নিশীথ সিংহ রায়
আজকের দিনে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মায়ানমার এই চারটি দেশ থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পাঁচজনের সামাজিক গুরুত্ব কতটা? পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ত্রিশ শতাংশের ওপর মানুষ এখানে বাস করে। সেই জনসংখ্যার অনুপাতে শান্তিতে নোবেল পাওয়া খুবই কম। এমনিতেই এই চারটি দেশ বা এশিয়ার জনসংখ্যার অনুপাতে নোবেল প্রাপক মানুষের সংখ্যাই খুব কম। ১২৫ বছরের নোবেলের ইতিহাসে আমেরিকা বা ইউরোপের আধিপত্যের কাছে এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশে নোবেল প্রাপ্তির সংখ্যা নগণ্য। যাইহোক আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এই চারটি দেশের শান্তিতে নোবেল পাওয়া ব্যক্তিরা কি সত্যিই স্ব স্ব দেশে পূজিত? তাঁদের গ্রহণযোগ্যতাই বা কতটা স্বভূমিতে? নোবেল প্রাপ্তির পূর্বে সমাজে তাঁদের অবদান? নোবেল প্রাপ্তির পরে তাঁদের সামাজিক আবেদন? তাঁরা স্ব ক্ষেত্রের মাধ্যমে সমাজে কতটা আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন বা প্রাপ্তির পরে কতটা পেরেছেন? সরাসরি কিছু না বলে তাঁদের সম্বন্ধে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে জনমানসে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা। বলতে গেলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ব্যপারটাকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখে। হ্যাঁ, বিরাট এই পৃথিবীর আটশো কোটির জনসংখ্যার কে কোথায় কোন ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের চিহ্ন রাখলেন তা খোঁজা একটু কষ্টকর বইকি। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে হয়ত অনেক কিছুই সহজে জানা গেলেও আবার এরমধ্যে গোঁজামিল হবার সম্ভাবনাও প্রবল।
ভারতের দুই জন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মায়ানমার থেকে একজন করে মোট পাঁচজন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতের মাদার টেরেজা ১৯৭৯ ও কৈলাশ সত্যার্থী ২০১৪ সালে। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই, কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে একই বছরে মাত্র সতের বছর বয়সে শান্তিতে নোবেল পান। বাংলাদেশের ড. মুহম্মদ ইউনুস ২০০৬ সালে এবং মায়ানমারের অং সান সু চি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমার মতে শান্তিতে এই যে পাঁচজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তার মধ্যে শিক্ষা, গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা বা নিজ কাজের মাধ্যমে সমাজে আলোড়ন তোলা সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ড. ইউনুস অন্য সবার থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে। এটা কেউ মানুক আর না মানুক এটাই বাস্তব সত্য। হ্যাঁ, এটাও সত্য তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সরাসরি কোনো সম্পর্কই নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের দৌলতে গ্রামীণ মহিলারা স্বনির্ভর হয়েছেন বা স্বচ্ছলতা অর্জন করেছেন। সেক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মহিলাকে স্বনির্ভর করার অবদানস্বরূপ তাঁর সংস্থা নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। দুঃস্থ মহিলাদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করা বা উন্নতি করাকে শান্তি না অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি বোঝায়? এটা তো ড. ইউনুসের বিরাট অর্থনৈতিক সাফল্য। তাই নয় কি? সেখানে শান্তিতে কেন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন? শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েও ড. ইউনুস একটা সমস্যার মধ্যে আছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রথম কেউ নোবেল পুরস্কার পেলেন তাই সেখানে উচিত ছিল তাঁকে মাথায় করে রাখা। কিন্ত বাস্তবে তা হয়নি। কারণ মুসলিম দুনিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশে সুদ নেওয়া ও দেওয়া ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী ঘোর অন্যায়। এককথায় তা হারাম। তাই আগস্ট আন্দোলনের আগে পর্যন্ত ইউনুস বাংলাদেশের মানুষের কাছে পূজিত ছিলেন না। এখনও অনেকে এই নিয়ে অবিরত প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষ নোবেল কমিটির কাছে অনুরোধ করেছে, যেন ড. ইউনুসের নোবেল প্রত্যাহার করা হয়।
