কবিতা মুখোপাধ্যায়
পহেলগামে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর গোটা দেশ থেকে একটা দাবি উচ্চারিত হয়েছিল এই জঘন্য হত্যার বিরুদ্ধে চরম শাস্তির ব্যবস্থা। এক কথায় বদলা চাই। জঙ্গিদের চ্যালেঞ্জ ছিল সরাসরি ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রধানত প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। এই চ্যালেঞ্জের পিছনে লুকিয়ে আছে একটা ছোট্ট বার্তা, যেটা হয়তো আমরা অনেকেই খেয়াল করিনি, বা সেভাবে গুরুত্ব দিইনি, সেটা হল— ‘যাও গিয়ে মোদীকে বল’। কেন হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর নাম করে এই বার্তা? কারণ খুব পরিষ্কার, বিগত এক দশক ধরে ক্রমান্বয়ে দেশের মুসলিম নাগরিকদের বিরুদ্ধে যে জেহাদ ঘোষণা হয়েছে, হচ্ছে, সেটাই ইন্ধন জুগিয়েছে এত হিন্দু বিদ্বেষের প্রতি। অনেকেই বলবেন জন্মাবধি (১৯৪৭) পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষ এবং পরবর্তীতে জঙ্গিদের বার বার ভারতে নাশকতামূলক কাজ সংগঠিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে এই জঙ্গি আক্রমণ। কিন্তু একটা কথা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচন করি না, সেটা হল পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষ কখনও সর্বাঙ্গীন ‘হিন্দু বিদ্বেষ’ ছিল না। যদিও ধর্মের ভিত্তিতেই জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। এ বিষয়ে প্রধান দাবিটা ছিল মহম্মদ আলি জিন্নার, কিন্তু এটা অবশ্যই বলা দরকার যে এই ধর্মীয় বিভাজনের ক্ষেত্রে বহু হিন্দু নেতারও সমর্থন ছিল। যেমন ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গ-ভঙ্গ’ কখনওই প্রতিরোধ করা সম্ভব হত না যদি না বিশ্বকবির মতো মানুষরা এগিয়ে আসতেন। সেই বঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হল ১৯৪৭ সালে। সে সময়ের বাংলার নেতারা পারেননি বা চাননি এই বিভাজনকে প্রতিহত করতে। তাই ১৯৪৭ পেল একই বাংলার দু’টি রূপ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গ যার বিষফল আজও বাংলার মানুষকে গ্রহণ করতে হচ্ছে।
হ্যাঁ, যেটা বলতে চাইছি, পাকিস্তানের জন্ম ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে। আর ভারতবর্ষ নানা জাতি, নানা ধর্মকে নিয়ে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশ। ভারতবর্ষের সংবিধানের যে মূল লক্ষ্য (objectives) যার উপর নির্ভর করে এই সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে ধর্মাচারণের (worship) অধিকার। তাই দেখা যায় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত— “We the people of India, having solemnly resolved to constitute India into a Sovereign, Socialist, Secular Democratic Republic…” সুতরাং ১৯৪৭-এ দু’টি দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষের কারণ ‘হিন্দু’ বিদ্বেষ এটা সর্বাংশে সঠিক ভাবনা নয়। এই বিদ্বেষের কারণ খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৪৭-এ। কাশ্মীরের কর্ণধার হরি সিং দ্বিখণ্ডিত ছিলেন তিনি ঠিক কী করবেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল স্বাধীন কাশ্মীর। ভারত বা পাকিস্তান কোনও দেশেই যোগ না দেওয়া। এই ভাবনার কালেই কাশ্মীর আক্রান্ত হল মুসলিম উপজাতি গোষ্ঠীর দ্বারা ১৯৪৭-এর অক্টোবরে। এবং পাকিস্তান পিছন থেকে এদের মদত দিতে থাকে কাশ্মীর দখলের জন্য। একথা আমরা সবাই জানি ভৌগোলিক কারণেই কাশ্মীর ভারত-চিন এবং পাকিস্তানের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। উপজাতিদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে না পেরে হরি সিং ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু সমস্যা হল কাশ্মীর তখনও স্বাধীন রাজ্য। তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় বাধ্য হয়ে হরি সিং বিশেষ কিছু শর্ত অনুসারে ভারতে যোগ দেন। সেই সময় তেকেই বলতে গেলে কাশ্মীরে শান্তি নেই। এরপর ১৯৬৫ ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে জেনারেল জে এন চৌধুরির নেতৃত্বে ভারতের সেনাবাহিনী দেখিয়েছিল তাদের পরাক্রম। বৈজন্ত ট্যাঙ্কের অবস্থানও ছিল উল্লেখযোগ্য। সে সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ছোট্ট-খাট্টো মানুষ লালবাহাদুর শাস্ত্রী। যাঁর দু’টি স্লোগান আজও অনুরণিত হয়— ‘জয় জোয়ান, জয় কিষাণ’, ‘গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দেবেন না।’ অসম সাহসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই প্রধানমন্ত্রীর যদি অকাল প্রয়াণ না হত, তবে হয়তো ভারতবর্ষের চেহারাটা অন্যরকম হত। এক্ষেত্রেও পাকিস্তানের যুদ্ধটা ছিল না ধর্মের জন্য। ১৯৭১ আবারও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এবার যুদ্ধের কেন্দ্রে উঠে এলো বাংলাদ্শের মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতবর্ষ ছিল তাদের পাশে। পূর্ব পাকিস্তানের এই মুক্তিযুদ্ধে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি জয়প্রকাশ নারায়ণকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। সেভাবে কোনও সমর্থন মেলেনি। আমেরিকার সমর্থন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তারা পাঠিয়েছিল সপ্তম নৌবহর। তবে অসমসাহসী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্না ইন্দিরা গান্ধি দেশের সেনাবাহিনীর উপরে পূর্ণ আস্থা রেখে পূর্ব-পশ্চিম উভয় ফ্রন্টের যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাশে থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি।
