• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

আরজি কর কাণ্ডের এক বছর— ধর্ষণ রোখার দায়িত্ব কি শুধু প্রশাসনের?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলাদের উপর যৌন অত্যাচারকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে সমাজ, এমনকী প্রশাসনও। পুরুষদের উপর যৌন নির্যাতনের প্রসঙ্গ প্রায় ওঠে না বললেই চলে। অন্যদিকে মহিলাকে যৌন হেনস্থার জন্য একমাত্র কোনও পুরুষই দায়ী হতে পারে— এই ধারণাই প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ঘটে। যেমন, হুগলির একটি কলেজে সমকামী প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে এক অধ্যাপিকার বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তও একজন নারীই।

প্রতীকী চিত্র

৯ আগস্ট। গত বছর অভিশপ্ত এই দিনেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয়েছিল হাসপাতালেরই এক তরুণী চিকিৎসকের দেহ। ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। রাজ্য বিধানসভায় অপরাজিতা বিল পাশ, সিবিআইয়ের ব্যর্থতা থেকে শুরু করে অভয়া তহবিল নিয়ে বিতর্ক— এই এক বছরে বহু ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী থেকেছে রাজ্য। ইতিমধ্যেই আরজি কর কাণ্ডে ‘একমাত্র অভিযুক্ত’ সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেছে শিয়ালদহ আদালত। কিন্তু এত কিছুর পরেও ধর্ষণ আটকানো যাচ্ছে না কেন? দায়িত্ব কি শুধু প্রশাসনের? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

নিত্যদিনের জীবনে নারী নির্যাতন নিয়ে বেশ কয়েকটি টার্ম শোনা যায়। ইভ-টিজিং, শ্লীলতাহানি, যৌন নিগ্রহ, ইচ্ছাকৃতভাবে যৌন স্পর্শ, যৌন নির্যাতন এবং সর্বোপরি ধর্ষণ। নারীর উপর এই ৬ ধরনের অপরাধ নিয়ে মানুষের ধারণা এক-এক রকম। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ইভ-টিজিংয়ের মতো অপরাধকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যে মহিলার সঙ্গে এই অপরাধ হয় তিনিও বেশিরভাগ সময়েই বিষয়টি এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করেন। অন্যদিকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব সবথেকে বেশি। এমনকী প্রশাসনও অনেকক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের ধরন দেখে ঘটনার গুরুত্ব বিচার করে। কিন্তু আদৌ কি এরকম হওয়া উচিত? নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের প্রকারভেদ করে কি আদপে অভিযুক্তদেরই সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে না? কোনও মহিলার সামনে নগ্ন হয়ে তাঁর দিকে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করাকে ধর্ষণের ঘটনার থেকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কারণ এক্ষেত্রে ওই মহিলাকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করছে না অভিযুক্ত। কিন্তু এই ঘটনাও কি ধর্ষণের থেকে কম গুরুতর? এভাবে ধর্ষণ ছাড়া বাকি অপরাধগুলিকে অজান্তেই ‘স্বাভাবিক’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে কোনও ঘটনা মিডিয়া কভারেজও পায়। ঘটনার বীভৎসতা, স্থান, কাল, নির্যাতিতার পরিচয়ের উপরেও কভারেজ পাওয়ার বিষয়টা নির্ভর করে। ভারতে প্রতি বছর ৩০ হাজার ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ দায়ের হয়। প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অনেকক্ষেত্রে তো অভিযোগও দায়ের করা হয় না। সেগুলি পুরোপুরি অজানাই থেকে যায়।

Advertisement

সর্বভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রাক্তন চেয়ারপারসন তথা বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন কুস্তিগিররা। তাঁর বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে (স্তন ও পেট) স্পর্শ করার মতো গুরুতর অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। কিন্তু এই সব কাজকে ‘স্বাভাবিক’ বলেই দাবি করেছেন ব্রিজভূষণ সহ আরও অনেকে। বিজেপি নেতাকে ফাঁসানোর জন্যই এই নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। অনেকে আবার এই ঘটনাকে তুচ্ছ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। সত্যিই কি এই নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছিলেন কুস্তিগিররা? নির্যাতিতার মৃত্যু বা কোনও গুরুতর ক্ষতি না হলে কি সমাজ অপরাধের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না? ভারতীয়রা কি তবে অপব্যবহার ও হয়রানিকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নিচ্ছেন?

