• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

রোমা রোলাঁর চোখে বিশ্বশিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ

এই বইটি প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর প্রকৃত আসনে প্রতিষ্ঠিত করল। তিনি বললেন, শ্রীরামকৃষ্ণ একটা ফুলের মত ভালোবাসার জীবন্ত প্রাণ। তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান, যত মত তত পথ। যত মত আছে, তত পথ আছে। সবই গ্রহণ করে তিনি স্বয়ং বিশ্ব চেতনায় প্রাণস্বরূপ হয়েছেন। সামগ্রিক মানব সমাজের অন্তর্নিহিত আত্মার তিনি শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ এবং উদ্ধার কর্তা।

ফাইল চিত্র

কুমারেশ চক্রবর্তী

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব ও খ্যাতি শুধু বাংলা কিংবা ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতের বাইরেও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং সেখানেও তিনি একজন সফল লোকশিক্ষক রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন বিশ্বশিক্ষক। তাঁর প্রভাব তাঁর পরশ বিশ্ব মানবসমাজ স্পর্শ করেছিল উপলব্ধি করেছিল। তাই বিভিন্ন বিদেশি বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতা, তাঁদের উপলব্ধি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং গ্রন্থে লিখে গিয়েছেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকজন মনীষীর নাম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, ফরাসি দার্শনিক তথা বিখ্যাত উপন্যাসিক রোমা রোলাঁ, জার্মান দার্শনিক ম্যাক্সমুলার, ক্রিস্টোফার ঈশারউড প্রমুখ। তাছাড়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য অল্ডাস হাক্সলি, আদ্রে জিদ, আর্ন্ড টয়েনবিস্ক প্রমূখ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বগণ। তাঁদের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন এক আশ্চর্যজনক আবির্ভাব! বিশ্বের বিস্ময়। অবশ্যই এঁরা সকলেই ছিলেন ভারত প্রেমিক এবং ভারত বিশারদ। প্রাচ্যের দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম তাঁদের আকৃষ্ট করেছিল। তাঁরা মনে করেছিলেন চিরকালের অবহেলিত, উপেক্ষিত প্রাচ্য একটি সোনার খনি, যার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতবর্ষ। আর ভারতের সূর্য ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বিশ্বশিক্ষক হিসেবে যাঁর জ্ঞানজ্যোতি সারা বিশ্বকে আলোকিত করেছিল। কিন্তু শুধু উচ্চশিক্ষিত, সমাজখ্যাত, মানুষের দ্বারা সমাদৃত হননি, তিনি দীন-দরিদ্র, দলিত, অস্পৃশ্য জাতিরও উদ্ধারকর্তার ভূমিকা পালন করেছিলেন। শুধু ব্যক্তি নয়, তিনি সমাজকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন তাঁর আদর্শে, মতবাদে, আন্তরিকতায় এবং মানবিকতায়।
এইসব বিদেশি ব্যক্তিত্বরা কেউই কিন্তু স্তুতিকার নন। সকলেই ছিলেন মহাপণ্ডিত, জ্ঞানী গুণী এবং বিশ্বখ্যাত। তাই তাঁদের আলোচনা তাঁদের পর্যবেক্ষণ অবশ্যই সকলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল, মর্যাদা পেয়েছিল।