এর পরও দেশ দেখছে সংসদ, আক্রমণ, কারগিল যুদ্ধ, মুম্বই-এ জঙ্গি হামলা। সেখানেও কিন্তু ‘ধর্ম’ ছিল না মুখ্য বিষয়। অথচ পহেলগামে জঙ্গি হামলার নিশানা হল ‘হিন্দু’ পুরুষ। হিন্দু নারীদের কাছে সিঁদুরের গুরুত্ব অসীম তাই সুনির্দিষ্ট ভাবে স্ত্রীর সামনেই হত্যা করা হল পুরুষদের (স্বামীদের)। কিন্তু এই প্রাণগুলি চলে যাওয়ার পিছনে থেকে গেল না কি আমাদের অপ্রত্যক্ষ ইন্ধন? আসলে এটা আমাদের সকলের জানা প্রতিটি ক্রিয়ার থাকে একটা প্রতিক্রিয়া। এখানেও কি থেকে গেল না সে রকমই কোনও প্রতিক্রিয়া? বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অপ্রয়োজনীয় ভাবে আক্রমণ, হত্যা, মসজিদগুলির অস্তিত্বকে নস্যাৎ করার জন্য লাগাতার প্রচেষ্টা তারই কি করুণ পরিণতি নিরীহ পর্যটকদের অকাল প্রয়াণ? এটা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সমগ্র দেশবাসীর একটাই দাবি উঠে এসেছিল বদলা চাই। দেশের যার নেতৃবর্গ তাঁদের ভাষণে উঠে আসে কড়া বার্তা। সেই বাংলার সুনির্বাচিত নাম— ‘অপারেশন সিঁদুর’। এই নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জড়িত সাধারণ মানুষের ‘সেন্টিমেন্ট’-কে ব্যবহার করে। কেননা অধিকাংশ হিন্দু মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর কল্যাণে সিঁদুর ব্যবহার করে, তাই-না এর বেশি বিস্তারের কোনও প্রয়োজন নেই।
ঘোষিত ‘অপারেশন সিঁদুর’ যখন সক্রিয়, যখন ভারতের সেনা বাহিনীর নিখুঁত নিশানা সমগ্র দেশকে গর্বিত করে চলেছে, যখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিক্রম দুরমুশ করে দিচ্ছে পাকিস্তানের মনোবল, ঠিক সেই সময় ঘোষণা হল যুদ্ধ বিরতির এবং বিস্ময়ের সঙ্গে দেশবাসী দেখলেন এই ঘোষণা প্রথমে উপস্থাপিত হল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায়। যদিও পরবর্তীতে ভারত আপাত যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কোনও বিষম যুদ্ধ হোক সেটা কোনও বাস্তববোধ সম্পন্ন মানুষই চাইবেন না। কেননা পরমাণু শক্তি প্রয়োগে পাকিস্তান হয়তো পিছপা হবে না, যদি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। নিশ্চয়ই যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন ছিল কিন্তু সেটা কোনও তৃতীয় দেশের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে উঠে আসবে, সেটা কোনও সার্বভৌম দেশের জন্য অবশ্যই সম্মানের নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ভারতবর্ষ অনেক বেশি সম্মান ও মর্যাদা দাবি করে। ভারতবর্ষের বিষয়ে কোনও কথা বলার অধিকার নিশ্চয়ই ট্রাম্পের নেই এটা তাঁর মনে রাখা প্রয়োজন। তবে এই আপাত যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত সর্বাংশে সঠিক কিনা, সেটা বলবেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের ধর্মের তাস খেলে যাওয়াটা কিন্তু কোনওভাবেই মান্যতা পাওয়া উচিত নয়। কেননা ভুলে গেলে চলবে না ভারতবর্ষের প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে চিন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। এরা কেউই ভারতের মিত্র নয়। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে উঠে আসা প্রতিরক্ষায় আত্মনির্ভর ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপ হওয়া উচিত সুচিন্তিত। যেন এমন না হয় রাজনৈতিক চাপে বা দেশের বাইরের নানা শক্তির চাপে দেশকে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। কে সঠিক বন্ধু, অসময়ে কে পাশে থাকবে দৃঢ়তার সঙ্গে সে বিষয়েও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, দেশ নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ যেন দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে না যায়। সেই সঙ্গে দেশের নাগরিকদেরও হতে হবে অনেক বেশি দায়িত্বশীল। মুখে শুধু স্লোগান— ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’— এটা নয়। প্রয়োজন মানবিক বোধ ও চেতনা। কয়েকজনের অপরাধ যেন সমগ্র জাতিকে অপরাধীর কাঠগোড়ায় না দাঁড় করিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে একথাও মনে রাখা প্রয়োজন মানবতার কথা, মানবিকতার কথা বলার অর্থ দেশের বিরুদ্ধতা নয়। সংকটের সময় যেন এ প্রশ্ন না উঠে আসে ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? / কাণ্ডারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! (সঞ্চিতা)। মনে রাখতে হবে ১১৮ বছর আগে কবিগুরুর উচ্চারিত বাণী, যা উচ্চারিত হয়েছিল গান্ধারীর আবেদন কবিতায় গান্ধারীর মুখ থেকে— ‘শত্রু যার আত্মীয়স্বজন / আত্মা তার নিত্য শত্রু, ধর্ম শত্রু তার, / অজেয় তাহার শত্রু। নব অলংকার / কোথা হতে হে কল্যাণী?’