Advertisement

২০২২ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশজুড়ে ৩১ হাজার ৫১৬টি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। তার মধ্যে ২৩২৪টি অভিযোগ পরিবারেরই কোনও না কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে উঠেছে। এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র অভিযোগ দায়ের হওয়া রেকর্ডের উপর ভিত্তি করেই প্রকাশ করা হয়েছে। আরও কত হাজার ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে পরিবারের অন্দরেই। অর্থাৎ বাড়ির মধ্যেই সুরক্ষিত নন শিশু, মহিলা, বৃদ্ধারা।

ভারতীয় সমাজে নারীদের ‘দেবী’র সঙ্গে তুলনা করা হয়। অন্যদিকে তাঁদেরই নিত্যদিন অসম্মান করা হয় বিভিন্ন ছুতোয়। দেশের আইনব্যবস্থা অনুযায়ী, কোনও নারীর সঙ্গে যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটলে তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম পরিচয় প্রকাশে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। কারণ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণকে নারীর সম্মানের সঙ্গে একই মাপকাঠিতে বিচার করে মানুষ। অনেক সময় এর জন্য মহিলাদের দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতা যে খুবই ভয়ঙ্কর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ছোটো ছোটো জামা পরে রাস্তায় বেরোয়’, ‘রাত করে বাড়ি ফেরে’, ‘ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে’— এই ধরনের মন্তব্য করে মহিলাদের উপর ঘটে যাওয়া অপরাধকে অনেক লঘু করে দেখা হয়। যৌন হেনস্থার ঘটনায় মহিলাদের দায়ী করে আমরা আখেরে অপরাধীদের সুবিধা করে দিই। যৌন হেনস্থার জন্য মহিলার পোশাক দায়ী হলে সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে বোরখা পরিহিত মহিলার সঙ্গে যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটত না। রাত করে বাড়ি ফেরাতেই যদি সমস্যা থাকত তাহলে দিনে দুপুরে ধর্ষণের কোনও অভিযোগ উঠত না। মহিলাদের উপর আঙুল তুলে আমরা সর্বোপরি নিজেদের দায়িত্ব থেকে হাত ঝেড়ে ফেলি। মনে রাখতে হবে, আমার প্রতিবেশী মহিলা সারা দিনের মধ্যে যখন খুশি নিজের মতো হেঁটে চলে না বেড়াতে পারলে সেটা আমার ব্যর্থতা। গোটা সমাজের ব্যর্থতা। মহিলাদের দায়ী করে সেই ব্যর্থতাকেই ঢাকার চেষ্টা করা হয়। তবে ধর্ষণের কারণে কোনও মহিলার সব থেকে বড় ক্ষতি অর্থাৎ মৃত্যু হলে সমাজের সব স্তরের মানুষকেই দেখা যায় আন্দোলনে রাস্তায় নামতে। আরজি কর কাণ্ড কিংবা দিল্লির নির্ভয়া মামলার ক্ষেত্রে কেউই নির্যাতিতার দোষ গুণ বিচারে নামেননি। কারণ তাঁরা বেঁচেই ছিলেন না।
আরজি কর কাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সঞ্জয় রায়কে পশুর সঙ্গে তুলনা করা হয়ছিল। তাঁর ‘পশুর মতো প্রবৃত্তি’ রয়েছে বলে ধর্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে টিভি শোয়েরও আয়োজন করা হয়েছিল। ঘটনার বীভৎসতা দেখে অভিযুক্তকে ‘পশু’ বলে দাগিয়ে দিয়ে তার কাজকে ‘স্বাভাবিক’ বলে ভেবে নিতে সকলেরই সহজ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, সঞ্জয়ও মানুষ। আর মানুষের দ্বারাই এই ধরনের কাজ সম্ভব— আরজি কর কাণ্ডই তার প্রমাণ।

