সুবীর পাল
নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা।’
বিশ্বকবিসম্রাটের উৎসারিত এমন আর্তি যখন সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে বাংলার জানালার এক আকাশ স্বপ্নে তখন ওয়াম্বার দুয়ারে দাঁড়িয়ে এক অখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গী কন্যা হৃদয়ে তার স্বাধিকারের জেহাদ বুনেছেন এক সামুদ্রিক গহনতায়। ফায়ার শুধু এটাই, কেন নাহি দিবে অধিকারের দয়া ভিক্ষা নয়। চোখে তাঁর দিনযাপর অস্তিত্বের আগুন, ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর, বল বীর আমি চির উন্নত শির।’। মনে তাঁর অধিকারের বন্যতায় এক অভিনব মন্ত্রগুপ্তি, ‘আমি ছিনিয়া আনিব’ নারীর নতুন মহাবিশ্ব ‘উমোজা।’
সেই বন্য লড়াকু মহাকাশের নাম রেবেকা লোলোসোলি!
তিনি যে আমাদের চেনা বিশ্বের এক অচেনা নারী পৃথিবীর কারিগর নাম্বার ওয়ান।
নামের যা গঠনতন্ত্র তাতে তো তিনি অবশ্য একজন নারী।
কিন্তু কে এই নারী?
তিনি যে কেনিয়ার নাগরিক।
কি তাঁর পরিচয়?
স্বামীর অত্যাচারে বিদ্রোহিনী।
এখানে উনার প্রসঙ্গ কেন?
উনি মাথা নোয়াননি। উল্টে গড়ে ফেললেন একটি পুরুষ বর্জিত একটা গোটা গ্রাম।
সেকি? এতো কেমন কেমন অদ্ভুত ব্যাপার শুনতে লাগছে। বলেন কি? একটা আস্ত গ্রাম গড়ে তৈরি করেছেন রেবেকা লোলোসোলি। তাও আবার সেই গ্রামে নাকি পুরুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। এতো অবিশ্বাস্য।
হ্যাঁ এমনই অবিশ্বাস্য উপকথার স্বরবর্ণে এক অবাক করা নারী জীবনের ব্যঞ্জনবর্ণময় সুষমাগুলো না হয় বিবরণের আসতকাচের পরখে আনাই যাক, ক্ষতি কি?
তবে শুরু হোক সেই রূপকথার কৃষ্ণাঙ্গী নারীর কতকথা।
কেনিয়ায় ওয়াম্বা হলো এক গ্রামীণ জনবসতি। ১৯৬২ সালে রেবেকা লোলোসোলি এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে তাঁরা ছয় ভাইবোন ছিলেন। গ্রামের প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে এলাকার একটি মিশনারী নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হোন। কিন্তু আর্থিক অভাবের কারণে সেই প্রশিক্ষণ তাঁকে মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয়। ওই এলাকার পরম্পরা রীতি তথা ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে যৌবনের প্রথম সিঁড়ি বলতে পনেরো বছরেই তিনি খৎনার শিকারও হোন।
একেতে চরম আর্থিক অনটন। তার সঙ্গে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো বড় পরিবার। কি আর করার থাকতে পারে সিংহভাগ গরীব মানুষদের। এক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। রেবেকা লোলোসোলি বিবাহ জনিত যৌতুক হিসেবে পেলেন সতেরোটি গরু। আর তার বিনিময়ে আঠারো বছর বয়েসে রেবেকাকে বিয়ের পিঁড়িতে যে বসতে হলো। স্বামীর নাম ফ্যাবিয়ানো ডেভিড লোলোসোলি। স্বামীর নিবাস সাম্বুরু কাউন্টিতে। অগত্যা স্বামীর হাত ধরে সাম্বুরুতে তাঁর নতুন করে বসবাসের স্বপ্ন দেখা। বিয়ে হলেও তিনি কিন্তু তাঁর নিজস্ব গ্রামীণ ব্যবসা চালাতে থাকেন সংসার সামলানোর পাশাপাশি। একইসঙ্গে নারীর অধিকার নিয়ে তিনি বরাবরই জনমত তৈরিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন।
