মেক্সিকোর প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট বামপন্থী ক্লডিয়া

Written by SNS June 8, 2024 1:48 pm

ড. কুমারেশ চক্রবর্তী

মেক্সিকো প্রজাতন্ত্রের ২০০ বছরের ইতিহাসে এক নতুন নজির গড়লেন ক্লডিয়া সেনবাগ(৬১)! তিনিই প্রথম মহিলা যিনি মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন যা গত ২০০ বছরের ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি৷ এবারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২ জুন ২০২৪৷ এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও একটি নেতিবাচক রেকর্ড তৈরি হলো৷ নির্বাচনী হিংসায় ৩৮ জন ভোট প্রার্থী নিহত হয়েছেন৷ মেক্সিকোয় যে কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার দাঙ্গা খুন অপহরণ হয়েই থাকে সেখানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুন যখম হবে এটা স্বাভাবিক৷ প্রতিবারেই ডজন খানেক মানুষ মারা যায় এই নির্বাচনী হিংসায়৷ ১০ থেকে ২০ জনের মৃতু্য প্রায় স্বাভাবিক৷ কিন্ত্ত এবারে সেই মৃতু্যর ঘটনা রেকর্ড করে ফেলেছে৷ অন্য বারের চেয়ে প্রায় ডবল ভোটপ্রার্থী নিহত হয়েছে৷ শেষ পাওয়া খবর মানে নির্বাচনের পরের দিন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩৮ জন ভোট প্রার্থী৷ যা এর আগে কখনো হয়নি৷ এবারে ভোটার সংখ্যাও ছিল অন্যবারের থেকে বেশি, প্রায় ১০ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছেন৷ মেক্সিকোর মোট জনসংখ্যা ১২ কোটি ১০ লক্ষ৷ নির্বাচনের পরের দিনই ফলাফল ঘোষিত হয়েছে৷ তাতেই দেখা গেছে মোরেনা পার্টির বামপন্থী নেত্রী ক্লডিয়া প্রায় ৬০% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন৷ এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য৷ শত শত বছরের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং মানসিকতাকে ভেঙে চুরমার করে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন ক্লডিয়া একইসঙ্গে তিনি পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে যাকে ন্যাশনাল প্যালেস বলা হয সেই আইনসভার দুই কক্ষেই তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে৷ ফলে সরকার পরিচালনা, সংবিধান সংশোধন, ও প্রয়োজনীয় আইন রচনা করা ক্লডিয়ার পক্ষে খুব সহজ হবে৷ আগামী ৬ বছর তিনি ন্যাশনাল প্যালেসে রাজত্ব করবেন৷

ক্লডিয়া মেক্সিকোর অন্যান্য নেতা-নেত্রীদের মতো নন৷ তার চলাফেরা, তার আচরণ, তার জীবনযাপন সবই অত্যন্ত সাধারণ, সম্ভবত বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী বলেই তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গেই মিশে চলাফেরা করেন৷ সাধারণ মানুষের জন্য যেসব বাস বা যানবাহন থাকে তাই তিনি ব্যবহার করে থাকেন৷ এমনকি তিনি বিশেষ বিমান ব্যবহার করেন না৷ বিমানে উচ্চ শ্রেণী নয় সাধারণ শ্রেণীতেই চলাফেরা করেন৷ অথচ এই নেত্রী অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার, জলবায়ু বিজ্ঞানী হিসেবে মেক্সিকো এবং আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত৷ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় তাঁর প্রায় ১০০ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং তার লেখা উচ্চমানের বহু গ্রন্থ আছে৷ নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বামপন্থী নেত্রী ক্লডিয়া মেক্সিকো সিটির মেয়র ছিলেন৷ মেক্সিকো রাজনীতিতে বলা হয়ে থাকে, যিনি মেক্সিকো সিটির মেয়র নির্বাচিত হবেন তিনি ভবিষ্যৎ মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট হবেন৷ বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে৷ তবে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়ার এই উচ্চ আসন লাভ ও উন্নয়নের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে তার রাজনৈতিক গুরু প্রেসিডেন্ট আমলোর (ম্যানুয়াল লোপেজ ওব্রাডর সংক্ষেপে আমলো বলা হয়)৷ বলা যেতে পারে যে, তিনি আমলোর হাতে গড়া নেত্রী এবং অবশ্যই যোগ্য নেত্রী৷ নির্বাচন যে ভুল ছিল না এটা ক্লডিয়া প্রমাণ করেছেন৷ মেক্সিকোর সংবিধান অনুসারে একই ব্যক্তি পরপর দুবার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না, তা না হলে আমলো ছিলেন দেশের মানুষের প্রথম পছন্দ৷

