যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৮তম বর্ষে এসে প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির ঝুলিতে দেখলে বোঝা যায়, কিছু আশা পূর্ণ হয়েছে, কিছু আশা এখনো রয়ে গেছে অপূর্ণ। স্বাধীনতার আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগে দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছিল অনেক তরুণ তুর্কি। উদ্দেশ্য একটাই দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করা এবং দেশকে তার জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন ফিরিয়ে দেওয়া। তাঁদের সেই পথের পথিক হয়েছে অনেকে। দেশ আজ স্বাধীন হয়ে যাবার পরও এই পথের পথিকের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাদের আদর্শ ছড়িয়ে রয়েছে সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত কোন তরুণ কিংবা জার্মানির গবেষণাগারে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মহৌষধের সন্ধানী কোন তরুনীর চোখে। এদের দায়িত্ব ও লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে দেশকে জগত সভায় শ্রেষ্ঠত্বের আসল ফিরিয়ে দেওয়া এবং দেশকে স্বনির্ভর করে তোলা।

একসময় (প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস) ঘাঁটলে দেখা যায় সমগ্র পৃথিবীর মোট আয় এর সিংহভাগ আসতো তৎকালীন ভারতবর্ষ থেকে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত আছে সেই সময়ে ভারতীয়দের প্রতিদিনের খরচের একটা আভাস। যা আজকের দিনের অনেক উন্নত দেশের consumerism কেও হার মানিয়ে দেয়। আর সঞ্চয়ের ইতিহাসের পাঠ তো সমগ্র পৃথিবী নিয়েছে প্রাচীন ভারতবর্ষের থেকে। তারপর ব্রিটিশদের হাতে ভারতবর্ষের অর্থনীতির দৈন দশা সবারই জানা। মন্বন্তর, বেকারত্ব, দাঙ্গা অত্যাচার, ভারতীয় অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা কৃষকদের সংকট এবং সর্বোপরি দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাবে দেশভাগের আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভারতীয় অর্থনীতির জয় পতাকা। তারপর আসে বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা। প্রধানত গণতন্ত্র, সংবিধানের প্রয়োগ এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার হাত ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে ভারতবর্ষ। প্রথমদিকে গতি একটু মন্থর হলেও ১৯৯০ সালের পর থেকে ভারতীয় অর্থনীতি ছুটতে শুরু করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে। অনেক আশা পূর্ণ হয় আবার অনেক স্বপ্ন পূরণ করতে চলে নিরন্তর প্রচেষ্টা । আশা একদিনে না হোক, কোন একদিন কিন্তু পূর্ণ হবে সেইসব স্বপ্ন।


ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন কারণে প্রথম দিকে থমকে থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। যার একটা প্রধান কারণ হলো মেন্টাল সেটআপ। দীর্ঘদিন ব্রিটিশদের গোলামী করে আমরা ভুলতে বসেছিলাম ‘আমরাও পারি’ কথাটি। তারপর থেকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারের ফলে আস্তে আস্তে আমাদের চিন্তা শক্তি উন্নত হয়েছে। গোলামী করার মানসিকতা ভুলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বেশ কিছু তরুণ তরুণী বিশ্বাস করেছেন ‘বাণিজ্যে বসত লক্ষ্মী’র মূলমন্ত্রটি। পরবর্তী পর্যায়ে সেই মন্ত্র দীক্ষিত হয়েছে অনেক তরুণ, তরুণী। স্বাধীনতার সময় আমাদের শিল্পের ভিত ছিল ভীষণ নড়বড়ে। ভারতবর্ষের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ কাজ করতো বিভিন্ন শিল্পে। বেশিরভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য। আমদানিনির্ভর ছিল ভারতীয় অর্থনীতি।

জিডিপির বৃদ্ধির হারও ছিল খুব কম যা প্রায় ০.৫ শতাংশ। ফলস্বরূপ আমরা দেখেছি ব্যাপক দারিদ্র এবং জীবনযাত্রার মানের করুন অবস্থা করুন অবস্থা। তারপর থেকে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে এবং সরকারের শিল্পনির্ভর সহায়ক নীতির জন্য ভারতবর্ষের শিল্প উন্নতির পালে আস্তে আস্তে হাওয়া লাগতে শুরু করে। বাদ যায়নি কৃষিও। আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ যথেষ্ট প্রশংসনীয়। ফলে সমগ্র জাতীয় আয়ের অংকটাও বাড়তে শুরু করে। ১৯৬০ সালে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় প্রায় ৫.৫%। সংখ্যার দিক দিয়ে সমগ্র জাতীয় আয় ৩৬ বিলিয়ন ডলারকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ আসে অন্য জায়গা থেকে। জাতীয় আয় বাড়ার ফলে একশ্রেণির মানুষের হাতে আসতে শুরু করে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ আর আরেক শ্রেণির মানুষ থেকে যায় সেই তিমিরেই। সমবন্টনের লক্ষ্যে সরকার নড়েচড়ে বসে। তারপর থেকে PerCapita Income-এর চিত্রটা বদলাতে শুরু করে। গ্রামনির্ভর অর্থনীতি আস্তে আস্তে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ৬০-এর দশকে কৃষিতে আসে সবুজ বিপ্লব। কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন এক ধাক্কায় অনেকটা উপরের দিকে উঠে আসে। কৃষিজাত দ্রব্যের রপ্তানিতে অনেকটা উপরের দিকে স্থান নিয়ে নেয় ভারতবর্ষ। কৃষকদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন কো-অপারেটিভ সোসাইটি তৈরি হয়। সর্বজনীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছুটা হলেও ভারতবর্ষ সফল হয়।

