• facebook
  • twitter
Wednesday, 9 July, 2025

সভ্যতার আজ ও কাল

মানুষটা অতিরঞ্জন করতে পছন্দ করেন, কিছু সময় তাল জ্ঞ্যান খুইয়ে আবোল তাবোল বলে বসেন বটে তবে মানুষটা মাঝে মধ্যে দু-একটা খাটি কথাও বলেন।

সুদীপ সরকার

এবারেও হোল না, বার বার তিন বার পরিকল্পনা করেও ফেল মারলাম বেমালুম। এখন আর আমার মনে এই নিয়ে কোন সংশয় নেই, পূন্য অর্জন সবার ভাগ্যে হয় না। একটু ঘুরিয়ে বললে, আপনার একাউন্টে যথেষ্ট পরিমানে পুণ্যি সঞ্চিত না থাকলে, আপনি শিব ক্ষেত্রে যেতে পারবেন না। এ অবিশ্যি আমার একান্ত ই নিজের মত, কোন পূন্যবান মানুষ এই নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আমার ওপর চড়াও হবেন না ধরে নিয়েই সাহস করে লিখলাম কথা গুলো। আসলে তিন তিন বার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে কার ই বা ভালো লাগে? অথচ নিয়ম মেনে মাস দুয়েক আগে ওপর ওয়ালাদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে রেখেছিলাম, দিন দশেকের ছুটি লাগবে; হেতু, কেদার যাত্রা। প্রথম বার ছুটি মিলেও গিয়েছিল কিন্তু গিন্নী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে যাত্রা রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছিল। এর পরের বার অফিস ছুটি দিল না, বন্ধু গ্রুপের শুভেন্দু, দেবাশিস আর নিলয় দিব্যি ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে পরল, পরে রইলাম কেবল আমি। বছর দুয়েক পর আবার স্থির করলাম, এবারে যেতেই হবে, বয়েস বাড়লে হাঁটুর কচকচ, মাজার টনটন এই সব উপেক্ষা করে তাঁর দর্শনে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে, হাড়ে মজ্জায় তেজ থাকতে থাকতে তাঁর চরণে একটিবার মাথা ঠুকে এলে জীবন সার্থক হয়। সব দিক ভেবে আবার দিলাম ঠুকে একটা পিটিশান কিন্তু এবারেও বাধ সাধল সেই অফিস। ছুটির দরখাস্ত পেয়েই বস ডেকে বললেন, ‘’আরে এত তাড়া কিসের, ওসব দিকে তো বয়েস কালে যায় মানুষ, এখন তো ভোগ করার সময় মশাই।

তাছাড়া দেখছেন তো, স্টাফ কি রেটে কমেছে, এত দিন কি করে ছাড়ি আপনাকে বলুন তো? বসের সঙ্গে তর্ক চলে না, মনে মনে ভাবলাম, এমনি সময় তো বলেন কিছু কাজ করি না, কাজই যখন করি না, ছুটি দিতে অসুবিধা কি? মুখে বৈকল্য ভাব এনে বললাম, ‘ঈশ্বর টানলে যাব একদিন, আপনার কথার ওপর তো আর কথা চলে না স্যার।‘ আমার ট্রিপ ক্যন্সেল হওয়ায় সব থেকে বেশি খুশি হোল আমার স্ত্রী, যিনি উঠতে বসতে আমাকে ইস্তিরি করে তবে শান্তি পান। আমি না থাকলেই তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পরে, খান তিনেক ঠিকে কাজের মানুষ ঘরকন্নার কাজে তাকে সাহায্য করার পরেও অবশিষ্ট যেটুকু থাকে তা নিস্পত্তি করার লোক তো বাঁধা মানুষ, সে জাঁতাকল টেনে টেনে গত পঁচিশটা বছরে আমার আধ বুড়ো হাড়ে কম কালী পরেনি, একবার এক্সরে করলেই সেই কালশিটে ফুটে উঠবে নিশ্চিত। আমি ব্যাজার মুখে বাড়ি ফিরতেই তাঁর বুঝতে দেরি হল না যে তৃতীয় বারের মত আমার পরিকল্পনাটি ভেস্তে গিয়েছে। কোন যোগ বলে জানিনা, মহিলারা এ ব্যাপারে পুরুষদের থেকে বেশি পারদর্শী। ভিতরের অট্টহাস গিলে নিয়ে তিনি ফুট কাটলেন, ‘’খুব ভালো হয়েছে তোমার ট্রিপটা বাতিল হয়ে, কি প্রতিকূল অবস্থা ওদিকে, যোশিমঠ, রুদ্রপ্রয়াগ সব জায়গায় মারাত্মক ধস নেমেছে, হাজার হাজার মানুষ আটকে পড়েছে, কি বিপদ বল দেখি!

