পাঁচ মাস অতিক্রান্ত বাংলাদেশে আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর। নোবেলজয়ী ইউনূস সরকারের অন্তর্বর্তী সরকার এই দেশের উন্নতি কল্পে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধসে যাওয়া সংস্কার এবং প্রায় ২ কোটি সংখ্যালঘুদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কোনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে এই তদারকি সরকার। ভারত বর্তমান বাংলাদেশের নানা অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখছে তেমন কোনও মন্তব্য না করে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম অত্যাচার বন্ধকরতে এবং বাংলাদেশে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আশা করে ভারত এ পর্যন্ত শুধু বিদেশ সচিবকে সে দেশে পাঠিয়েছিল, ওই দেশের বিদেশ সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসে ভারতের উদ্বেগের কথা জানাতে। তার ফল অবশ্য তেমন কিছু মেলেনি, কারণ বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর লাগাতার আক্রমণ চলছে, মন্দির ধ্বংস করা এবং হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠপাট করা হচ্ছে। এই সব ঘটনা প্রায় নিত্যদিনই ঘটে চলেছে। সারা বিশ্ব তাকিয়ে দেখছে এই দেশে নৈরাজ্য কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে।
এদিকে তদারকি সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনূস খান এখন নিজের দেশেই প্রচণ্ড চাপের মুখে। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র ইউনূস সরকারের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস এখন অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। কারণ বিএনপি চাইছে আশু নির্বাচন— ভোটের একটি নির্বাচিত সরকারই পারে সংস্কারের কাজ এবং মুজিব জমানায় তৈরি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার। কিন্তু বিএনপি’র এই দাবির পক্ষে এখনই হাঁটতে চাইছে না তদারকি সরকার। তাঁর মত, প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ শেষ না করে নির্বাচন করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সুতরাং বিএনপি’র দাবি খণ্ডন করে তদারকি সরকার চাইছে বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিকাঠামো পুরোপুরি তৈরি হলেই নির্বাচন হবে। তার আগে নয়। কিন্তু তদারকি সরকারের এই যুক্তি মানতে নারাজ বিএনপি। এই দলের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, একমাত্র নির্বাচিত সরকার এবং সংসদই পারে সংস্কারের কাজ করতে। যদিও এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নির্বাচন হলে বিএনপি সরকার গটনের উপযোগী হবে কিনা, তা বলা কঠিন।
কারণ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের সময় বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, কট্টরপন্থী মৌলবাদী কোটা বিরোধী ছাত্র সংগঠন এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে যে সার্বিক ঐক্য দেখা গিয়েছিল, এখন আর তা নেই। মতবিরোধ দেখা গিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ইসলামি এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে। কারণ জামায়াত এবং তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা দাবি জানাচ্ছেন— সুযোগ এসেছে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রশাসনিক সংস্কার করার। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে এখনই নির্বাচন করলে সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তারা বর্তমান সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান রচনার কথা বলেছে। কিন্তু বিএনপি তাদের ওই মত সমর্থন করে না। এই দলের একজন শীর্ষ নেতা বললেন, গণতন্ত্রের প্রথম দিক হল নির্বাচন। নির্বাচনে যে দল সরকার গঠন করবে, সেই দলই প্রশাসনিক সংস্কার করবে। নির্বাচনই হল সংস্কারের প্রথম ধাপ। তাই তিনি বলেন, বিএনপি দেশের স্বার্থে—তাই এই দলকে বাদ দিয়ে বা বাইরে রেখে কিছু করা যাবে না। তিনি বলেন, গত আগস্ট মাসের অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সংস্কার এবং পুনর্গঠন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু তা বলে নির্বাচনকে দূরে সরিয়ে রেখে তা করা যাবে না। সুতরাং আমরা চাই অবিলম্বে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হোক।
এই পরিস্থিতিতে এখন তদারকি সরকারের প্রধান কোন দিক সামলাবেন? বিএনপি’র প্রস্তাব খারিজ করা যেমন তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, আবার জামায়াত ইসলামি এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগটনের দাবিও ফেলে দেওয়ার নয়।
তবে খান সাহেব বলছেন, বাংলাদেশ এখনই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। যে সব সংস্কার না করলেই নয়, তা করেই নির্বাচনের ডাক দেওয়া যায়। সেই সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ করতে এখনও আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু বিএনপি তাতে বাদ সাধলে তদারকি সরকারের কিছু করার নেই। বাংলাদেশ এখন চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া— জনগণের তা নাগালের বাইরে। বস্ত্র কারখানাগুলি একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার শ্রমিক এখন পথে বসেছে। শিল্পের হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় মানুষ নাজেহাল। অর্থনীতি বেহাল। এই অবস্থার মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশে নির্বাচন এখনই সম্ভব নয়। তদারকি সরকার মনে করে যখন নির্বাচনের উপযুক্ত সময় আসবে, তখনই নির্বাচন হবে। বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে নির্বাচন হতে পারে না।
বিএনবি’র সূত্রে বলা হয়েছে, জামায়াত ইসলামী নিছকই তাদের নির্বাচনী শরিক ছিল। এই দলের সঙ্গে আমাদের দলের নীতিগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। তবে জামায়াত ও ছাত্র সংগঠনগুলি যা চাইবে, তদারকি সরকার ও বিএনপি তা কোনওভাবেই মেনে নেবে না। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সুতরাং জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে আমাদের তুলনা করা চলে না।
কৌশলগতভাবে জামায়াতের সঙ্গে আমাদের চলতে হয়েছিল। তার বাইরে কিছু নয়। আমরা তদারকি সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, নির্বাচনের— এখন দেখা যাক তদারকি সরকার সেই দাবির প্রেক্ষিতে কী করে। সংস্কারই বলুন, আর যাই বলুন, তা করতে পারে একমাত্র জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার।