• facebook
  • twitter
Sunday, 3 August, 2025

নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা বলছে, ‘আপনি থাকছেন স্যার’

পৃথিবী-সহ সমগ্র সৌরমণ্ডল আদতে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের অংশ।সক্রিয় ব্ল্যাক হোলগুলি তাদের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে ছোট মহাজাগতিক কণা থেকে শুরু করে গ্রহ, উপগ্রহ ঘন জমাট বাঁধা গ্যাস এমনকি, আলোর রশ্মিকেও ‘গিলে’ নিতে পারে। কিন্তু আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির মাঝখানে থাকা ‘স্যাজিটেরিয়াস এ’-কে এত দিন ‘উপোসী’ থাকতেই দেখা গিয়েছিল। ২০১৯-এ সক্রিয় হওয়ার পরে তার ছবি তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের ‘আলো শুষে নেওয়ার প্রবল ক্ষমতার জন্য অসুবিধায় পড়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

প্রতীকী চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডা সংক্রান্ত নতুন গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ফিনল্যান্ডের হেলসিন্‌কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা গবেষক টিল সাওয়ালার নেতৃত্বে এই গবেষণায় উঠে এসেছে নতুন সম্ভাবনার কথা। যা বিজ্ঞানী মহলেও সাড়া ফেলে দিয়েছে।হাজার কোটি বছর ধরে ‘মিলেমিশে’ বাস করে দুই প্রতিবেশী। দু’টিই কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহের ঠিকানা। আমাদের সৌরজগৎ যে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির ছোট্ট অংশ, সেই আকাশগঙ্গা (মিল্কিওয়ে) এবং তার পড়শি ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমেডার খুঁটিনাটি নিয়ে গবেষণা করে অনেক আগেই তাদের ‘ভবিষ্যৎ’ বলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বলা হয়েছিল, অ্যান্ড্রোমেডা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে মিল্কিওয়ের দিকে। ভবিষ্যতে তারা একে অপরের সঙ্গে মিশে যাবে। বা অ্যান্ড্রোমেডা গিলে নেবে মিল্কিওয়েকে। এটাই ভবিতব্য। বয়সে আমাদের ছায়াপথ বড়। মোটামুটি ১৩৫০ কোটি বছর আগে মিল্কিওয়ের জন্ম। আর অ্যান্ড্রোমেডার বয়স খুব বেশি হলে হাজার কোটি বছর। বয়সে ছোট হলে কী হবে, বহরে অনেক বড়। প্রায় দ্বিগুণ। এতদিন মনে করা হত, এই ষণ্ডামার্কা পড়শিই এক দিন গ্রাস করে নেবে আমাদের ঘরদোর। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন সেই তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল সাম্প্রতিক গবেষণা! উঠে এল নতুন তত্ত্ব। যা বলছে, মিল্কিওয়ের ভবিতব্য আদৌ অ্যান্ড্রোমেডায় আত্মসমর্পণ নয়। বরং, স্বাতন্ত্র্য নিয়েই কোটি কোটি বছর পরেও ‘মাথা তুলে’ থাকতেই পারে সৌরজগতের এই ছায়াপথ। কারণ, নেপথ্যে কাজ করে চলেছে দুই ‘অনুঘটক’, যাদের এত দিন হিসাবে ধরা হয়নি!এই গবেষণার জন্য আলাদা ভাবে কোনও তথ্যপরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়নি।

