• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

রাজেন তরফদার: এক বিস্মৃত পরিচালক

শেষ বয়সে যখন আর প্রযোজক পাচ্ছেন না, অথচ সিনেমার নেশাও কাটছে না তখন অভিনয় করতে এলেন। সেই সময় তাঁর বয়স ৬৩।

ফাইল চিত্র

সুব্রত রায়

এরকম কেন হয়ে গেল তবে, বুদ্ধের মৃত্যুর পরে কল্কি এসে দাঁড়াবার আগে। আমরা এই সব সমস্যায় খুব বিমূঢ় বোধ করি।কিন্তু যা আমাদের জানা আছে তা হলো নিজের মুদ্রাদোষে মদন তাঁতির হাত থমকে যায়। মদন ব্যাবস্থার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারে না। সে অনাবাসী ভারতীয় থেকে শুরু করে নির্মল দম্পতি কাউকেই খুশি করতে পারে না। নিজের মুদ্রাদোষে শুধু আলাদা হয়ে যায়। বিশেষত চলচ্চিত্রের মতো নরকে যেহেতু টাকার ঋতু, টাকার আকাশ,টাকার সমুদ্র— যেখানে রূপসীর স্তনের উচ্ছাস, যেখানে নির্বোধ কন্দর্পকুমার, সেখানে শিল্পের সম্ভ্রম কতটুকু।

Advertisement

সিনেমা তো সেখানে রাজসভায় দ্রৌপদী। এখানে একাকীত্ব অনেক দূরে। রূপকথার মতো সুদূর। সেজন আজ মনে হয় রাজেন তরফদার এর ‘গঙ্গা’ (১৯৬০) বোধহয় চলচ্চিত্রের একটি অবিস্মরণীয় এপিটাফ। রাজেন তরফদার ভেবেছিলেন স্বপ্ন আর রক্তের যৌথ মিথুন ছলনা করে যাবে মৃত্যুকে। আজ আমাদের রক্তে হিম পড়ে বিজ্ঞাপনের অবিনশ্বর হোর্ডিং দেখে। সবকিছু হারিয়ে যায় শূন্যে মায়াসারসের মতো। রাজেন তরফদারও বিস্মৃত হয়েছেন। বাঙালি ইতিহাস বিরহিত বঙ্কিমচন্দ্রের অনুসরণে সহজেই বলা যায়। কিন্তু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা যত সত্য অন্য শিল্পমাধমের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আসল চলচিত্রকে সামান্য বিনোদন বা লঘু তামাশার অতিরিক্ত আর আমরা কিছু ভাবতে পারিনি। কিন্তু কেউ কেউ ভাবলেন,যেমন রাজেন তরফদার।

Advertisement

রাজেন তরফদার (১৭.০৯.১৯১৭— ২৩.১১.১৯৮৭) জন্ম রাজশাহী বাংলাদেশ। কলকাতা সরকারি শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি জে ওয়াল্টার থম্পসন সংস্থার শিল্প নির্দেশক ছিলেন। তাঁর প্রথম ছবি ‘অন্তরীক্ষ'(১৯৫৭)। কিন্তু ১৯৬০ সালে নির্মিত ‘গঙ্গা’ ছবি থেকেই তাঁর খ্যাতির শুরু। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে রসালিনী, ভিত্তরীও ডেসিকর নিওরিয়ালিস্ট ছবি দেখার সুযোগ ঘটে ভারতীয় দর্শকদের।যুদ্ধত্তর ইতালির বাস্তবতার বর্ণনা উদ্দীপ্ত করে আমাদের চলচ্চিত্র কর্মীদের। রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ সেই উৎসাহেরই ফসল। নিম্নবর্গীয় জেলেদের জীবনের এই বর্ণনা মেজাজ ও ভঙ্গীতে ভিসকোন্তির ‘লা টেরা ট্রামা’ ছবির অনুগামী। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য ছবিগুলি হলো ‘অগ্নিশিখা’ (১৯৬২), ‘আকাশ ছোঁয়া (১৯৬৭), ‘জীবন কাহিনী’ (১৯৬৪), ‘পালঙ্ক’ (১৯৭৫) ও ‘নাগপাশ’ (১৯৮৭)। তাঁর পরিচালিত দুটি ছবি ‘গঙ্গা’ ও ‘পালঙ্ক’ জাতীয় পুরস্কার পায়। তিনি ভালো অভিনেতাও ছিলেন ১৯৮২ সালে মৃণাল সেন পরিচালিত ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে তাঁর প্রথম অভিনয়। এছাড়া আর যেসব ছবিতে তিনি তাঁর অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন সেগুলি হলো ‘বসুন্ধরা”, ‘খন্ডহর’, ও ‘আরোহণ’। ‘সংসার সীমান্তে’ ও ‘গণদেবতা’ ছবির চিত্রনাট্য ছিল ছিল তাঁর রচনা। ১৯৮৮ সালে ‘নাগপাশ’ ছবির জন্য তিনি বিএফজেএ পুরস্কার পান। ‘সংসার সীমান্তে’ ছবির চিত্রনাট্যের জন্যও তিনি বিএফজেএ পুরস্কার পান।