তাছাড়া প্রায় পচিশ কিমি হেটে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা নাকি? রাস্তার হালও খুব খারাপ ! গোদের ওপর বিষ ফোড়া, এর মধ্যেই খান কয়েক হেলিকপ্টার প্যাসেঞ্জার সমেত রিমোট খেলনার মত পটাপট ভেঙে পড়ল যেখানে সেখানে। আমার তো হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসার জোগাড়!’
আমার গিন্নী মোটামুটি পৃথিবীর সমস্ত খবর রাখেন, সারাদিন ফেবু খুলে দেওয়াল থেকে দেওয়াল আর রিল থেকে রিল ঘুরে তিনি যা খবর সংগ্রহ করেন তার কাছে বিবিসি বা সি এন এন নিতান্তই শিশু বলা যায়। বিদেশ নীতি থেকে কূটনীতি, সমাজচেতনা থেকে রান্নাবান্না, কুকুরের বাচ্চার যত্ন করার কায়দা থেকে ইজরায়েলের গুপ্ত বাহিনী, সব কিছুতেই তাঁর উৎসাহ, বলা বাহুল্য, সৌজন্যে ফেবু। ইদানিং মেয়েরাও দেখছি পড়াশোনার পাট প্রায় লাটে তুলে মোবাইলের মজায় মজেছে। এই যন্ত্রটি যে আজকের প্রজন্ম কে কি সাংঘাতিক বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা নিয়ে আমরা নির্বিকার। এক সাইকলজিস্ট বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তাকে প্রতিদিন একাধিক বাচ্চা বা কিশোর বয়সের ছেলে মেয়েকে কাউন্সেলিং করতে হয় যাদের মূল সমস্যার গভীরে ওই মোবাইল আসক্তি। আমাদের অফিসের বাদলবাবুকে কেউ খুব একটা মুল্য দেয় না, মানুষটা নিজেকে জাহির করতে পছন্দ করেন, কারণে অকারণে চারটি মিথ্যে বুলি আওরে বড় সাজার মধ্যেই যেন তাঁর সব আনন্দ। আড়ালে আবডালে লোকে তাকে বাতেলা বাবু বলে।

মানুষটা অতিরঞ্জন করতে পছন্দ করেন, কিছু সময় তাল জ্ঞ্যান খুইয়ে আবোল তাবোল বলে বসেন বটে তবে মানুষটা মাঝে মধ্যে দু-একটা খাটি কথাও বলেন। সেদিন কথায় কথায় বললেন, ‘এই সভ্যতা যেদিন ধ্বংস হবে, হাজার হাজার বছর পর আবার উন্নততর কোনও মানুষ আজকের মানুষের ফসিল খুঁজে পাবে মাটির তলা থেকে, তখন তাঁরা মানুষের ফসিলের সঙ্গে যেটা পাবে সেটা হোল মোবাইল। এই একটি যন্ত্রই মানব সভ্যতা কে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে, কোন সন্দেহ নেই। ‘তলিয়ে ভেবে দেখলাম, কথাটা বাদল বাবু ভুল বলেননি, বরং হক কথার এক কথা বলেছেন ভদ্রলোক। আজকাল তো শুনছি এ আই প্রযুক্তির সাহায্যে দিন কে রাত করে ফেলা কোনও ব্যাপার না। চ্যাট জিপিটি দিয়ে নাকি যা খুশি করা সম্ভব। সেদিন পরখ করার জন্য চ্যাট জিপিটি খুলে সাদামাটা টাইপ করে লিখলাম ‘বৃষ্টির দিন নিয়ে একটি কবিতা’। নিমেষে দেখলাম একটি সুন্দর কবিতা পুটুর পুটুর করে ফুটে উঠল কম্পিউটারের স্ক্রিনে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, জীবনে যে একটা লাইনও ছন্দ মিলিয়ে লিখতে পারেনি কোনদিন, সেও এখন চোখের নিমেষে সেই কাজটি সুচারুভাবে সম্পাদন করে দিতে পারে।

পছন্দ না হলে আবার নতুন আঙ্গিকে, নতুন ছন্দে লেখা চলে আসবে নির্দেশ মত। ইলন মাস্ক, স্টারলিঙ্ক, টেস্লা, এদের দৌলতে আর মানুষের ব্যক্তিগত প্রতিভা, সৃজনশীলতা বা শ্রমের প্রয়োজন পড়বে না অদূর ভবিষ্যতে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একাই সব ছারখার করে দেবে। উল্টোদিকে এই প্রযুক্তি টিকিয়ে রাখতে গেলে নাকি প্রয়োজন পরে হাজার হাজার গ্যালন পরিশুদ্ধ জলের যা এক সময় পানীয় জলের আকাল ডেকে আনবে সারা বিশ্ব জুড়ে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত শুনেছি যুদ্ধ হয় তেলের জন্য, এবার যুদ্ধ হবে জলের জন্য। অবশ্য আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে গৃহযুদ্ধ, তার কেন্দ্রেও ওই জলের অধিকারের দাবি। গত কয়েক বছরে আমাদের সুজলা সুফলা ভারতের কিছু শহরেও জলের হাহাকার দেখা গেছে, বৃষ্টির অভাবে মরুভূমির চেহারা নিয়েছে বড় বড় শহুরে এলাকা, এক বালতি জলের জন্য প্রাণহানি ও ঘটেছে আকছার। এমনিতেই জল হাওয়া পরিবর্তনের ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্বের আবহাওয়া, মরু শহরে বন্যা তো চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির আকাল, কথায় কথায় সুনামি আর সুপার সাইক্লোন, সবই তো দেখছি চোখের ওপর। তবু ছুটবে আমাদের অগ্রগতির রথ, কাটা পড়বে হাজার হাজার গাছ, ধ্বংস হবে অরণ‍্য, দাবানলে পুড়বে আমাজনের জঙ্গল, একদিকে গড়ে উঠবে নব্য সভ্যতার ইমারত, আর অন্য দিকে মাটির গভীরে তলিয়ে যাবে যোশিমঠের মত জনপদ, সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে পড়শি বাংলাদেশ বা জাকার্তা। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া তাদের রাজধানী জাকার্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নুসান্তারা বলে একটি জায়গায়। কেদারের মহাদেবও কি বাঁচবেন সেদিন? মানুষের সঙ্গে সঙ্গে কি ঈশ্বরের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে না? কে জানে, এর উত্তরও হয়ত জানেন শুধু মহাকাল!