বরং আগে থেকে সংগৃহীত তথ্যপরিসংখ্যান ঘেঁটে, নতুন করে বিচারবিশ্লেষণ করে, বিভিন্ন মহাজাগতিক মাপজোকের অনিশ্চয়তাগুলিকে বিবেচনা করে দেখা গিয়েছে, আগামী হাজার কোটি বছরে এই দুই ছায়াপথের সংযুক্তির সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বা তারও কম।১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডার সংযুক্তির তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহলে প্রচলিত। মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত পাঠ্যপুস্তকেও এই তত্ত্ব লেখা হয়ে আসছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছিলেন, অন্যান্য ছায়াপথের মতোই অ্যান্ড্রোমেডা একটি নির্দিষ্ট গতিতে পাক খাচ্ছে। তার সঙ্গে একটু একটু করে আমাদের কাছে সরে আসছে। ছায়াপথের এই গতিকে ‘ট্রান্সভার্স ভেলোসিটি’ বলা হয়। এই গতি সঠিক ভাবে নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য। তবে মনে করা হচ্ছিল, অ্যান্ড্রোমেডার এই গতির ফলেই আগামী দিনে তা মিল্কিওয়েকে খেয়ে নিতে চলেছে। এই সংযুক্তি অনিবার্য বলেই মনে করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কত দিন লাগত মিল্কিওয়েকে খেয়ে ফেলতে? বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে বলেছিলেন, মোটামুটি ৫০০ কোটি বছর পরে।মিল্কিওয়ের চেয়ে অ্যান্ড্রোমেডা আকারে অনেক বড়। এই ছায়াপথের ব্যাস ২.২০ লক্ষ আলোকবর্ষ (আলো এক বছরে যতটা পথ অতিক্রম করতে পারে তাকেই আলোকবর্ষ বলে, যা সাড়ে ন’লক্ষ কোটি কিলোমিটারের সমান)। আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের ব্যাস এক লক্ষ আলোকবর্ষ। সূর্য-সহ কয়েক লক্ষ নক্ষত্র এবং তাদের সংসারের ঠিকানা মিল্কিওয়ে। এই ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে সৌরজগতের দূরত্ব প্রায় ২৫ হাজার আলোকবর্ষ। পৃথিবী এবং সূর্যের অন্য গ্রহেরা রয়েছে মিল্কিওয়ের সর্পিলাকার অজস্র বাহুর একটিতে।

পৃথিবী থেকে মিল্কিওয়ের প্রতিবেশি অ্যান্ড্রোমেডার দূরত্ব ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ।বিজ্ঞানীদের মতে, যদি কোনও এক কালে মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডা পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায়ও, তাতে পৃথিবীর খুব বড় কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। মহাকাশে এক একটি নক্ষত্রের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব থাকে। সেই সঙ্গে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষীয় বলও। ফলে কোনও ভাবে দুই ছায়াপথ মিলে গিয়ে একটি বড় ছায়াপথে পরিণত হলেও তার মধ্যেকার গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে দুই ছায়াপথ মিলে বৃহত্তর আকার নিলে সেই নতুন ছায়াপথের গঠনও বদলে যাবে। বর্তমানে মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডা, উভয়েই সর্পিলাকার। আগামী দিনে সংযুক্তি ঘটলে তা উপবৃত্তাকার হয়ে যেতে পারে। যদি দুই ছায়াপথের সংযুক্তি না-ঘটে, তবে তারা একে অপরের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে থিতু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই দুইয়ের সংঘাত হবে না কখনওই। তারা একে অপরের সমান্তরালেই থাকবে।মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমেডা নিয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা থেকে গিয়েছে। গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের একাংশের মতে, অ্যান্ড্রোমেডার সরণের গতি বা ট্রান্সভার্স ভেলোসিটি এখনও ধাঁধার মতো দুর্বোধ্য থেকে গিয়েছে। তা নিয়ে বিস্তর অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই গতির সামান্যতম পরিবর্তনও বদলে দিতে পারে যাবতীয় হিসেবনিকেশ। এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। আরও উন্নত যন্ত্রপাতি, উচ্চ মানের পর্যবেক্ষণ এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। তবেই দুই ছায়াপথের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।

