• facebook
  • twitter
Saturday, 5 October, 2024

অবলুপ্ত শিরদাঁড়ার প্রত্যাবর্তন

এই বিকল্পের দরকার তার কারণ, মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনও নাগরিক সমাজের তৈরি সরকারও, যদি তা তৈরি করা যায়ও, শেষপর্যন্ত স্থায়ী সমাধান হতে পারে না, বড়জোর হতে পারে একটি সাময়িক ব্যবস্থাপনা মাত্র। 

আচ্ছা, কি হত যদি উনি পদত্যাগ করতেন? মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে না হোক, পুলিশ বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ থেকে? কিছু হত? কিছু কি সত্যিই হত? উনি তো নিজেই বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ৪২-টি লোকসভা কেন্দ্র অথবা ২৯৪-টি বিধানসভা কেন্দ্রে উনিই মুখ। আর আমরা যাদের বিধায়ক বা সাংসদ পদপ্রার্থী বলে ভোটের আগে চিনি, তারা সব মুখোশ। তাহলে কি-ই বা হত, যদি উনি একটি বা দুটি পদ থেকে পদত্যাগ করতেন?

অথবা কি-ই বা হত, যদি উনি বলতেন, আমার পুরো সরকার পদত্যাগ করছে, নতুন কেউ এসে সরকার গড়ুক, অথবা নতুন করে নির্বাচন হোক? তাহলেও কিছু কি বদল হত? সত্যিই কি কিছু হত?

আমরা তো জানি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর দলের রাশ তাঁর নিজের হাতে, যাঁর সরকারের রাশও তাঁর নিজের হাতেই। তাহলে তিনি যদি পুলিশমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতেন, আর অন্য কেউ একজন তাঁর জায়গায় পুলিশমন্ত্রী হতেন বা হতেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, তখন কি পুলিশ-প্রশাসন বা স্বাস্থ্য-বিভাগ চলত সেই নতুন মন্ত্রীর মর্জিমাফিক? আমরা সবাই জানি, এর উত্তর নেতিবাচক।

যদি পুরো মন্ত্রিসভা ইস্তফা দিত? কে তৈরি করত নতুন সরকার? নতুন সরকার তৈরি করতে গেলে তো বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে হত। যাদের উনি প্রতিনিয়তই রাম-বাম-শ্যাম বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, তারা যদি সত্যিই একজোট হত, তাহলেও তো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারে পাশে আসত না। তাহলে নতুন করে সরকার গড়ার ডাক পেতেন কে?

অথবা যদি নতুন সরকার গড়ার ডাক পেয়েও উনি বলতেন, না আমরা নতুন করে নির্বাচনে যাব, তাহলে? তাহলেও কি নির্বাচনের ফলাফল খুব একটা বেশি বদলে যেত? এই উত্তাল সময়েও? এই তো, যে ভোট হয়ে গেল, তার আগে সন্দেশখালি নিয়ে যে নাটক হল, তাতে তো অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন ঘন্টা বেজে গেছে, শেষ ঘণ্টা। কিন্তু কোথায় বাজলো সেই ঘন্টা? বাজেনি। বাজেনি তার কারণ আমরা এখনও কোনও বিকল্প খুঁজে পাইনি। আর পাইনি বলেই সরকারের মুখ বা মুখোশ, কোথাও কোনও কম্পনের চিহ্ন মাত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং প্রকাশ পাচ্ছে এক ধরনের ঔদ্ধত্য।

যে ঘটনা ঘটেছে তা ন্যক্কারজনক, তা নৃশংসতম, ইত্যাদি যে বিশেষণ‌ই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা যথেষ্ট নয়।  কিন্তু এর আগেও তো দিল্লিতে নির্ভয়ার ঘটনা ঘটেছে, চার দশক আগে ঘটেছিল অরুনা সানবাগের ঘটনা। সেগুলো কি কম ন্যক্কারজনক ছিল, নাকি কম নৃশংস? তবে কেন আজকের ঘটনা সমাজের ভিত নড়িয়ে দিচ্ছে? কেন পৃথিবীর একটি কোণের ঘটনা সারা পৃথিবীতে আন্দোলনের ঢেউ তুলেছে? এর একটিই উত্তর। উত্তর এই যে, ঘটনাটি ঘটেছে একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর এবং ঘটনাটি ঘটেছে যখন মেয়েটি কর্মরত অবস্থায় ছিল।