Advertisement

বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, জনপ্রিয় সাহিত্যিক, উপন্যাসিক রোমা রোলাঁ যেভাবে ঠাকুর রামকৃষ্ণের বর্ণনা করেছেন, তা অবিস্মরণীয়, অনন্য। তিনি এক জায়গায় বলছেন, “আমি ইউরোপের নবীন শরতের ফসল আনিয়াছি, আমি অনিয়াছি আত্মার এক নতুন বাণী। ভারতের মহা-সংগীত! এই মহাসঙ্গীতের নাম রামকৃষ্ণ!” শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে রোমা রোলাঁ যত জেনেছেন, বুঝেছেন ততই তিনি বিস্মিত হয়েছেন। তাই শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি এমন উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে অনেক সময় তাঁর মনে হয়েছে এ বুঝি যীশুর জীবনই নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে গদাধরের ছোটবেলার একটি ঘটনা রোমা রোলাঁকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছিল। ঘটনাটির কথা রামকৃষ্ণ ভক্তদের অনেকেরই জানা। এটা ঘটেছিল লাহাবাবুদের বাড়িতে। তাঁদের এক আত্মীয়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে গ্রামের এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত সব পন্ডিতরা উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জটিল বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং সেই তর্কের সমাধান পণ্ডিতরা কিছুতেই করতে পারছিলেন না। বিষয়টা ছিল একজন স্থানীয় অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা। একজন তর্কসিদ্ধান্ত যদি একটি সিদ্ধান্ত উপনীত হন, অন্য পন্ডিত তাঁকে খণ্ডন করেন, কিংবা দণ্ডকে কেন্দ্র করে যে সমস্যা হবে তার কথা উল্লেখ করছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা তর্কবিতর্কের পরেও যখন সমাধান সূত্র আবিষ্কৃত হয়নি, তখনই গদাধর এসে এক মুহূর্তে সমস্যার সমাধান করে দিলেন। এটাই রোমা রোলাঁকে বিস্মিত করেছিল। ঘটনাটি খুলেই বলা যাক। কামারপুকুর গ্রামের এক ব্যক্তি এমন একটি অপরাধ করেছিলেন তার শাস্তি এই সভায় নির্ধারিত হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয় অপরাধী ব্যক্তিকে নিচু জাতের মানুষের সঙ্গে একাসনে বসে খেতে হবে। আজকের যুগের এই শাস্তি শুনলে আমরা হেসেই উঠবো কিন্তু সেই সময় অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই শাস্তি ছিল ভয়ঙ্কর। একটা সামাজিক স্তরের মানুষের, বিশেষ করে উচ্চ বংশের মানুষের কাছে এই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডস্বরূপ। কারণ তখন সামাজিক অশিক্ষার অন্ধকার, কুসংস্কার সমগ্র দেশকে আবদ্ধ করে রেখেছিল। তখন একশ্রেণির সঙ্গে অন্য শ্রেণির খাওয়া দাওয়া চলাফেরায় নানাবিধ বিধিনিষেধ ছিল। অন্য শ্রেণির বা নিচু জাতের সঙ্গে খাওয়া তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে বসলেই জাত যেত।

Advertisement

এমনকি নিচু জাতের জলও তাঁরা স্পর্শ করতেন না। তথাকথিত এই নিচু জাতের স্পর্শ করা জলও ছিল পানের অযোগ্য অচল। এই বিভেদ সমাজে এমনভাবে প্রোথিত হয়েছিল যে, একজন উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তির কাছে নিচু জাতের সঙ্গে খেতে বসার এই দণ্ডের অর্থ মৃত্যুদণ্ডের সমান। তাই এই দণ্ড নিয়েই শুরু হল তর্ক বিতর্ক। এমন দণ্ড কী দেওয়া যায়, যার দ্বারা কোনো ব্যক্তি জাতিচ্যুত হবে? সেটা কী ন্যায়সঙ্গত দণ্ড? আবার সামাজিক বিধান অনুসারে এটাই ঠিক যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে অপরাধ করেছেন এটাই তার একমাত্র দণ্ড। তাই শাস্তির হাত থেকে তাঁকে কিভাবে বাঁচানো যায় আবার শাস্তিও বহাল থাকে এটা নিয়েই তর্ক চলছিল পণ্ডিত মহলে। তাঁরা যখন কিছুতেই কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলেন না সেই সময় সমস্যার সমাধান করলেন বালক গদাধর।

তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন পণ্ডিত মহলের তর্ক-বিতর্ক শোনার জন্য। খুব আগ্রহের সঙ্গেই তিনি সব শুনছিলেন। বড় বড় পণ্ডিতদের শাস্ত্র সংক্রান্ত আলোচনা সব শুনে তিনি বুঝতে পারলেন যে, এঁরা লক্ষ্য ছেড়ে উপলক্ষে চলে যাচ্ছেন, তাই তর্কের শেষ হচ্ছে না। তখন তিনি সেখানে চুপি চুপি তার এক পরিচিত পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে গিয়ে এই সমস্যা থেকে উদ্ধারের জন্য একটা বিধান বার করে দিলেন, যা শুনে সেই পন্ডিত চমকে উঠল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গদাধর এই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। আপনারা সকলে শুনুন, গদাধর কি বলছে। তারপর গদাধর সেই পণ্ডিত সম্মেলনের মধ্যখানে এসে বললেন, এই সমস্যার সমাধানের একটা উপায় আছে, ওই অপরাধী ভদ্রলোক যদি পুরীতে জগন্নাথ দেবের আনন্দবাজারে বসে প্রসাদ গ্রহণ করেন তাহলেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কারণ আনন্দবাজারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণির কোনো ভেদাভেদ নেই, সেখানে সব জাতির মানুষ একসঙ্গে বসেই প্রসাদ গ্রহণ করেন। তাহলে ছোট বড় সব জাতের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাওয়াও হল আবার জাতও গেল না। বড় বড় তর্কসিদ্ধান্ত, পণ্ডিত, তর্কালংকার প্রভৃতি পণ্ডিতরা এতক্ষণ চর্চা করেও যার সমাধান করতে পারেননি ছোট্ট বালক গদাধর সহজেই তার সমাধান সূত্র বলে দিলেন। সকলেই তাঁকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো, সকলেই তাঁকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ দিলেন এবং বললেন এই বালক ভবিষ্যতের একদিন বিখ্যাত মহাপুরুষ হবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি রোমা রোলাঁর অগাধ আস্থা, বিশ্বাস, ভক্তি এবং শ্রদ্ধা থাকলেও তার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। তা হচ্ছে, বাল্যকালের এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ের ঘটনা কি আদৌ সত্য, না এখানে যীশুর কোন প্রভাব আছে? নাকি এটা শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তদের অতিরঞ্জিত গল্প! তবে এই একই ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ফ্রেটরিক ম্যাক্সমুলারও। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক, লেখক, পন্ডিত এবং প্রাচ্যবিদ ভারতপ্রেমিক ম্যাক্সমুলার হচ্ছেন প্রথম বিদেশি যিনি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেছিলেন। শুধু জীবনই রচনা করাই নয় তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশে রামকৃষ্ণকে তুলে ধরেছিলেন সত্য এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এবং তিনি দেখিয়েছিলেন যে শ্রীরামকৃষ্ণ নিছক একজন ধর্মগুরু নন, তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক এবং মানব প্রেমিক। তিনি বলেছিলেন জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা। মনে রাখবে মানুষের সেবা করা মানে তুমি ধন্য হচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের সামাজিক এবং ধর্মের বিষয়গুলি আলোচনা করি, তাহলে তাকে বিপ্লবী আখ্যা দেওয়া যায়। রামকৃষ্ণের মূল বার্তাটাকেই গ্রহণ করেছেন ম্যাক্সমুলার। তাঁর মতে শ্রীরামকৃষ্ণই প্রথম সাধক যিনি সব ধর্মকেই সমান মর্যাদা দিয়েছেন এবং তিনিই জাতপাত ধর্ম বর্ণকে উচ্ছেদ করে সকলকে সমানভাবেই হৃদয়ে গ্রহণ করেছেন। তাঁর কাছে মেথর রসিক থেকে শুরু করে জমিদার রায়চৌধুরী সবাই সমাদর পেয়েছেন, ভালোবাসা পেয়েছেন।

রোমা রোলাঁ কিংবা ম্যাক্সমুলার শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও গদাধরের বাল্যলীলা প্রসঙ্গে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে এই সন্দেহ দূর করে দিয়েছেন আরেকজন ইউরোপীয় খ্যাতনামা লেখক তথা প্রাচ্যবিদ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনীকার তিনি ক্রিস্টোফার ইসারুল। তিনি যে গ্রন্থটি লেখেন তার নাম ছিল ‘রামকৃষ্ণ এবং তার শীর্ষগন’। এই গ্রন্থে তিনি গদাধরের ছোটবেলার ওই ঘটনাটি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘটনাটি গল্পও নয় অতিরঞ্জিত নয়, এটা একটি সত্য ঘটনা। তিনি অনেক অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করে তবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই স্বামী সারদানন্দের কাছে এই ঘটনাটি একবার ছোটবেলার কথা প্রসঙ্গে বলেছেন। এমনকি কামারপুকুর গ্রামের এই ঘটনার সময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরাও অনেকে সারদানন্দের কাছে এসে এই ঘটনার কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন। তাই এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার জয়ী রোমা রোলাঁ। যদিও তিনি ফরাসি ভাষায় লিখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রামকৃষ্ণের জীবনী’ The Life of Ramkrishna। ফরাসি ভাষায় Vie de Ramkrishna। এই গ্রন্থটি রচনার জন্য রোমা রোলাঁ প্রচুর পরিশ্রম করেছেন, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন এবং যথেষ্ট সময় নিয়ে কাজটি করেছেন। তিনি ইংরেজি জানতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণ মিশন সংক্রান্ত গ্রন্থ, বিভিন্ন ইংরেজি লেখা ও অন্যান্য বই তাঁর বোন মাদলিন রোলাঁ তাঁকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে শোনাতেন অবশ্য রোমা রোলাঁকে প্রথম যে গ্রন্থটি রামকৃষ্ণের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করিয়েছিল এবং যে গ্রন্থটি থেকে তিনিই প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের অত্যাশ্চর্য বিস্ময়কর বিষয়গুলি জানতে পারেন সেই গ্রন্থটির লেখক ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখা বইটির নাম ‘ফেস অফ সাইলেন্স’, রামকৃষ্ণের জীবনী।