নাসা (আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা)-র হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ দুই ছায়াপথ সম্পর্কে অনেক পর্যবেক্ষণ পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। তাতে মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডার কাছাকাছি আরও দু’টি পৃথক ছায়াপথের তথ্যও উঠে এসেছে। একটির নাম লার্জ ম্যাজেল্যানিক ক্লাউড (এলএমসি) এবং অন্যটির নাম ট্রাইঅ্যাঙ্গুলাম গ্যালাক্সি (এম৩৩)। নেচারে প্রকাশিত পেপারটি বলছে, এই দুই ছায়াপথই মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডার চলনে অনুঘটকের কাজ করতে পারে। এদের কারণেই টিকে থাকতে পারে মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডার পৃথক অস্তিত্ব। এম৩৩ অ্যান্ড্রোমেডার চারপাশে ঘোরে। আর মিল্কিওয়ের একেবারে গা ঘেঁষে রয়েছে এলএমসি। মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডার উপরে এই দুই ছায়াপথের মহাকর্ষীয় টান কাজ করে। এম৩৩-এর মহাকর্ষের প্রভাবে অ্যান্ড্রোমেডা যতই মিল্কিওয়ের দিকে এগিয়ে আসছে, এলএমসি ততই তাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে চলতে থাকলে দুই ছায়াপথের সংযুক্তি প্রায় অসম্ভব। অনুঘটকের মতোই মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে এলএমসি, এম৩৩। কিন্তু এতে তাদের নিজেদের কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। মহাকাশের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের (মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি) ঠিক মাঝখানে থাকা সেই ‘দানবাকৃতি রাক্ষসের’ সন্ধান মিলেছিল বেশ কয়েক বছর আগেই। প্রথম বার সেই ‘স্যাজিটেরিয়াস এ’-র ছবি তুলতে সক্ষম হলেন ইন্টারন্যাশনাল কনসর্টিয়ামের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। আমেরিকায় মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ‘এজেন্সি ন্যাশানাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন’ (এনএসএফ)-এর সহায়তায় আটটি রেডিয়ো টেলিস্কোপের সম্মিলিত ছবিকে একত্র করে প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি।

‘স্যাজিটেরিয়াস এ’ আদতে একটি দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। ২০১৯ সালের মে মাসে কয়েক দিন ধরে অদ্ভুত একটা আলোর ঝলসানি দেখে তার সক্রিয়তাকে চিহ্নিত করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। যা দেখে মনে করা হয়েছিল, পৃথিবী থেকে ২৭ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, সূর্যের চেয়ে ৪০ লক্ষ গুণ বেশি ভরের ওই ব্ল্যাক হোলটি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গিলতে শুরু করেছে আশপাশের মহাজাগতিক বস্তুগুলিকে। প্রসঙ্গত, পৃথিবী-সহ সমগ্র সৌরমণ্ডল আদতে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের অংশ। সক্রিয় ব্ল্যাক হোলগুলি তাদের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে ছোট মহাজাগতিক কণা থেকে শুরু করে গ্রহ, উপগ্রহ ঘন জমাট বাঁধা গ্যাস এমনকি, আলোর রশ্মিকেও ‘গিলে’ নিতে পারে। কিন্তু আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির মাঝখানে থাকা ‘স্যাজিটেরিয়াস এ’-কে এত দিন ‘উপোসী’ থাকতেই দেখা গিয়েছিল। ২০১৯-এ সক্রিয় হওয়ার পরে তার ছবি তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের ‘আলো শুষে নেওয়ার প্রবল ক্ষমতার জন্য অসুবিধায় পড়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বস্তুত, কৃষ্ণগহ্বর এবং তাকে ঘিরে থাকা জ্বলন্ত গ্যাসের ছবিই তুলতে সক্ষম হয়েছে ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ কোলাবরেশন’। অতি উত্তপ্ত সেই গ্যাসের বলয়টি দৈর্ঘ প্রায় ৬ কোটি কিলোমিটার। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে প্রথম বার অন্য একটি ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা হয়েছিল।তবে শেষ পর্যন্ত হিসেব বলছে যে আমরা থাকছি,এই পৃথিবীর বুকে আরও অনেকদিন,বিলীন হয়ে যাওয়া আপাতত সুদূর পরাহত।মীরাক্কেল অনুষ্ঠানে যেমন প্রতিযোগীদের বলতেন ওই অনুষ্ঠানের অন্যতম বিচারক রজতাভ দত্ত, “আপনি থাকছেন স্যার”।তেমনই বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে আমাদের থাকা খানিকটা নিশ্চিত হল।