এব্যাপারে তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলির কাছেও অনুরোধ করেছেন যাতে তারা নোবেল কমিটিকে চাপ সৃষ্টি করে নোবেল প্রত্যাহারের জন্য। আর একটা কথা বলি যেটা হয়ত কাকতালীয়। যা হল অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া ভারতীয় দুই অর্থনীতিবিদের সঙ্গে ইউনুসের একটা অদ্ভুত মিল আছে। এক, তিনজনই দুটো করে বিয়ে করেছেন। দুই, যার একটি খ্রিস্টান অপরটি স্বধর্মের। তিন, তিনজনই নোবেল পেয়েছেন দ্বিতীয় বিয়ে করার পরে। এখানে একটিই তফাত ভারতীয় দুই জন আগে স্বধর্মীয় বিয়ে করে তাদের ডির্ভোস দিয়ে পরে খ্রিস্টান বিয়ে করেছেন। তারপর তাঁরা অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর ড. ইউনুস আগে খ্রিস্টান বিয়ে করে পরে তাঁকে ডির্ভোস দিয়ে স্বধর্মে বিয়ে করেছিলেন এবং তারপর তাঁর শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি। আর সত্যি বলতে কি ড. ইউনুসেরই অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার কথা। এব্যাপারে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া দুই ভারতীয়ের থেকে অনেক অনেক বেশি যোগ্য। কারণ, ভারতীয় দুই অর্থনীতিবিদ সেই অর্থে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিপ্লব দূর অস্ত কোনো আলোড়নই তৈরি করতে পারেননি। ড. ইউনুস তো আবার বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান। তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে ড. ইউনুসের বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে গ্রহণ যোগ্যতা ততটা না থাকলেও বিশ্বব্যাপী কিন্ত তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে।
এবার বাকি চারজন শান্তিতে নোবেল প্রাপকের অবস্থা বিশেষত সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান দেখি। প্রথম মাদার টেরেজাকে দেখি। ১৯১০ সালে আলবেনিয়া রাজ্যের স্কপিয়েতে তাঁর জন্ম। ১৯২৮ সালে আয়ারল্যান্ডের হয়ে ভারতে আসেন খৃষ্ট ধর্মের প্রচারক হিসেবে এবং এব্যাপারে তিনি বা ক্যাথলিক সম্প্রদায় গর্ব করতেই পারেন। তখন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে তিনি একটা বিরাট সংখ্যক মানুষকে খ্রিস্ট ধর্মে নিয়ে আসতে সফল হয়েছেন। আর সমাজের উন্নয়ন? একটা প্রশ্ন রাখছি আপনাদের কাছে, খ্রিস্টান ছাড়া আর কোন সম্প্রদায়ের মানুষকে তিনি অকাতরে সাহায্য করেছেন? অখৃষ্টান কতজন তাঁর বা তাঁর সংস্থা থেকে সাহায্য পেয়েছেন? হ্যাঁ, এটা সত্য সমাজের একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে তিনি সাহায্য করেছেন কিন্তু সামগ্রিক সমাজকে নয়। আসি ভারতের দ্বিতীয় কৈলাশ সত্যার্থীর ব্যাপারে। তিনি অবশ্যই শিশু শ্রমিক ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন কিন্ত তাঁর কি সেই কাজ ভারতীয় সমাজে বিরাট আলোড়ন তুলতে পেরেছে বা বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজে তাঁর কি বিরাট অবদান আছে? পাঠকই এর বিচার করুন। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই-এর নোবেল প্রাপ্তির কথা এলে আমার আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নোবেল প্রাপ্তির ঘটনা মনে পড়ে যায়! পাঠককুলকে অনুরোধ আপনারা দু’জনের নোবেল প্রাপ্তির ঘটনা একটু পড়ে নিন। আমার যেন মনে হয় এটা নোবেল কমিটির তরফ থেকে শান্ত্বনা পুরস্কার। একজন ভারতীয় তো আর একজন পাকিস্তানী। আর বাকি মায়ানমারের অং সান সু চি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে তিনি সমাজসেবক হিসেবে মায়ানমারে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি সত্যিই একা সমাজে একটা আলোড়ন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এব্যাপারে বলতে পারি এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ড. ইউনুসের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্ত বর্তমানের প্রেক্ষিতে তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক? সেটা ইতিহাস বলবে? তাই প্রশ্ন, নোবেল পুরস্কারের মত এত ঐতিহ্যবাহী ও আভিজাত্যপূর্ণ পুরস্কারের কি সত্যিই সঠিক ব্যবহার হয়েছে?