রোমা রোলাঁ শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, শুধু দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত মানবতাবাদী মানবপ্রেমিক বিশ্ববিখ্যাত মণীষী-লেখক। তাই মানুষের কষ্টে মানুষের যন্ত্রণায় অত্যন্ত ব্যথিত হতেন। তিনি দেখছেন বছরের পর বছর বিশ্বজুড়ে চলছে এক পাশবিক অত্যাচারের অবিরত ধারা। ব্যক্তি স্বার্থে, ব্যক্তিগত সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে, রাজনৈতিক নেতাদের এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একাধিপত্য স্থাপনের জন্য অশুভ প্রয়াস। যার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে একটার পর একটা যুদ্ধ। সেই হিংস্র ভয়ংকর পরিবেশ থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য মানুষের মুক্তির জন্য একটা পথ খুঁজছিলেন রোমা রোলাঁ। তিনি প্রায় সারা পৃথিবী তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, কোথায় পাওয়া যায় এমন পথ, এমন মত? তখনই তাঁর নজরে এলো শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও জীবনী। তিনি বুঝলেন ইনি সেই ব্যক্তি, ইনি সেই মহাত্মা, ইনি সেই মহামানব বিশ্বশিক্ষক যিনি সমাজকে উদ্ধার করতে পারবেন। ধনগোপালবাবুর বইটি পড়ার পর তিনি উঠেপড়ে লাগলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সম্পর্কে আরো জানতে। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করলেন।

ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখা বই ছাড়াও আরো অনেকগুলো বই তাঁকে দিলেন, যেখানে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ এবং মিশনের বিভিন্ন কার্যাবলীর কথা লিখিত আছে। স্বামী শিবানন্দ এবং স্বামী অশোকানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন রোমা রোলাঁ। তাঁরা মিশনের অনেক বই এবং তথ্য, বিশেষ করে শ্রীরামকৃষ্ণ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করলেন। এই জগতবিখ্যাত বিদেশির শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে অসীম আন্তরিক আগ্রহ দেখে ধনগোপালবাবু সোজা চলে গেলেন সুইজারল্যান্ডে রোমা রোলাঁর কাছে। তখন রোমা ফরাসি দেশ ত্যাগ করে সুইজারল্যান্ডে বাস করছিলেন। মানবতা বিরোধী ফরাসি সরকারের যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ তাঁকে অত্যন্ত বিরক্ত ও ব্যথিত করে তুলেছিল।
১৯২৬। ধনগোপালবাবুর সঙ্গে সাহিত্যিক রোমা রোলাঁর দীর্ঘ আলোচনা হল। পরপর ক’দিন ধনগোপালবাবুর সঙ্গে রোমা রোলাঁ শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা করলেন এবং আরো ঋদ্ধ হলেন এই আলোচনার দ্বারা। ১৯২৭ সালে স্বামী শিবানন্দকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী লিখতে শুরু করবেন। দীর্ঘ কয়েক বছর রামকৃষ্ণ মিশনের অজস্র বইপত্র এবং তাঁর নিজের সংগ্রহ করা মিশনের বিভিন্ন বই, বিবেকানন্দের লেখা, অভেদানন্দের লেখা এবং অন্যান্য গ্রন্থগুলো তিনি পাঠ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষায় যে সমস্ত লেখা, চিঠিপত্র প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে তাও সংগ্রহ করে পড়লেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন যে শ্রীরামকৃষ্ণকে পাশ্চাত্য জগতে তুলে আনতে হবে।

পাশ্চাত্য জগতের আত্মকেন্দ্রিক, মানবতাহীন, অহংকার সম্পন্ন মানুষগুলোকে আধ্যাত্মিক পথের নিশানা দেখানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণ। অবশেষে তিনি বইটি লেখা শুরু করলেন এবং বহু পরিশ্রম করে, তাঁর লেখনী-প্রতিভা উজাড় করে গ্রন্থটি শেষ করলেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। বইটি প্রকাশিত হলো ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। এই বইটি প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর প্রকৃত আসনে প্রতিষ্ঠিত করল। তিনি বললেন, শ্রীরামকৃষ্ণ একটা ফুলের মত ভালোবাসার জীবন্ত প্রাণ। তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান, যত মত তত পথ। যত মত আছে, তত পথ আছে। সবই গ্রহণ করে তিনি স্বয়ং বিশ্ব চেতনায় প্রাণস্বরূপ হয়েছেন। সামগ্রিক মানব সমাজের অন্তর্নিহিত আত্মার তিনি শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ এবং উদ্ধার কর্তা।

Advertisement