মোদী সরকারের একের পর এক ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরাতেই ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে তাঁদের উপর নির্মম অত্যাচার চালানো হচ্ছে। দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদ তৈরি করার উদ্দেশ্যে, আরএসএস-এর চিরাচরিত কায়দায় রাজ্যে রাজ্যে এই ধরনের চিহ্নিতকরণ করছেন বিজেপি নেতারা। গত বেশ কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে বীভৎসতার এই নতুন ঢেউ উঠেছে। রাজ্যে রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দেওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাভাষী এবং ধর্মে মুসলমান হলে তো আর কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে।
এটি একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য প্রচার। এই প্রচারের ভাষাকে ধরেই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) আনা হয়েছিল। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এই ধাঁচের প্রচারের মধ্যমণি। সম্প্রতি তিনি প্রকাশ্যেই বাংলাভাষী সমস্ত মানুষকে ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করতে শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, বাংলাভাষী ও বাংলাদেশি বলে পরিচিতির মানুষের মধ্যে অভেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এমন মন্তব্যে বিভিন্ন মহল থেকে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে, তাতে আবার পিছিয়ে গিয়ে হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেছেন, ‘মানছি যে আইনত ওঁরা সবাই ভিনদেশি নয়। তবে আমরা অসমিয়া ভাষী মানুষ, বিশেষ করে হিন্দুরা, নিজেদের রাজ্যেই সংখ্যালঘু হয়ে গিয়েছি। গত ৬০ বছর ধরে আমাদের কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আমাদের সংস্কৃতি, জমি, মন্দির সবই খোয়াতে বসেছি। দেশের আইন আমাদের কোনও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়নি। পুরোপুরি হতাশাজনিত কারণেই আমরা এই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হচ্ছি। কোনও প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র টিঁকে থাকার চেষ্টায়।’ ‘হতাশাজনিত’ এই প্রতিক্রিয়ায় এই অনুশোচনা বিন্দুমাত্র নজরে পড়েনি। তার কারণ, আসাম সীমান্ত থেকে এই সমস্ত অসহায় মানুষদের ‘পুশব্যাকের’ যতগুলি ঘটনা ঘটেছে তার সবকটাই কোনোরকম অকাট্য প্রমাণ ছাড়া হয়েছে।
Advertisement
বিজেপির আসল উদ্দেশ্য এই সমস্ত মানুষকে তাঁদের হকের জমি থেকে উচ্ছেদ করা। এই সমস্ত জমি কর্পোরেট জমি-হাঙরদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে অসমের বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজের মধ্যে বিভাজন তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য। আসলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি করে ভোটের আগে রাজ্য প্রশাসনের একের পর এক ব্যর্থতার থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরাতেই এই ধরনের বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।
Advertisement
আরএসএস-এর চিরাচরিত জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে চিহ্নিত করা বিভেদকামী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ২০১১-র জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা ১৯৯১-২০১১ সালে ২ লক্ষ ৭৯ হাজার থেকে কমে, ২০০১-২০১১ সালে ১ লক্ষ ৭২ হাজারে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসনের হার দুই দশকে ৫০ শতাংশ হারে কমেছে। তবে ভুয়ো খবর আর হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডের জমানায় বাস্তবিক তথ্যকে আর কে পাত্তা দেয়!
শুধু আসমেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের এক করে দেখার এক জঘন্য চক্রান্ত চলছে। পরিচয়পত্র সংক্রান্ত নথিপত্র সঠিকভাবে যাচাই না করেই বাংলাভাষীদের তীব্র হেনস্থা ও নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মোট ৯ লক্ষ ১৩ হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ২ লক্ষ ৪৭ হাজার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থাৎ অন্তত ২৭ শতাংশ। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে তাঁদের এক বড় অংশকে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজের খোঁজে যেতে হয়। তাঁদের সরাসরি বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভিনরাজ্যে আধার, রেশন বা এপিক কার্ড বাদে পরিচয়পত্র হিসাবে তাঁদের আর কিছুই দেখানোর সুযোগ নেই। অথচ এই সমস্ত নথিই এখন সরকারের তরফে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।
পরিযায়ী শ্রমিকরা বিশ্ব পুঁজিবাদের বিকাশের এক অভেদ্য অঙ্গ। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে শ্রমের গতিশীলতা বেড়েছে। এটি একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তার ফলে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রয়োজন আছে। একুশ শতকে এই সমস্যা আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। অভিবাসী ভূমিপুত্র সংঘাত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গোটা দুনিয়ায় অতি-দক্ষিণপন্থী শক্তি অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের নামে পরিযায়ী শ্রমকদের উপর দেদার আক্রমণ করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন বিরোধী রাজনীতিই তার উদাহরণ। ভারতের পরিস্থিতি তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
ভারতের সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্রের প্রতি দেশের বর্তমান শাসকের চরম বিরোধিতা আরএসএসের পৃষ্ঠপোষকতায় দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এই বৈচিত্রই আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
Advertisement



