• facebook
  • twitter
Sunday, 14 December, 2025

সোনালি বিবির বিপন্ন স্বদেশ

৬ মাস বিনাবিচারে বাংলাদেশে জেলে থাকার পর অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবির শরীরে বর্তমানে প্রস্রাবে সংক্রমণ, থাইরয়েডে সমস্যা, থাইরয়েডের ঘাটতি এবং অপুষ্টি দেখা দিয়েছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

অজেয় পাঠক

প্রায় ছয় মাস বাংলাদেশে থাকার পর গত ৫ দিসেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ থেকে মালদহের মইদিপুর সীমান্ত দিয়ে আট বছরের পুত্রকে নিয়ে সীমান্তরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরলেন বীরভূমের পরিযায়ী শ্রমিক সোনালি বিবি। দেশে পা দিয়ে বললেন, ‘দেশে ফিরে ভাল লাগছে।’ বাংলাদেশে আটক তাঁর স্বামী এবং আরেক পরিযায়ী শ্রমিক সুইটি বিবি ও সুইটির দুই নাবালক সন্তান দেশে ফিরতে পারেননি। সোনালির দেশে ফেরার ফলে আরেকবার প্রমাণিত হল দিল্লি পুলিশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চূড়ান্ত অমানবিকতা ও মিথ্যাচার, যা অত্যন্ত ধিক্কারযোগ্য। সোনালি প্রশ্নাতীতভাবে একজন ভারতীয় নাগরিক। এস আই আর নথি অনুযায়ী সোনালিবিবির বাবা, মা এবং দিদা-র নাম রয়েছে ২০০২ এর ভোটার তালিকায়। তাঁদের কাছে ১৯৫২ সালের জমির দলিল আছে।

Advertisement

বীরভূমের পাইকরের দর্জিপাড়া গ্রাম থেকে সপরিবারে হতদরিদ্র দানিশ সেখ, সোনালি বিবি, সুইটি বিবিরা দিল্লিতে গিয়ে ভাংরির কেনাবেচা করে অন্নসংস্থান করতেন। বহুকাল ধরে সোনালিরা এ দেশের রাজধানীর বর্জ্য কুড়িয়ে নিজেদের পেট চালান, থাকেন ঝুপড়িতে। নিরুপায় এইসব মানুষের দ্বারাই আধুনিক মহানগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চলে। কিন্তু এঁদের তাড়িয়ে বেড়ায় প্রশাসন, বিশেষ করে যখন তাঁরা ভাষা বাংলা এবং তাঁরা ধর্মে মুসলমান।‌ আচমকা এই দুই পরিবারের ৬ জন নিখোঁজ হয়ে যান। পরে জানা যায়, দিল্লি শহর থেকে তুলে নিয়ে সোনালি, সুইটিদের আসাম থেকে ঠেলে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। কারণ দিল্লি পুলিশের মতে তাঁরা সন্দেহজনক অনুপ্রবেশকারী বা বাংলাদেশি। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘ঘুসপেটিয়া।’

Advertisement

গত ২৩ জুন ২০২৫ ভারতীয় নাগরিক অন্তঃসত্ত্বা সোনালিবিবি ও তাঁর পরিবারকে বিনা প্রমাণে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তারপর ২৬ জুন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে বেআইনিভাবে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে দিল্লি পুলিশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্র দপ্তর সোনালি ও তাঁর পরিবারকে বিনাবিচারে বাংলাদেশি বলে বিতাড়ন করেছিল যা আন্তর্জাতিক স্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধ। এই বেআইনি পুশব্যাক ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিস শহরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা গৃহীত ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’- এর একাধিক ধারাকে লঙ্ঘন করেছে। সোনালিবিবি যদি ভারতীয় না-ও হতেন, তাহলেও এটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হত। ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’-এর ধারা ৩ অনুযায়ী ‘জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে।’ অর্থাৎ বিদেশি হলেও কারও জীবন বা দৈহিক নিরাপত্তার অধিকার কেড়ে নিতে পারে না কোনও রাষ্ট্র। ধারা ১১ বলছে ‘দণ্ডনীয় অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রত্যেকেরই আইন অনুসারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে ধরে নেওয়ার অধিকার রয়েছে, যেখানে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত নিশ্চয়তা রয়েছে।’ অথচ আমরা দেখলাম, সোনালিবিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের আগেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হল এবং বিচার না করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাঁকে বিচারবহির্ভূত বেয়াইনি শাস্তি দেওয়া হল অর্থাৎ বলপূর্বক দেশ থেকে বিতাড়ন করা হল। আলোচ্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ৯ অনুসারে দেশি হোন বা বিদেশি, কাউকেই নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক বা নির্বাসনের শিকার করা যাবে না। ধারা ১৩ অনুযায়ী প্রত্যেকেরই নিজের দেশের প্রতিটি রাজ্যের সীমানার মধ্যে চলাচল এবং বসবাসের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী সোনালি বিবি জীবিকা নির্বাহের জন্য দিল্লিতে বসবাস ও কাজ করে কোনো অপরাধ করেননি, বরং অপরাধ করেছে দিল্লি পুলিশ তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর।