জাতীয় আয় বৃদ্ধির গতি হ্রাস পায় ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে এসে। ১৯৬৫ সালে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে সামান্য ঘুরে দাঁড়ায় অর্থনীতি, জিডিপি বৃদ্ধির হার হয় প্রায় ১.৬ শতাংশ। এই সময় জাতীয় আয় বৃদ্ধির কম হওয়ার কারণ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ, খরা, উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপযোগী নীতির অভাব। যুদ্ধের জন্য সরকারের খরচ অনেক বেড়ে যায়। দেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের অবস্থাও হয় সঙ্গীন। পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে Per Capita Income। আশির দশক থেকে ৯০-এর দশকে দেশের হাল ফিরতে শুরু করে। এই সময় দেশের সামগ্রিক জিডিপির বৃদ্ধির হার হয় প্রায় ৫.৫%। এই দশকে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ হয় ১৯৮৮ সালে, প্রায় নয় শতাংশের বেশি হারে বাড়তে থাকে ভারতের জাতীয় আয়। তারপর আসে ৯০ এর দশক। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে আসে অর্থনৈতিক বিপ্লব। ভারতবর্ষের উদার অর্থনীতির পথে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে। সমগ্র বিশ্বের কাছে বর্তমান ভারতবর্ষের অর্থনীতির সফলতার যে রূপ, তার বীজ বপন হয়ে যায় ১৯৯১ সালে। এই সময় ঢেলে অর্থনৈতিক সংস্কার করা হয়। এই সংস্কারগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা, বাণিজ্যে লাল ফিতের বাঁধনকে যথাসম্ভব কমানো এবং দেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহ প্রদান করা। ৯০-এর দশকের প্রথম দিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার সাময়িকভাবে ধাক্কা খেলেও উদার অর্থনীতির দৌলাতে ভারতবর্ষের অর্থনীতি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সমগ্র বিশ্বের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের মাধ্যমে ভারত বার্তা দেয় অর্থনৈতিক উন্নতির পরিমাপে ‘হাম কিসিসে কম নেহি’। তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের উন্নতি হয় চোখে পড়ার মতো।

২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় আয় প্রায় ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে। ২০০৭ সালে ভারতবর্ষের জাতীয় আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। এই সময়ে উন্নয়নের প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিশ্বায়ন। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি বাড়তে থাকে ছয় থেকে সাত শতাংশ হারে। ২০১৭ সালে ভারতবর্ষের অর্থনীতি ছুঁয়ে ফেলে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের তকমা। কেবল সাত বছরেই সামগ্রিক জাতীয় আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছন্দে কিছুটা হলেও সুর কাটে COVID 19-এর সময়। জিডিপি বৃদ্ধির হার হয় প্রায় -৫.৮ শতাংশ। দারুণভাবে জিডিপি ঘুরে দাঁড়ায় ২০২১ সালে, বৃদ্ধির হার হয় প্রায় ৯ শতাংশ। অনুকূল সরকারি নীতিতে ২০২২ সালে জিডিপির বৃদ্ধির হারের নিরিখে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের অর্থনীতি। সামগ্রিক জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির মূল কারিগর হয়ে ওঠে কৃষিক্ষেত্র, নির্মাণ শিল্প এবং পরিষেবা শিল্প। ২০২২ সালে ভারতবর্ষের অর্থনীতি ছুঁয়ে ফেলে আর এক মাইলস্টোন, সামগ্রিক জাতীয় আয়ের পরিমাণ হয়, প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার। এই সময় অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় পরিষেবা শিল্প। পরিষেবা শিল্পের মধ্যে নজর কাটে আর্থিক সেবা সংক্রান্ত শিল্প, ভ্রমণ, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এবং রিটেল।

জিডিপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমতে থাকে বেকারত্ব। এর প্রতিচ্ছবিও দেখতে পাওয়া যায় অর্থনীতিতে। বর্তমানে জাপানকে টেক্কা দিয়ে জিডিপির বিচারে ভারতবর্ষে স্থান চতুর্থ। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন ২০৩২ সালে এই জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে গিয়ে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারে। ভারতবর্ষের জিডিপির বাড়বাড়ন্ত হওয়ার মূল চালিকাশক্তি হল জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং পরিকাঠামোর উন্নতি।

যাই হোক, কিছুটা পূর্ণতা এবং কিছুটা অপূর্ণতা নিয়ে ৭৮ বছর ধরে এগিয়ে চলেছে ভারতবর্ষের অর্থনীতি। মূল কারিগর কিন্তু ভারতবর্ষের জনতা-জনার্দন। তাদের প্রাণান্ত পরিশ্রমের ফল আজকের প্রায় চার ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। যা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিও। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত Per Capita Income এর ট্র্যাকরেকর্ড বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় Per Capita Income এই ৭৮ বছরে বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি। যার মূল কাণ্ডারী কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম। সুতরাং সমস্যা থাকবে এবং তার সমাধানও করবে আমাদের নতুন প্রজন্ম। স্বাধীনতা উত্তর যুগে দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে অসংখ্য তরুণ-তরুণী যেমন দেশের কাজে ব্রতী হয়েছিল, এখনো নতুন প্রজন্মের চোখেও তারই প্রতিফলন। সেই অগ্নিযুগে যেমন তাঁদের হাতে পতন ঘটেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তেমনি বর্তমানের এই নতুন প্রজন্মের হাতেই হবে ভারতবর্ষের অর্থনীতির বোধন। জীর্ণ অর্থনীতিতে আসবে প্রাচুর্যের জোয়ার। জয় হিন্দ