হীরক কর
জঙ্গলমহল তথা বৃহত্তর ছোটনাগপুরের আদিম জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড়ো উৎসব হলো-“করম পরব”। এই উৎসব মূলতঃ কৃষি ভিত্তিক। বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা সহ পশ্চিমবঙ্গের প্রধানত জঙ্গলমহলের বাঁকুড়া,পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলায় ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালন করেন এলাকার কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষজন। সেই সঙ্গেই জঙ্গলমহলের ভূমি পুত্ররা যেমন কোল, কোড়া, ভূমিজ,সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, মাঝি প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনও এই উৎসব শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে থাকেন।
Advertisement
ভাদ্রমাসের একাদশী তিথিতে “করম পরব” অনুষ্ঠিত হয়। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপবাস থেকে জাওয়া নাচ ও গীতের মাধ্যমে, শস্য উৎপাদনের মঙ্গল কামনায় দিনটি করম দেবতার সংকল্পে নিবেদিত করে। মূলত, কৃষিকাজের প্রয়োজনে শষ্যবীজ সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান অর্জন; সেই সঙ্গেই অঙ্কুরোদ্গম প্রক্রিয়াকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করা এই পরবের অন্যতম উদ্দেশ্য।
Advertisement
মূলত পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলের প্রান্তজন অর্থাৎ বাউরি, খেড়িয়া, শবর, কোড়া, বাগদি, হাড়ি, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জনজাতির মধ্যে এই করম দেবতার পূজার এবং তাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত করম পরবের প্রচলন রয়েছে। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’— ঈশ্বরের কাছে এহেন আবদার যেন যুগের পর যুগ ধরে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে সব সময়েই। তাই এখানকার অন্যান্য উৎসবের মতোই, প্রান্তিক আদিবাসী সমাজের এই অনেকটাই অচেনা উৎসব করম পরবের মূল কামনার জায়গাটা হল শস্য ও সন্তানের সমৃদ্ধি। যখন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বর্ষার শেষে মাঠে বেড়ে উঠেছে সবুজ ধান, তখন হাওয়া খেলে গেলে ধানের শিষে, তাতে পড়ে যেন স্নেহের পরশ। মানভূম, জঙ্গলমহল— এই সমস্ত অঞ্চলের গ্রামগঞ্জে আদিবাসী সাঁওতাল, মাহাতো কুড়মি তো বটেই, তাদের সঙ্গে সঙ্গে এই করম উৎসবে মেতে ওঠে ওঁরাও, মুন্ডা, কামার, কুমোর, ভূমিজ, বাগাল প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষজনও।
এই দিন গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে করম (কদম) গাছের ডাল এনে বাড়ির উঠোনে বা মাঠের মাঝে পৌঁছে দেয় গ্রামের কুমারী মেয়েরা। করম গাছ না পাওয়া গেলে তার বদলে আনা হয় শাল গাছের ডাল। তারপর শুরু হয় দ্রিম দ্রিম বাজনা। নাচে-গানে গ্রামের সকলে মেতে ওঠে মাদলের তালে। সাঁওতাল সমাজে গ্রামের পুরোহিতকে বলা হয় ‘লায়া’। সেই লায়া গ্রামের পাহাড়ঘেরা কোন মাঠের মাঝে প্রথাগত ভাবে সূচনা করেন এই করম পরবের। ক্ষেত ভরা নতুন ফসলের প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসব মঙ্গল কামনা করে নিজের সন্তানেরও। রুখা-সুখা পাথুরে মাটি যেন ভরে ওঠে সবুজ ফসলে— সেই আশাতেই আয়োজন হয় এই পরবের। এই মানভূমের বেশিরভাগ উৎসবই তাই, প্রকৃতির আরাধনা।
দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে আত্মীয়-স্বজনেরা হাসিমুখে আসতে থাকেন তাঁদের কুটুমবাড়িতে। বাবা-মায়ের হাত ধরে আসে হাফ প্যান্ট বালক বা মাথায় লাল ফিতে বাঁধা বালিকাও। কুটুমবাড়ির গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আনন্দ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে সকলে। দুপুর পেরোলে বৃষ্টি ঝরে ফসলের শিষে। সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিধারায় লাল বা সবুজ পাড়ের সাদা শাড়িতে সেজে ওঠে মেয়েদের দল। কালো চুলের খোঁপায় বেঁধে নেয় হলুদ গাঁদা ফুলের মালা। কালো মেয়ের চোখের টানেই হয়তো নেশা পেয়ে যায় গ্রাম্য যুবকের মাদলও। মাদলের বোলে মেয়েরা গেয়ে ওঠে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ‘জাওয়া গান’। মানভূম সমাজের চালচিত্র মেনেই এই গানে লুকিয়ে থাকে এখানকার নারী সমাজের রোজকার জীবনের দুঃখ-দুর্দশা-প্রেম-ভালোবাসার হাসি-কান্না-হীরা-পান্না।
প্রচলিতভাবে যে কোনও পরব বা উৎসব কোনও না কোনও দেবতা, মন্দির বা বিগ্রহকে ঘিরে অনুরণিত হলেও এই করম পরবের মূল অনুষঙ্গ আবর্তিত হয় শুধু এবং শুধুই বৃক্ষকে ঘিরেই ।
Advertisement