বিধির কি অদ্ভুত বৈপরীত্যের বিধান। যে নারী অপর স্থানীয় মহিলাদের মর্যাদা রক্ষায় সর্বদা সোচ্চার ছিলেন সেই ললনাই কিনা অবশেষে স্বামীর লাঞ্ছনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠলেন কালক্রমে। যত দিন অতিক্রান্ত হতে শুরু হলো স্বামীর অযাচিত অত্যাচারের মাত্রা তত বৃদ্ধি পেতে লাগলো। আসলে বিবাহিত জীবনে তাঁর কপালে যে সুখ সইলো না বেশি দিন। ২০১০ সালে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় আইনতঃ।
এদিকে বিয়ের কিছুদিন পড়ে আর্চার্স পোস্ট সামরিক ঘাঁটিতে ব্রিটিশ সৈন্যরা চোদ্দশো স্থানীয় মহিলাকে জবরদস্তি ধর্ষণ করে। রেবেকাকেও ধর্ষণ করতে গেলে তিনি কোনক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে নেন। অথচ তাঁর স্বামী এসব জানতে পেরেও রেবেকাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি। ঘরে ডাকাতের আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটলেও ফ্যাবিয়ানো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেননি। এমনকি একদিন তাঁর স্বামী বন্দুক নিয়ে তাড়া করেছিলেন এই অভিযোগে যে তখন রেবেকা নাকি নিজের ঘরে ছিলেন না। স্বামীর এহেন লাগাতার অসহনীয় নির্যাতন আর সঙ্গে নির্লজ্জ আক্রমণের কারণে তিনি শেষমেশ স্বামীর ঘর পরিত্যাগ করতে বাধ্য হোন।
সেই সময় রেবেকার মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। কথায় বলে না ‘যার কেউ নেই তার ভগবান আছে।’ শুরু হলো রেবেকার ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য যুদ্ধ। একদম শুন্য কেন্দ্র বিন্দু থেকে। কিন্তু রেবেকা যে রেবেকাই। তিনি যে হার মানতে শেখেননি। তাছাড়া ওই যে অনেকে বলে থাকেন, ‘রাখে হরি মারে কে?’ এই বিশ্বাস নিয়েই হয়তো সর্বহারা নিঃস্ব নিঃসঙ্গ রেবেকা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার নিজস্ব স্বভিমানকেই আরও বেশি করে সেদিন শান দিয়েছিলেন একেবারে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে।
আসলে এই জীবন চক্রে নিজের মতো করে বেঁচে থাকারও একটা আপন অভিযোজন থেকেই যায় সময়কে হাতিয়ার করে। প্রত্যেকের নিজস্ব জীবন পরিসরে। যা আগামী কর্মপন্থার উপর নির্ভর করে এই অভিযোজনের স্রোত আমাদের জীবন বজরাকে কোন ঘাটে নিয়ে নোঙর করবে। রেবেকাও যে এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তিনিও ভাবলেন। অনেক অনেক অনেক। পরিবর্তিত পরিকল্পনাও গ্রহণ করলেন। এগিয়ে এলেন খানিকটা নতুন দৃষ্টান্ত তৈরির অসীম বুকভরা সাহস সম্পদে।
তিনি যে দাম্পত্যময় সংসারের আকস্মাৎ বৃত্তচ্যুৎ। হয়তো নিরুপায় হয়েই সমমনষ্ক নারীদের আহ্বান করে বসলেন, ‘বেলা বয়ে যায়, ছোট্ট মোদের পানসি নদী, সঙ্গে কে কে যাবি আয়।’ রেবেকার আবেদনে প্রাথমিক ভাবে সাড়া দিলেন মাত্র চোদ্দজন স্থানীয় অসহায় নারী। যাঁরা রেবেকার মতোই পুরুষের অত্যাচারে বিধ্বস্ত ও বিদীর্ণ। তাঁরাও যেন সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ চিনি না।’ শুরু হলো নতুন স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার কঠিন থেকে কঠিনতম সংগ্রাম। জেদ চেপে বসলো তাঁদের চোখে মুখে। দাঁতে দাঁত চেপে শপথ নিলেন সম্মিলিত ভাবে, যে পুরুষ সমাজ তাঁদেরকে নিজস্ব বাসস্থান থেকে ব্রাত্য করে দিয়েছে অমানবিকতার সীমাহীন আচরণ লঙ্ঘনে, সেই পুরুষ বর্জিত এক টুকরো আলাদা পৃথিবী গড়ে তাঁরাও তাক লাগিয়ে দিতে চান গোটা বিশ্বকে।
