• facebook
  • twitter
Sunday, 27 July, 2025

মোদি সরকারের জাতগণনার সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কি ভোটের অঙ্ক?

'পদ্ধতিগত ত্রুটি'র কারণে কলকাতা হাই কোর্ট প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করে দিয়েছে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পুলক মিত্র

জনগণনার সঙ্গে জাতগণনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু কবে এই গণনা হবে, সে সম্পর্কে কোনও সময়সীমার কথা জানায়নি কেন্দ্র। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ১০ বছর অন্তর দেশের জনসংখ্যা গণনা হওয়ার কথা। দেশে শেষবার জনগণনা হয়েছিল ২০১১ সালে। কোভিডের কারণে ২০২১-এ জনগণনা করা যায়নি। অর্থাৎ বিগত ১৪ বছরে দেশের জনসংখ্যা কত বেড়েছে, সে সম্পর্কে এই মুহূর্তে সঠিক কোনও তথ্য সরকারের কাছে নেই।

এত দিন ধরে রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, এম কে স্ট্যালিন, অখিলেশ যাদবের মতো বিরোধী নেতারা জাতগণনার (কাস্ট সেনসাস) দাবি তুলে আসছিলেন। এবার কেন্দ্র সেই দাবিতে সিলমোহর দেওয়ায় রাজনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে কৌতূহল, উঠে আসছে নানা প্রশ্ন, জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন সংশয়ের।

কেন এই জাতগণনা?
যাঁরা জাতগণনার পক্ষে, তাঁরা মনে করেন, আধুনিক ভারত গড়ে তুলতে হলে, জাতগণনা একান্ত আবশ্যক। ২০১১-১২ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘সাধারণ’ শ্রেণিভুক্ত মানুষের তুলনায় তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং ওবিসি শ্রেণিভুক্তদের গড় ব্যয় অনেক কম। ২০১৫-১৬র জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা গেছে, অন্য সাধারণ শ্রেণিভুক্ত মানুষের ১৫.৬ শতাংশের তুলনায় এসসি (৫০.৬%), এসটি (৩৩.৩%) এবং ওবিসি (২৭.২%) শ্রেণির দারিদ্র্যের হার বেশি। মুসলিমদের মধ্যেও দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি।

অসাম্য রয়েছে শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রেও। সাধারণ শ্রেণিভুক্তদের মধ্যে স্নাতকের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তাঁরা নিয়মিত মাসিক বেতনের চাকরি করে থাকেন। অন্যদিকে, এসসি, এসটি এবং ওবিসি শ্রেণিভুক্তরা শ্রমনির্ভর কাজে বেশি সংখ্যায় যুক্ত। জাতগণনার সমর্থকদের মতে, জাতগণনা হলে, অসাম্যের অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ্যে আসবে।

জাতগণনার ইতিবৃত্ত
ভারতে জাতগণনা নতুন কোনও বিষয় নয়। ১৮৮১ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত জনগণনার সময় জাতগণনাও করা হয়েছিল। সেখানে সমাজে উচ্চ শ্রেণির মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তির ছবি ধরা পড়ে। নিম্নশ্রেণির মানুষের আন্দোলনের ফলে কিছু কিছু অঞ্চলে সংরক্ষণ চালু হয়। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় এই ধরনের জাতপাতের বিভেদ দেশে বিভাজন তৈরি করবে, এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে।

সেসময় মুসলিম লিগ মুসলিমদের পৃথকভাবে সংগঠিত করতে শুরু করে। মহাত্মা গান্ধী দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর তীব্র বিরোধিতা করেন। কারণ, তাঁর আশঙ্কা ছিল, এতে হিন্দু সমাজে ভাঙন দেখা দেবে। অন্যদিকে, আম্বেডকর সহ অন্যান্য সমালোচকরা মনে করতেন, স্বাধীনতা মানে শুধুমাত্র ব্রিটিশদের থেকে অভিজাত উচ্চশ্রেণির মানুষের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটবে মাত্র, জাতিগত বঞ্চনার অবসান হবে না।