৬ মাস বিনাবিচারে বাংলাদেশে জেলে থাকার পর অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবির শরীরে বর্তমানে প্রস্রাবে সংক্রমণ, থাইরয়েডে সমস্যা, থাইরয়েডের ঘাটতি এবং অপুষ্টি দেখা দিয়েছে। এই সবকিছুর জন্য দায়ী দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ, যারা ভারতীয় নাগরিক সোনালি ও তাঁর গর্ভস্থ সন্তানকে মিথ্যা বাংলাদেশি তকমা দিয়ে অমানবিকভাবে পুশব্যাক করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এই চূড়ান্ত অমানবিকতার আরেকটি নিদর্শন আমরা দেখেছি যখন এই বছরই মে মাসে শিশু ও মহিলা-সহ ৪০ জনকে ‘রোহিঙ্গা’ বলে চিহ্নিত করে জাহাজে করে তুলে নিয়ে গিয়ে আন্দামান সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে কোনো একটি নাশকতার ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বসতবাড়ি বুলডোজার বা বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়াও একটি অমানবিক ও বিচারবহির্ভূত শাস্তিবিধানের উদাহরণ। কেবলমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের নিজস্ব সম্পত্তির ধ্বংসসাধন রাষ্ট্র করতে পারে না, যা আমরা দেখছি সাম্প্রতিক দিল্লি বিস্ফোরণ ও তার আগের কয়েকটি ঘটনার পর ভারতসরকার ঘটিয়েছে।

আমরা জানি, ভারত সরকারের অনুপ্রবেশের গল্প সর্বৈব মিথ্যা। ২০১৮ সালে একটি আরটিআই’য়ের উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কোনও তথ্যই নেই। এর আগে ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার সংসদে ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশী মানুষের সংখ্যা ১.২ কোটি জানিয়েছিল। ২০০৮ সালে বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আডবাণী দাবী করেন যে ভারতে ৩.৫ কোটি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী নাকি পরিচয় গোপন করে আছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি, অর্থাৎ আডবাণীর দাবি অনুযায়ী, সেদেশের ২৫% লোক ভারতে লুকিয়ে ছিল! ২০১৬-তে সেই সংখ্যাটা ২ কোটি হয়ে গেল। এইভাবে একেকবার বিভিন্নরকম রাষ্ট্রীয় প্রচার করে অনুপ্রবেশকারী সম্পর্কে একটি মিথ তৈরি করা হয়েছে। জনগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘৯১-এর গণনায় পশ্চিমবাংলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২৪.৭৩ শতাংশ। ২০০১ সালের গণনায় তা নেমে আসে ১৭.৭৭-এ। ২০১১ সালের রিপোর্টে তা আরও নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩.৯৩ শতাংশে। ‘৮১-র গণনা থেকেই দেখা যাচ্ছে এই হার ক্রমাগত নেমে আসছে। অনুপ্রবেশ নিয়ে মিথ্যাচার করে জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে। অন্তঃসত্ত্বা ভারতীয় নাগরিক সোনালি বিবির দেশে ফেরা আরেকবার ভারত সরকারের এই রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দরিদ্র অসহায় মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের উপর রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অমানবিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন শাসকের মুসলমানের প্রতি আক্রোশ, দরিদ্র প্রান্তিক নারীর প্রতি অত্যাচার এবং সর্বোপরি বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ প্রমাণ করে এদেশের বর্তমান ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী শাসকেরা আদ্যন্ত হিটলারের নাৎসি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। তবে সোনালির দেশে ফেরা প্রমাণ করল, এই জনবিরোধী রাষ্ট্রের কাছে সোনালীরা “বর্জ্য” হলেও এখনো এই পৃথিবীতে, এই দেশে, সোনালীর মত কাগজকুড়ানিদের হয়ে লড়াই করার মানুষ আছে। চারপাশের নিকষ আঁধারে সেই মানুষেরা একমাত্র আলোর রেখা।

Advertisement