সত্যজিৎ রায়ের মতো রাজেন তরফদারও সিনেমা করতে এসেছিলেন বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে। সেই সময় বিখ্যাত সাহেবি কোম্পানি জে ওয়াল্টার থমসনের আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। মোটা মাইনে, অফিসের গাড়ি, চাকরি না ছাড়ার জন্য কর্তাদের অনুরোধ কোনো কিছুই টলাতে পারেনি তাঁকে। পুরো সময়টায় তৈরি করতে দেবেন বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রথম ছবির পরেই। পুরো সময়টাই সিনেমাকে দিলেন অথচ ৩০ বছরের পরিচালক জীবনে তাঁর ছবির সংখ্যা মাত্র সাত। হে পাঠক স্মরণ করুন প্রাচ্যে ঋত্বিক কুমার ঘটক ও প্রতিচ্যে আন্দ্রে তারকভস্কির ছবির সংখ্যাও মাত্র আট। কিন্তু সংখ্যা দিয়ে শিল্পের গুন বিচার হয় না। আমাদের ভাবতে ভালো লাগে এঁরা অল্প ছবি করেছেন, কিন্তু আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করি যে,তার প্রতিটিই কোহিনুরের মতো ঝলমল করছে।

‘গঙ্গা’র জন্য শুটিংয়ে রাজেন বাবু ফিল্মের স্টক কাজে লাগিয়েছিলেন ৭৫ হাজার ফিট, যা থেকে ৭ থেকে ৮ হাজার ফিট আনা হয় সিনেমার এডিট টেবিলে সম্পাদক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সামনে। এক সাক্ষাৎকারে রাজেন তরফদার বকেছিলেন, ‘গঙ্গা আমার দর্শন। সমরেশ বসুর উপন্যাস অবলম্বনে আমার গঙ্গা,কিন্তু সে উপন্যাসের যথাযথ চিত্রায়ন আমার গঙ্গা নয়।’ এরপর গঙ্গার নানা দৃশ্যবিন্যাস আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলি সমরেশ বসু লেখেননি। আমার দর্শন থেকেই এটা হয়েছে এটা। এমনিতে এর ওপর আমি হাজার হাজার ফিট ফিল্ম খরচ করেছি, মনে হয় এটা আরও কম করা যেত। কিন্তু এগুলি এড়াতে পারিনি ভিসুয়ালের কারনে। ১৯৬৭ সালে নির্মিত ‘আকাশছোঁয়া’ ছবিটি ছিল এক অভিনব পেশা নিয়ে। ছবির কেন্দ্রে ছিল একটি সার্কাস দল,আর নায়ক একজন ‘মোটর সাইকেলস্টান্ট’ খেলোয়াড়।