তাঁদের আশঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫১তে প্রথম জনগণনায় জাতগণনা বন্ধ করে দেয় জহরলাল নেহেরুর সরকার। যুক্তি ছিল, জাতগণনা হলে, সমাজে বিভাজন তৈরি হবে। ব্যতিক্রম ছিলেন এসসি এবং এসটি শ্রেণিভুক্তরা। কারণ, সংবিধানে তাঁদের উত্তোরণের জন্য নীতি গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল।

১৯৫৩ সালে কাকা সাহেব কালেলকর কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৫৫তে কমিশন রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে ২,৩৯৯টি অনগ্রসর শ্রেণি চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে ৮৩৭টি ছিল ‘অত্যন্ত অনগ্রসর’। রিপোর্টে বেশ কিছু সুপারিশ করা হলেও, শেষ পর্যন্ত সেগুলি কার্যকর করা হয়নি। সরকারি স্তরে নানা জট থাকলেও, ওবিসি-দের নিয়ে কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন সমাজবাদী নেতা রাম মনোহর লোহিয়া এবং কৃষক নেতা চৌধুরী চরণ সিং। তৈরি হয় জনতা পার্টি। ১৯৭৭-এর নির্বাচনে পরাজিত হন ইন্দিরা গান্ধী। অনগ্রসরদের অবস্থা খতিয়ে দেখতে ১৯৭৮-এ মণ্ডল কমিশন তৈরি করে জনতা সরকার।

মণ্ডল কমিশন ১৯৮০তে রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে ভারতের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশকে অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট ৫০% সংরক্ষণের সীমা বেঁধে দেয় (কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এসসি/এসটি-র জন্য ২২.৫% এবং ওবিসি-র জন্য ২৭%)।

১৯৯০-এ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকার এই সুপারিশ কার্যকর করতে গেলে, দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বলা হয়,এতে ‘মেধার মৃত্যু’ হবে। তবে এই আন্দোলনের ফলে দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসি পার্টি তৈরি হয় এবং সংসদ ও বিধানসভাগুলিতে ওবিসি-ভুক্তদের প্রতিনিধিত্ব বাড়তে থাকে।

২০১১তে জনগণনার পাশাপাশি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার আর্থ-সামাজিক এবং জাতগণনার সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও এই জাতগণনার তথ্য কখনও প্রকাশ্যে আনা হয়নি। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের ক্ষমতায় আসার পিছনে রয়েছে হিন্দু ওবিসি ভোট (ভোটের হার ২০০৯-এর ২২% থেকে বেড়ে ২০১৯-এ ৪৪ শতাংশে পৌঁছে যায়)। ওবিসি-র পাশাপাশি বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে রয়েছে উচ্চ-শ্রেণিভুক্তরাও।

চলতি বছরের শেষদিকে বিহারে বিধানসভার নির্বাচন রয়েছে। আগামী বছর বাংলা, আসাম এবং কেরলেও বিধানসভা ভোট। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কি এই জাতগণনার তোড়জোড়?

২০২৩-এ বিহারে নীতীশ কুমার সরকারের প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, ওই রাজ্যে ১৩.৭ কোটি মানুষের মধ্যে ওবিসি (২৭%) এবং ইবিসি (৩৬%) ভুক্তের মিলিত হার হল ৬৩.১৩%। এছাড়া, সাধারণ ১৫.৫%, এসসি ১৯.৬৫% এবং এসটি রয়েছেন ১.৬৮% । সমীক্ষায় দুর্দশার ছবিও তুলে ধরা হয়েছে। ৩৪.১৩ শতাংশ মানুষের আয় মাসে ৬ হাজার টাকার কম এবং শিক্ষার হারও খুব খারাপ (মাত্র ৭% স্নাতক)।

তেলেঙ্গনায় ২০২৩-এ কংগ্রেস জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর জাত-সমীক্ষা চালায়, যা ২০২৪-এ সমাপ্ত হয়। তাতে দেখা যায়, ৩.৫৪ কোটি মানুষের মধ্যে অনগ্রসর শ্রেণি ৫৬.৩৩% (১০.০৮% মুসলিম অনগ্রসর সহ), এসসি ১৭.৪৩%, এসটি ১০.০৮% এবং অন্যান্য শ্রেণি ১৫.৭৯% (২.৪৮% অন্যান্য শ্রেণির মুসলিম সহ।

