সম্প্রতি কল্যাণীর এক লোকালয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ গেল চারজনের। কয়েকজন আহত। দমকল কর্মীরা আগুন নেভাতে এসে জনবহুল এলাকায় এই বাজি কারখানা দেখে অবাক। কারণ স্থানীয় প্রশাসনের খোঁজ না নেওয়া পুলিশের গাফিলতি এবং নজরদারির অভাবে এই বাজি কারখানা রমরমিয়ে চলছিল। শোনা যায়, এই কারখানায় শুধু বাজি নয়, বোমাও তৈরি হচ্ছিল। বিরোধীরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গে যত্রতত্র বোমা তৈরি একটি কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক হিংসার ঘটনায়, অথবা কোনও রাজনৈতিক দলের গোষ্ঠীর লড়াইয়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এটাই সংঘর্ষে প্রথম অস্ত্র, তারপর গুলি চলে। বোমা নিক্ষেপে অনেকেই গুরুতর আহত হন। গ্রামবাসীরা বোমা ফাটার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন। এই ভাবেই চলছে দিনের পর দিন। কিন্তু যে প্রশ্নটি দমকল কর্মীরা এবং স্থানীয় অধিবাসীরা করেছেন, তা হল কল্যাণীর এই লোকালয়ে দিনের পর দিন এই বাজি কারখানায় বাজি ও বোমা তৈরি হচ্ছিল কী করে? স্থানীয় এক অধিবাসী জানালেন, তাঁরা এই কারখানায় যে বাজি তৈরি হচ্ছে, তা জানতেন না। স্থানীয় প্রশাসনেরও কাউকে ঘটনা ঘটার পর অবাক হয়েছেন। তাঁরা এ বিষয়ে খোঁজখবর কিছু রাখতেন না। একেবারে সরল মন্তব্য। আর পুলিশ তো নজরদারি চালায় না বলে স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগের পর অভিযোগ।
তাহলে কে দেখবে বেআইনি বাজি কারখানার ব্যবসা? বিস্ফোরণের ঘটনা না ঘটলে তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই বাজি কারখানা চলত। বড় বিস্ময় লাগে যখন সম্প্রতি রাজ্য পুলিশের এক বড় কর্তা জানান, তাঁরা বেআইনি বাজি কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। তাহলে কল্যাণীর লোকালয়ে এই বাজি কারখানা পুলিশের চোখে পড়ল না? এটা পরিহাস ছাড়া আর কী হতে পারে? এর আগেও পুলিশ কর্তাদের মুখে এই অভিযানের কথা বলা হয়েছিল কিন্তু সে যে কথার কথা, তা বোঝা গেল এই বাজি তৈরি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর। অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশ নিয়মিত নজরদারি চালালে এই লোকালয়ের বাজি কারখানা তাদের নজরে আসত। কিন্তু পুলিশ তো কোন দুর্ঘটনার খবর পেলেই শুধু সেখানে যায়, কিন্তু তাদের যাওয়ার আগেই সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে যায়। রাজনৈতিক কলহে অথবা দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষে বৃষ্টির মতো বোমা পড়ে। বোমা ফাটার শব্দে সাধারণ লোক পালিয়ে বাঁচেন। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলির প্রথম হাতিয়ার এই বোমা। বারাকপুরে ভাটপাড়া অঞ্চলে এমন দিন যায় না, যেদিন বোমা ফাটার শব্দ শোনা যায় না। মানুষকে আতঙ্কিত করতে দুষ্কৃতীরা এই বোমা ফাটায়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জ্ঞাতসারে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাদ্যায় বেশ কয়েক মাস আগে রাজ্য ও কলকাতা পুলিসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বেআইনি বাজি কারখানায় বোমা তৈরি করে তা মজুত রাখা এবং লুকানো অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের জন্য রাজ্যবাসী অভিযান চালাতে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় পুলিশকর্তারা নড়েচড়ে বসেছিলেন। এবং মাসাধিক কালব্যাপী এই অভিযান চালিয়ে প্রচুর মানুষ বোমা, অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছিল। কয়েকটি বাজি কারখানারও হদিশ মিলেছিল। কিন্তু সে অভিযান একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলেই বন্ধ হয়ে যায়। এবং তার সঙ্গে পুলিশের নজরদারিও। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এই সাফল্য মিলেছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আবার নির্দেশ না দিলে পুলিশের এই অভিযান আবার আরম্ভ হবে না। তাই বা কেন? পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের ওপর নির্ভর করবে কেন? এটা তো পুলিশের কাজ— কোথায় বোমা মজুত করা হয়েছে, কোথায় অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে, কোথায় বেআইনি বাজি কারখানা চলবে, তা খুঁজে বের করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে না পড়লে, এ কাজ করে না।
তাই আবার প্রমাণ মিলল, পুলিশের নজরদারির অভাবে কল্যাণীর এই লোকালয়ে বাজি কারখানা চালাচ্ছিল এবং প্রচুর বাজি প্রতিদিন তৈরি হত। প্রতি বছর দীপাবলির প্রাক্কালে প্রচুর নিষিদ্ধ শব্দবাজি কলকাতা শহর সহ শহরতলির বিভিন্ন শহরে ঢোকে পুলিশের নজরদারির অভাবে। গত দীপাবলিতে প্রমাণ মিলছে এই নিষিদ্ধ শব্দবাজি রাজ্যেরই বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হয়। পুলিশ তার খোঁজ রাখে না। আর নিষিদ্ধ বাজি ফাটানো হয় দীপাবলিতে মানুষের চরম অস্বস্তির সৃষ্টি করে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে কিছু নিষিদ্ধ বাজি বাজেয়াপ্ত করে বটে, কিন্তু যে নিষিদ্ধ বাজি মানুষের হাতে গেছে, তা ফাটানো হয় ওই রত্রিতে পুলিশের পক্ষে তা খুঁজে বের করা অসম্ভব। নিষিদ্ধ শব্দবাজি বাইরের থেকেও শহরে ঢোকে। তা বন্ধ করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। কোথা দিয়ে এই বাজি ঢোকে তার খোঁজ পায় না পুলিশ।
সুতরাং কল্যাণীর বাজি কারখানার বিস্ফোরণে চারজনের প্রাণ গেল, যা আমাদের কাছে একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা। এমন বাজি কারখানা যে রাজ্যের আর কোনও অঞ্চলে নেই, তার খোঁজ দেবে?