এই ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ মুখোপাধ্যায়। তিনি আবার এই ছবির প্রযোজক ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন ‘ছবির প্রযোজক হিসাবে একটা কথা আমাকে বলতেই হবে যে রাজেনবাবু ভীষণ এক্সপেন্সিভ ছিলেন। যার জন্য ছবিতে আমার প্রচন্ড লোকসান হয়। এতবার ডিফারেন্ট এঙ্গেলে এক্সসপোজার নিতেন যে শুটিং ও সম্পাদনা ইত্যাদি সব খরচই বেড়ে যেত।’ এই আকাশছোঁয়া ছবিতে একটি অন্যরকম চরিত্র অভিনয় অভিনয় করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। শুটিংয়ের ব্যাপারে রাজেনবাবু যে একটু শ্লথ ছিলেন একথা মেনে নিয়েও একটা পাল্টা গল্প শুনিয়েছিলেন অনিল বাবু— ‘এই আস্তে আস্তে কাজ করার ফলে শিল্পীরা নিজেদের তৈরি করার অবকাশ পেটের। যেমন আকাশছোঁয়া ছবিতে আমি জাগলার। টুপি নিয়ে লোফালুফি খেলা দেখায়। এত অফুরন্ত সময় পেতাম যে সার্কাসের জাগলারের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল এবং ওর সঙ্গে থেকে আমিও একজন আধা জাগলার হয়ে গিয়েছিলাম’ এই ছবিতে শেষ পর্যন্ত জাগলারের ভূমিকায় অনিল চ্যাটার্জি নিজে অভিনয় করেছিলেন। ডামি ব্যাবহার করেননি।

কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন একটি ভিন্ন ধারার ছবির সমস্ত প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঘটনা প্রমান করে চলচিত্রের সংরক্ষণের ব্যাপারে আজও আমরা কত উদাসীন।

নদী এবং তৎসন্নিহিত জীবনকে নিয়ে রাজেন তরফদারের যে তিনটি ছবি ‘গঙ্গা’, ‘পালঙ্ক’, ‘নাগপাশ’ যাকে ট্রিলজিও বলা যায়। তাঁর এই ছবিগুলি দেখলেই মনে হয় নৌকার লেভেল ও তার গা থেকে নেওয়া হয়েছে শট।বহু ক্ষেত্রেই জলের ঢেউ এসে লেগেছে ক্যামেরায়। এমন দৃশ্যায়ন আজও আমাদের শিহরণ জাগায়। গঙ্গা ছবিটি করার সময় ভারী ক্যামেরা সমেত পড়ে গিয়েছিলেন নদীর জলে। কিন্তু তাও তিনি বিপদজনক শট নিতে পিছপা হননি। এই ছবির প্রযোজক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তরুণ ঔপন্যাসিক সাধন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা সমকালীন রাজনীতি ভিত্তিক কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হয় নাগপাশ ছবিটি। নায়কের চরিত্রে নেন নতুন মুখ সুমন্ত মুখোপাধ্যায়কে।

শেষ বয়সে যখন আর প্রযোজক পাচ্ছেন না, অথচ সিনেমার নেশাও কাটছে না তখন অভিনয় করতে এলেন। সেই সময় তাঁর বয়স ৬৩। বরাবরই নিজের ছবিতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় করে দেখতেন এবং অপূর্ব ছিল সেই অভিনয়। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’ আর ‘খন্ডহর’ ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শকের নজর কাড়ে। শেখর চট্টোপাধ্যাযের ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে তিনি ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন। শ্যাম বেনেগালের ‘আরোহণ’-এর শুটিং করছেন তখন রাজেনবাবুর ছেলে গোরা তরফদারের মনে আছে সেই সময় একদিন ফটোগ্রাফাররা শ্যাম বেনেগালের ছবি তুলতে গেলে পরিচালক বেনেগাল বলেন, আমার ছবি কি তুলছেন কলকাতার এই জিনিয়াস ডিরেক্টরের ছবি তুলুন। সেদিন একথার পর রাজেন বাবুর চোখের কোনায় জল ছিল কোনটা জানা যায়নি। তাঁর জন্মশতবর্ষ খুব নীরবে অতিবাহিত হয়েছে।তাও এখনো সময় আছে। আজও যদি আমরা তার ছবিগুলোর প্রদর্শন ও সংরক্ষনের ব্যাপারে উদ্যোগী হই সেটাই হবে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Advertisement