াও এবং তাঁর সহযোগীরা ২০২৩ সালে উপরের পরীক্ষাটা আরও বিশদভাবে করলেন৷ তাঁরা কাঠের অাঁশ, পলিমার, গ্রাফিন অক্সাইড ইত্যাদি দিয়ে একটা কাঠামো বানিয়েছিলেন যা মানুষের চুলের থেকেও সরু৷ এই কাঠামোটাতেও অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচুর গর্ত তৈরি করা হয়েছিল৷ এই ব্যবস্থায় বাতাসে মাত্র ২০% আর্দ্রতা থাকলেই বিদু্যৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে৷ তবে তা খুবই কম৷ এর পরিমাণ এক ভোল্টেরই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ৷ তবে ওই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এই পরীক্ষাটা আরও বড় আকারে করলে কয়েক ভোল্ট বিদু্যৎ পাওয়া যেতে পারে, যার সাহায্যে ছোট কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র চালানো সম্ভব৷

আর্দ্র বাতাস থেকে বিদু্যৎ তৈরির ব্যাপারে আরও কিছু দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছেন৷ যেমন, ইজরায়েলের একদল বিজ্ঞানী দুটো ধাতব পাতের মধ্যে ভেজা বাতাস প্রবাহিত করে বিদু্যৎ উৎপাদনে সফল হয়েছেন৷ ধাতব টুকরো দুটোর মধ্যে আর্দ্র বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় তাতে বৈদু্যতিক চার্জ উৎপন্ন হচ্ছিল৷
এই ধরনের আর একটা গবেষণা চালাচ্ছেন পর্তুগালের এক বিজ্ঞানীর দল৷ এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিজ্ঞানী সঙিৎলানা লু্যবচিক৷ তাঁরা প্রায় দেড় ইঞ্চি ব্যাসের একটা চাকতি বানিয়েছিলেন যা ‘জারকোনিয়াম অক্সাইড’ দিয়ে তৈরি৷ এই চাকতি ভেজা হাওয়া থেকে জলের অনুগুলো শুষে নিয়ে একটা চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করে৷ এরকম দুটো চাকতি দিয়ে প্রায় ১.৫ ভোল্ট বিদু্যৎ তৈরি হয়, যা দিয়ে একটা এলইডি লাইট জ্বালানো সম্ভব৷ তবে এই বিজ্ঞানী দলের আশা, চাকতির সংখ্যা বাড়িয়ে আরও বেশি বিদু্যৎ পাওয়া যেতে পারে৷

তবে আর্দ্র বাতাস থেকে বিদু্যৎ উৎপাদনের এগুলো ছিল সব প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের মতে, আরও অনেক গবেষণা করতে হবে যাতে এই প্রযুক্তি দিয়ে প্রচুর বিদু্যৎ উৎপাদন করে কারখানা বা গাড়ি চালানো সম্ভব হয়৷ যদি গবেষণা সফল হয় তবে আগামী দশকে আমরা বিদু্যতের এক নতুন উৎসের সন্ধান পাব যা ‘হাইগ্রো ইলেকট্রিসিটি’ নামে পরিচিত৷ আমাদের দৈনন্দিন বিদু্যৎ চাহিদার জন্য তখন আর জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি) উপর নির্ভর করতে হবে না৷