কর্নাটকে সিদ্দারামাইয়া সরকার ২০১৫তে আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা সমীক্ষা চালায়। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে এই সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করা হয়। রিপোর্ট নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। প্রভাব হারানোর ভয়ে লিঙ্গায়েত এবং ভোক্কালিগা সম্প্রদায় এই সমীক্ষার পদ্ধতিগত দিক এবং তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। রিপোর্টে ওবিসি-ভুক্তদের সংরক্ষণের হার ৩২% থেকে বাড়িয়ে ৫১% করার সুপারিশ করা হয়।

জাতগণনায় মূল ক্ষেত্র হল, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি), যা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণনায় তফসিলি জাতি (এসসি), তফসিলি উপজাতি (এসটি) অংশের মানুষের সংখ্যা, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনধারণের মান সম্পর্কে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু ওবিসির বিষয়টি সাধারণ জনগণনায় থাকে না। সে কারণেই গত কয়েক বছর ধরে জাতগণনার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল।

জাতগণনার সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনীর বলেছেন, “কয়েকটি রাজ্য জাতিগত তথ্যসংগ্রহের জন্য সমীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু এক একটি রাজ্য এক একরকমভাবে সমীক্ষা চালিয়েছে। কোনও অভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।” পশ্চিমবঙ্গে ওবিসির সংখ্যা খুব একটা কম নয়। এমন অনেক পদবির মানুষ রয়েছেন, তাঁরা ওবিসিভুক্ত হওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন।

২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইস্তাহার প্রকাশের সময় বলেছিলেন, মাহিষ্য, তিলি, তামুল এবং সাহাদের ওবিসি তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিসভায় এই সংক্রান্ত প্রস্তাবও তিনি পাশ করিয়েছিলেন।

‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’র কারণে কলকাতা হাই কোর্ট প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করে দিয়েছে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য।

নতুন সমীক্ষার জন্য রাজ্যের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে তিন মাস সময় চাওয়া হয়েছে। আগামী জুলাই মাসে সেই মামলার পরবর্তী শুনানি। এরই মধ্যে কেন্দ্রের এই ঘোষণা রাজ্যের উপর বাড়তি ‘চাপ’ তৈরি করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। তৃণমূল অবশ্য বিষয়টিকে ‘চাপ’ বলে মানছে না। বরং কেন্দ্রের জাতগণনার সিদ্ধান্তকে ‘ভোটের অস্ত্র’ হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছে তৃণমূল।

বাংলায় বর্তমান রাজনীতির যে বিন্যাস, তাতে বিজেপি এবং তৃণমূল জাতগণনাকে দু’ভাবে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। গত লোকসভার নির্বাচনে মতুয়া, রাজবংশী ভোট ধরে রাখতে পেরেছে বিজেপি (যদিও কোচবিহার আসন হারাতে হয়েছে বিজেপি-কে)। অন্যদিকে, আবার পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী প্রভাবিত এলাকায় বিজেপির যে আধিপত্য ছিল, গত লোকসভা নির্বাচনে তাতে ভাঙন ধরিয়েছে তৃণমূল। ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার মতো আসনে তারা জিতেছে।

স্বভাবতই আগামী জনগণনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে জাতগণনা। তবে কিছু প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। প্রথমতঃ অনিশ্চিত সময়সীমা। পরবর্তী জনগণনা কখন হবে? এই বিলম্বের মাশুল গুনতে হবে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপকদের। এখনও ২০১১-এর পুরনো পরিসংখ্যান মেনে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর করা হচ্ছে। এর ফলে বাদ পড়ছেন সম্ভাব্য বহু সুবিধাপ্রাপক।
দ্বিতীয়ত, জাতিগণনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পদ্ধতিগত দিক। বিশেষজ্ঞরা আদমসুমারি আইন সংশোধন, প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ, সতর্কতার সঙ্গে প্রশ্ন পত্র তৈরি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

তৃতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, তথ্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা। জাতিগত পরিসংখ্যান কি জনসমক্ষে আনা হবে?
চূড়ান্ত বিষয় দিক হল, এর রাজনৈতিক এবং নীতিগত প্রভাব। জাতগণনার পর আবার উঠে আসবে সংরক্ষণের প্রসঙ্গ, যা অতীতের মতো দেশজুড়ে তীব্র অশান্তি ডেকে আনবে না তো?