আরজি কর কাণ্ডের পর রাজ্যে নারী নির্যাতনের এমন একাধিক মামলায় অতি দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দোষীর সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। সম্প্রতি মেয়েকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার ১৫ মাসের মধ্যে বাবাকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে আসানসোল আদালত। গত বছর জয়নগরে এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। সেই মামলাতেও মাত্র ৬২ দিনের মাথায় দোষীর ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেন বারুইপুর আদালতের বিচারক। নারী নির্যাতন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি এই মর্মে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশজুড়ে বহু ধর্ষণের মামলা দীর্ঘদিন ধরে আদালতে বিচারাধীন। নির্যাতিতাদের বিচার পেতে দেরি হওয়ার অর্থ অপরাধীকে সুবিধা করে দেওয়া। তাই অতি দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দোষীর শাস্তি ঘোষণার মাধ্যমে এই ধরনের অপরাধমনস্ক মানুষদের চিন্তাভাবনাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করা যেতে পারে। কিন্তু সমাজকে পুরোপুরি ধর্ষকমুক্ত করতে হলে গোড়া থেকে কাজ করতে হবে।

ধর্ষণ রোখার ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল শিক্ষা। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা নয়, এই শিক্ষা বাড়ি তথা পরিবারের অন্দর থেকেই শুরু করতে হবে। ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’। ছোটোবেলা থেকেই বাড়ির ছেলে ও মেয়ের মাথায় একটা বিষয় ঢুকিয়ে দিতে হবে যে, কিছু শারীরিক গঠন ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনও ফারাক নেই। হাসি-মজা-ঠাট্টা ও অসম্মানের মধ্যে যে সরু সীমারেখা আছে তা যেন কখনও অতিক্রম করা না হয়। সতর্ক থাকতে হবে পরিবারের বড়দেরও। কোনও ছেলে বা মেয়ের বিষয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য করার আগে বড়দেরও ভাবতে হবে, ছেলে বা মেয়েও কিন্তু সেই জিনিসটাই শিখছে। মনে রাখতে হবে, কোনও স্কার্ট পরিহিতা মহিলার প্রতি আপনার তীর্যক নজর কিন্তু আপনার ছেলেও দেখতে পাচ্ছে। এভাবে আপনিই তার মধ্যে এই শিক্ষা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যে, কোনও মহিলার স্কার্ট পরা ‘স্বাভাবিক’ নয়। মনে রাখতে হবে, এভাবেই ওই ছোটো শিশুর মনেও বপন করা হচ্ছে বৈষম্যের বীজ, যা তাকে ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ করে তুলতে পারে। ভারতীয় সমাজে বাড়ির মহিলাদের ছোটোবেলা থেকেই সাবধানে চলাফেরা করার শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ির ছেলেকে সম্মান করার পাঠ পড়ানোর ক্ষেত্রে সেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই পাঠ যে সবথেকে বেশি জরুরি তা বলাই বাহুল্য। মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ মানুষকে সম্মান করতে শিখলে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমবে বলে আশা করা যায়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলাদের উপর যৌন অত্যাচারকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে সমাজ, এমনকী প্রশাসনও। পুরুষদের উপর যৌন নির্যাতনের প্রসঙ্গ প্রায় ওঠে না বললেই চলে। অন্যদিকে মহিলাকে যৌন হেনস্থার জন্য একমাত্র কোনও পুরুষই দায়ী হতে পারে— এই ধারণাই প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ঘটে। যেমন, হুগলির একটি কলেজে সমকামী প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে এক অধ্যাপিকার বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তও একজন নারীই। তাই যৌন হেনস্থার ক্ষেত্রে মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করাই যথাযথ।

Advertisement