নির্বাচনে ক্লডিয়া ছিলেন বামপন্থী মোরেনা পার্টির প্রার্থী৷ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জোশীটাল গালভেচভ গালভেজ৷ ইনি ছিলেন প্যান পার্টির প্রার্থী৷ প্রধান দলের দুই মহিলাই এবারে নির্বাচনে মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন৷ উত্তর আমেরিকায় মেক্সিকো অবস্থিত হলেও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো এখানে দ্বি দলীয় ব্যবস্থা নেই৷ ভারতের মতো এখানে রয়েছে বহু দলীয় ব্যবস্থা৷ সেই বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব সহজেই নির্বাচিত হয়েছেন এই নেত্রী৷ এর প্রধান কারণ ছিল “ফোর্থ ট্রান্সফরমেশন”! স্বাভাবিকভাবেই ফোর্থ ট্রান্সফরমেশন কথাটা শুনলেই কৌতুহল বাডে়, আসলে প্রেসিডেন্ট থাকা কালে ক্লোডিয়ার গুরু আমলো গত ৬ বছরে মেক্সিকোয় অনেকগুলি পরিবর্তন সাধন করেছেন, তার মধ্যে তিনটি ছিল প্রধান মৌলিক পরিবর্তন৷ যার দ্বারা দেশের কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে৷ তারপর তিনি তৈরি করেন “ফোর্থ ট্রান্সফরমেশন” এটার কার্যকরী করার দায়িত্ব ক্লডিয়ার উপর৷ এটা আসলে একটা কর্মসূচি৷ এখানে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ যেমন, প্রথমত পেনশন চালু করা, যাতে অবসর জীবনে প্রবীণ নাগরিকরা একটু সুস্থভাবে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে৷

দ্বিতীয়ত দেশের সব পড়ুয়াকে নানা ধরনের সাহায্য করা৷ অবশ্যই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে দুস্থ এবং যাদের প্রয়োজন আছে কিন্ত্ত সামর্থ্য নেই সেই ধরনের পড়ুয়াকেই এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছে৷
তৃতীয়ত, প্রত্যেকটি দুস্থ কিংবা সামর্থ্যহীন পরিবারকে পৃথক পৃথকভাবে সাহায্য করা৷ দেখা গেছে এই প্রকল্পের দ্বারা দেশের ৫০ লক্ষ মানুষ উপকৃত হয়েছে৷ তাছাড়া বিনামূল্যে কিংবা খুব কম মূল্যে নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক পরিষেবা দেয়া যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়৷ ক্লডিয়া প্রত্যেকটা নির্বাচনীয় সভাতেই সারাদেশে এই প্রকল্পের প্রচার করেছেন এবং তিনি যেহেতু একজন ইঞ্জিনিয়ার তাই খুব সুন্দরভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট গুরু আমলো ফোর্থ ট্রান্সফরমেশন এর ভিত গডে় দিয়েছেন এবং একতলা বাডি় সম্পূর্ণ করেছেন৷ আমার দায়িত্ব এই বাডি়টিকে সুষ্ঠুভাবে দোতলা তৈরি করা৷