একদম সঠিক শুনছেন তাঁদের সেই দৃষ্টান্তহীন অবাক করা সমাজ গঠনের নব্য পরিকল্পনার ইতিকথা। যে সমাজে চিরতরে পুরুষের অবস্থান পাকাপাকি ভাবে নিষিদ্ধ। কোনও অবস্থাতেই এর নড়চড় ‘কভি নেহি।’
যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। তাঁদের মনে বিশ্বাস ছিল, ‘সত্যের হবে জয় একদিন।’ লেগে পড়লেন তাঁরা একত্রে এক অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপনের অভিসারে। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দূরে। সম্বুরু কাউন্টির আর্চার্স পোস্ট শহরের অনতিদূরের একটা ধূধূ প্রান্তিক প্রান্তর। সেখানেই রেবেকা লোলোসোলি বাকি জনা চোদ্দ সখীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুললেন একটা অতি ছোট্ট জনবসতি। সময়টা ১৯৯০ সাল। তাঁদের বেঁচে থাকার অদম্য জেদ ও অসম সাহসিকতাকে ভর করে সেখানে তৈরি হলো এক নব্য নারী বসতি।
অবশেষে অচিরেই এই জনবসতি একটি গ্রাম রূপে আত্মপ্রকাশ করলো। এমন রূপকথার গ্রামটির নাম হলো ‘উমোজা।’
বিশ্বের বুকে একটা স্বতন্ত্রের দাগ কেটে দিল উমোজা। কি কারণে? কারণটা বড়ই অদ্ভুতুড়ে। এই উমোজা নামক গ্রামে চরম ভাবে নিষিদ্ধ প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের প্রবেশাধিকার। সেই ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৫ সালের দীর্ঘতর পঁয়ত্রিশ বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু এই সময়কালের মধ্যে এমন একদিনও ঘটেনি যেখানে পুরুষের প্রবেশাধিকারে সামান্যতম একবারও অন্যথা দেখা গিয়েছে উমোজাতে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০০৫ সালে উমোজা গ্রামে বসবাস করতেন ত্রিশজন নারী ও পঞ্চাশজন শিশু। বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে যথাক্রমে দাঁড়িয়েছে ষাট ও দুশোতে।
প্রশ্ন একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে উঠতেই পারে। এখানে শিশুর সংখ্যা তরতরিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কি করে? যেখানে পুরুষের আনাগোনা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এখানকার নারী বাসিন্দারা তবে গর্ভবতী হচ্ছেন কোন উপায়ে? আসলে এখানকার নারীরা কোনও পুরুষকে ভালবাসলে বা মনপছন্দের ব্যক্তির সঙ্গে মিলিত হতে চাইলে তাঁকে গ্রামের বাইরে যেতে হবে নিজের দায়িত্বে। আবার ওই নারীকে একাই নিজের গ্রামে ঢুকতে হবে। এভাবেই চলে আসছে তাঁদের এখানকার নিজস্ব নীতির জীবনধারা।
গ্রামের বাড়িগুলো মাটি ও গোবর দিয়ে তৈরি। আর কাঁটাতারের ঘেরা। সম্বুরু জনজাতির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও পুঁতির গয়না পরা এখানকার সব মেয়েদের একেবারে বাধ্যতামূলক।
