• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান

বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির এই সঙ্কটের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সারা বাংলা জুড়ে আজ সিঙ্গল স্ক্রিন হলের সংখ্যা অতি দ্রুত হারে কমে গেছে।

ইদানিং বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রায় সব কুশীলব বিশেষত পরিচালক ও প্রযোজকের কাছ থেকে আপামর বাঙালি দর্শকদের কাছে একটা আবেদন রাখা হচ্ছে যে, আপনারা সকল বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান। এটা এখন আর আবেদনের জায়গায় নেই, প্রায় সেটা আর্তনাদের জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল বাংলা চলচ্চিত্র আজ এরকম একটা জায়গায় চলে গেল কেন? পরিচালকদের এই অসহায় আর্তনাদ তাঁদের মর্যাদার পক্ষে একেবারেই একটা ভালো বিজ্ঞাপন নয়। এর অনেক কারণ আছে সেগুলোই এই প্রতিবেদনের মূল উপপাদ্য।

চলচ্চিত্রের জন্মের কিছু বছর পর লুই লুমিয়ের একবার একটি মন্তব্য করেছিলেন, ‘The cinema has no future.’ বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই মন্তব্যটি আমাদের মতো চলচ্চিত্রের ছাত্রদের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হত, মনে হত একটি অসার মন্তব্য। কিন্তু এটা যে এতখানি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে তা এতদিন মনে হয়নি। আজ বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র শিল্প একটা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে,এটা মানি। কিন্তু কোথাও চলচ্চিত্রের পাশ দাঁড়ানোর জন্য এরকম আর্তনাদ করতে হয়নি,যেমন বাংলা সিনেমাকে করতে হচ্ছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো কেন দর্শক বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়াবে? দু-একটা ভালো ছবি যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু বেশির ভাগই একধরনের অন্তঃসারশূন্য উপস্থাপনা। যেটা আমার খুব বেশি করে মনে হয় যে বেশির ভাগ ছবির মধ্যেই সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি একেবারেই অনুপস্থিত, বা খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে চলা হয়েছে।

Advertisement

বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির এই সঙ্কটের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল সারা বাংলা জুড়ে আজ সিঙ্গল স্ক্রিন হলের সংখ্যা অতি দ্রুত হারে কমে গেছে। বিশিষ্ট অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর মতে, এই সংখ্যাটা সারা পশ্চিমবঙ্গে মাত্র চল্লিশ। সারা বছর যে পরিমাণ বাংলা ছবি তৈরি হয়, সেই নিরিখে সংখ্যাটা খুবই কম। আর আছে মাল্টিপ্লেক্স-এ ছবি দেখার ব্যবস্থা। আমরা যাকে মাস বা জনগণ ভাবি তাঁরা কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স-এ ছবি দেখতে যেতে পারছেন না। তার প্রথম ও প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। অত টাকার টিকিট কেটে ছবি দেখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাঁরা এইধরনের ছবির মধ্যে বিনোদনের সেরকম উপাদান পাচ্ছেন না। কারণ ছবিগুলি মাস এন্টারটেনিং নয় বলেই আমার বিশ্বাস। সপ্তপদী, গল্প হলেও সত্যি, অগ্নিশ্বর এমনকি বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো ছবির বড়ই অভাব।

Advertisement

কেননা আমি যে কথাটা বলতে চেয়েছি তা হল ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবির সবথেকে বেশিদিন চলার রেকর্ড যে সিনেমা ভেঙেছিল তা হল ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ এখনকার পরিচালকরা, তা তিনি  যে ধরনের পরিচালকই হোন না কেন, তার মধ্যে বিনোদন হয়তো কিছুটা থাকছে, কিন্তু কোনোরকম সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বোধ দেখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ ছবিটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কেননা সেই ছবিতে তিনি গ্রামবাংলার দারিদ্রকে দেখিয়েছিলেন অত্যন্ত নির্মোহ ভাবে। তৎকালীন  শাসক তা ভালো ভাবে নেননি। কিন্তু তিনি মানে সত্যজিৎ রায় তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন, বরং তাঁর আরো বেশি করে দারিদ্র দেখানো উচিত ছিল। তা তিনি মনে করতেন আর উৎপলেন্দু চক্রবর্তীকে একটা সাক্ষাৎকারে তা স্পষ্ট করে বলেছিলেন। তাই এমন ছবি এখন কোনও পরিচালক সাহস করে করে উঠতে পারছেন না, যেখানে দেশ ও রাজ্যজুড়ে এত অনিয়ম, অনাচার, দুর্নীতি এতসব ঘটনা ঘটছে তার কোনও প্রতিফলন তাঁদের ছবিতে সাধারণ দর্শক তা দেখতে পারছেন না।

এমন একটা ফেক সমাজের ছবি তাদেরকে চামচে করে গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেখানে বাস্তবতার বড়ই অভাব। কী হবে এসব ছবি করে? ছবির সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর তো কিছুই হচ্ছে না। একটা ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবি তো এখনই হওয়া দরকার। সমাজের দাবি সেটা। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মতো ওরকম সৎ, দৃঢ়চেতা এবং সাদা-কে সাদা বা কালো-কে কালো বলার ক্ষমতা এখনকার কোনও বাংলা সিনেমার পরিচালকদের আছে বলে আমার মন হয় না। তাঁরা হয় গোয়েন্দা কাহিনী নির্ভর ছবি, নতুবা ভূতের ছবি, আবার নয়তো উচ্চবিত্তদের কিছ সফট সমস্যা নিয়ে ছবি করছেন। সমাজের আশি শতাংশ মানুষের জীবন সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে। আমার মনে হয় এখানেই বাংলা সিনেমার মূল সঙ্কটের জায়গাটা। কাহিনী ও আঙ্গিকের মধ্যে গোল গোল ব্যাপার না রেখে, বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ঋজুভাবে বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। রাশিয়ান চলচিত্রকার আন্দ্রেই তারকিভস্কি তাই বলেছিলেন, একজন চলচ্চিত্রকারকে নিজের বিরুদ্ধে হলেও সত্যি কথা বলে যেতে হবে।

Advertisement