সারা পৃথিবী জুড়েই আজ কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমবর্ধমান। পৃথিবীর কথা না হয় বাদ দিন, যদি পরিসংখ্যান নেন কেবলমাত্র এই পশ্চিমবঙ্গের‌ই, তাহলে সরকারি পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করতে হবে না, সাদা চোখেই দেখতে পাবেন, কি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কি কাজের জগতে, মেয়েদের উপস্থিতি আগের চেয়ে অনেক বেশি। এই অবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মরত অবস্থায় একটি মেয়ের এই লাঞ্ছনা ভিত নড়িয়ে দিয়েছে, প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মেয়েদের অগ্রগতিকে। এরপর যদি কোনও পিতা বা মাতা তার মেয়েকে বলে, ‘থাক মা, তোকে আর ডাক্তারি পড়তে যেতে হবে না বা ইঞ্জিনিয়ারিং’, যেখানে এখনও ছেলেদের উপস্থিতি অধিকতর, তাহলে সেই বাবা বা মাকে আজকের পরিস্থিতির সাপেক্ষে খুব দোষ দেওয়া যাবে কি? এবং ঠিক এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়েই ঘটনাটি অন্য একটি মাত্রা দাবি করে বসেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নগুলি প্রথমে উত্থাপন করা হল সেগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখুন। একবার কি মনে হতে পারে না যে, ঘটনাটির মাত্রা যেখানে এত সুদূরপ্রসারী হতে পারে সেখানেও কি কেবলমাত্র বিকল্প নেই বলেই সব আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে? সদ্য একটি ঘটনা তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঘটেছে, সেখানেও কিন্তু কোনও রাজনৈতিক বিকল্প ছিল না, তা সত্ত্বেও সেখানে ভাঙ্গন এবং পুনর্গঠন দুটিই ঘটেছে। এ রাজ্যে সেটা কেন হবে না? প্রশ্নটি সমাজমাধ্যমে অনেকেই তুলেছেন, তুলে যাচ্ছেন। কিন্তু সত্যিই কি এই রাজ্যের পরিস্থিতি সেরকম? না নয়।

কেন নয়? গণতান্ত্রিক পরিসরে, যেখানে কোনও পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কোনও বিকল্প পাওয়া যায় না, তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে অনেক সময় একটি নির্বাচিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, যার উপর মোটের উপর একটি আস্থা থাকে রাজ্য বা দেশবাসীর। এই রাজ্যে তেমন কোনও বুদ্ধিজীবী নাগরিক শ্রেণীকে আমরা ভরসা করতে পারি কি? গত দেড় দশকে আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভরসা করতাম, তাদের অধিকাংশকেই কি দেখিনি, কিভাবে তাঁরা বুদ্ধিজীবী থেকে ধান্দাজীবি হয়ে গেছেন? কিভাবে সরকারি কিছু পৃষ্ঠপোষকতার লোভে তাঁরা তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়েছেন? আমাদের এই রাজ্যের বাসিন্দাদের রিক্ততার জায়গাটি ঠিক এখানেই। আমাদের সামনে না আছে কোন‌ও  বিকল্প রাজনৈতিক সত্তা, না আছে কোন‌ও ভরসাযোগ্য নাগরিক সমাজ। আমাদের বাঁচাবে কে?

তবে সবটাই কি কেবল নৈরাশ্যের ছবি? বোধ হয় তাও নয়। যে টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, আগামী কিছুদিন যাব‌ও হয়তো, তাতে বোধহয় একটা জিনিস সংগোপনে তৈরি হচ্ছে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া শিরদাঁড়াগুলি আস্তে আস্তে ফিরে আসছে, আসতে বাধ্য হচ্ছে। ঘটনাক্রম তো তাই বলছে। ইতিহাসও তো তাই বলে। প্রতিটি পশ্চাৎগতির শেষ গন্তব্যে আছে একটি দেওয়াল এবং অবধারিতভাবে সেই দেওয়ালে একদিন না একদিন পিছিয়ে পড়া মানুষের পৃষ্ঠদেশ ধাক্কা খায়। ভাবতে ইচ্ছে করে, শেষের সে দিন এসে উপস্থিত হয়েছে। যদি আসে, তাহলে হয়তো অবধারিতভাবে তৈরি হবে কোনও রাজনৈতিক বিকল্প। এই বিকল্পের দরকার তার কারণ, মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনও নাগরিক সমাজের তৈরি সরকারও, যদি তা তৈরি করা যায়ও, শেষপর্যন্ত স্থায়ী সমাধান হতে পারে না, বড়জোর হতে পারে একটি সাময়িক ব্যবস্থাপনা মাত্র।
তাই আমরা তো চোখ রাখবই, ইতিহাসও কিন্তু চোখ রাখছে এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনগুলির দিকে।