শুধু এই অনুশাসনেই রেবেকা থেমে থাকেননি। এখানকার বসবাসকারী মহিলাদের স্বনির্ভরতার স্বপ্নিল স্বপ্নও দেখিয়েছেন হাতে কলমে। আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি উমোজার বিষয়ে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছেন। যাতে সারা বিশ্ব অনায়াসেই এই নারী জনপদকে খুঁজে পায় ও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এক লহমায়। উমোজায় তিনি নির্মাণ করেছেন প্রাথমিক স্কুল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ক্যাম্পিং সাইট। তিনি স্থানীয় কারুশিল্প ও গহনা তৈরির বিপণন কেন্দ্রও স্থাপন করেছেন নারী সক্ষমতার দৃষ্টিকোণে। এমনকি প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাদান এই গ্রামে আবশ্যক করে তুলেছেন এই রেবেকা।
তবে ঘুরে ফিরে উমোজার সেই এক নিয়মের কঠোরতম ধারাবাহিক বর্তিকা। যে শিশুরা মায়ে লালিত্যে এখানে প্রতিপালিত হচ্ছে সে যদি পুরুষ হয় তবে তার আঠারো বছর পূর্ণ হলেই তাকে এখান থেকে বিদায় নিতেই হবে যেনতেন প্রকারেণ। এমনই পুরুষ বর্জিত কঠিনতম অনুশাসন এই উমোজাতে।
উমোজার নাম যত প্রসারিত হয়েছে রেবেকা লোলোসোলির এই স্বপ্নময় এক আলাদা বিশ্ব সম্পর্কে বিশ্ববাসী কৌতুহল ততই উচ্চ মার্গে পৌঁছেছে। তাঁর কর্মকান্ডের কথা উনার নিজের মুখে থেকে শুনতে তাঁকে ২০০৫ সালে আমন্ত্রণ জানানো হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে। সেখানেই তিনি ব্যক্ত করেন, উমোজাতে তাঁরাই আশ্রয় পান যাঁরা পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিতা, ধর্ষিতা, স্বামী পরিত্যক্তা কিম্বা কোনও সহিংসতার শিকার হয়েছেন এমন অসহায় নারী। এই গ্রাম তৈরি করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার কিছু পুরুষদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকিও আমি হরদম পেয়েছি। আমি ওসবে পরোয়া না করে নিজের লক্ষ্যেই অবিচল ছিলাম।’ রাষ্ট্রপুঞ্জের এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি সদর্পে আরও ঘোষণা করলেন, ‘উমোজা মানেই পুরুষহীন নারী সমাজ। যা একটা নতুন পৃথিবী। এই পৃথিবীটা শুধুমাত্র নারীদের নিজস্ব অধিকারের। এখানকার গ্রামীণ মাটি পুরুষের অনর্থক চোখ রাঙানি বরদাস্ত করতে অভ্যস্থ নয়।’
নারী উন্নয়নে শুধু নিজেকেই সামিল করা নয়, অন্য অসহায় নারীকেও অন্ধকার থেকে তুলে এনে নতুন আপন জগতের আলোর দিশা দেখানোর এই নারী মন্ত্রের একক সাধিকা অবশেষে চমকে দেওয়ার মতো স্বীকৃতিও পেলেন ২০১০ সালে। ‘গ্লোবাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’এর মতো অনন্য সম্মানে তিনি ভূষিত হলেন। মার্কিন প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন রেবেকার সকাশে এসে মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তিনি ওই সাক্ষাতে বলেছিলেন, ‘জীবন হেরে যাওয়ার নয়। বেঁচে থাকার। রেবেকা লোলোসোলির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। আমাদের সমগ্র নারী জাতির তিনি তাই অনন্য প্রেরণার একক প্রতিনিধি। বাস্তবিকই তিনি যে এক নতুন গ্রহের নতুন সূর্য।’
আসলে আজকের বিশ্বে রেবেকার নীড় ছোট ক্ষতি নেই। কিন্তু নারীমুক্তির আকাশ তো বড়। ধন্য উমোজা, সেলাম তুঝে সেলাম।