প্রকৃতপক্ষে এই প্রচার এবং পরিকল্পনায় বাজিমাত করে দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর নিজস্ব জনপ্রিয়তা, সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এই পরিকল্পনা, তাই তিনি সবমিলিয়ে আশার থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন এবং তিনি বারবার সব নির্বাচনী সভায়, যে কোন সাক্ষাৎকারে, লেখায়, গ্রন্থে সবসময় খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন, আমার প্রধান কাজ হবে সাধারণ মানুষ এবং গরিব মানুষের জন্য কাজ করা৷ তাছাড়া তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বসহকারে প্রচার করেছেন, তিনি বলেছেন আমি মনে করি অর্থনীতি এবং রাজনীতি পৃথক পৃথক বিষয়৷ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আর্থিকভাবে যা যা প্রয়োজনীয় তা করা হবে৷ কিন্ত্ত রাজনীতি কে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে না৷ রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতিকে কখনোই কাজে লাগানো হবে না, ফলে অর্থনীতি চলবে অর্থনৈতিক পথে, রাজনীতি চলবে রাজনৈতিক পথে৷

মেক্সিকো প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে গত ২০০ বছরে অনেকগুলি মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকল এই প্রথম মহিলা হিসেবে ক্লডিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন৷ এর আগে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি ছিল, ১৮১০ সালে মেক্সিকো স্বাধীনতা লাভ৷ কিন্ত্ত তখনো পর্যন্ত মধ্যযুগীয় প্রথা অনুসারে গির্জার শাসন সমাজের প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ প্রকৃতপক্ষে গির্জা এবং সরকার দুই প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে অধিকার এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন৷ এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১৮৫৮ সালে৷ তখনও এক মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়, গির্জার পরিবর্তে সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো৷ গির্জার হাতে নির্দিষ্ট কতকগুলি ধর্মীয় বিষয়ে ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা গির্জার হাত থেকে কেরে সরকারকে অর্পণ করা হলো৷ অর্থাৎ সরকারই হল রাষ্ট্রের প্রকৃত ভরকেন্দ্র এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু৷

চোরাচালান বিশেষ করে মাদকের উৎপাদন ও মাদক চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হচ্ছে মেক্সিকো৷ এ ব্যাপারে সারাবিশ্বে মেক্সিকোর খ্যাতি কিংবা দুর্নাম দুই আছে৷ তাই মেক্সিকোয় প্রায় সবসময় মার দাঙ্গা, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গুলির লড়াই, মৃতু্য অতি স্বাভাবিক৷ এখানে মাদক ব্যবসায়ীরা এত শক্তিশালী যে, একটা সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে চেষ্টা করে তারা৷ এর জন্য ঘুষ ও অন্যান্য উপহার দেয়া এমনকি হত্যা করতে বিন্দুমাত্র পিছু পা হয় না৷ এমন দেশে নির্বাচনের সময় যে রক্তের নদী বয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক৷ এমন রক্তাক্ত নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৪ এর নির্বাচন হচ্ছে মেক্সিকোর নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত নির্বাচন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকলো৷ নেতিবাচক দিক থেকে আরো এটাও একটা রেকর্ড বলা যেতে পারে, নির্বাচনে শুধু গন্ডগোল নয় নিজেদের প্রভাবকে স্থায়ী করার জন্য মাদকের চোরা চালানকারীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিল৷ বিভিন্ন ড্রাগ কারটেলগুলি তাদের প্রার্থীও দাঁড় করিয়েছিল৷ এদের মধ্যে প্রধান প্রার্থী ছিলেন জোরজে আলভারেহ মায়েনজা৷

সকলের জানা উত্তর আমেরিকার এই দেশটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ এখানে একসময় নারীকে পন্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো৷ বহু আন্দোলন এবং সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের সাহায্যে আজ থেকে ৭০ বছর আগে মেয়েদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়েছিল৷ তারপর ধীরে ধীরে তারা অর্থাৎ মহিলারা রাজনৈতিকভাবে অনেকগুলোই ধাপ পার হয়ে এসছে৷ যার অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল মেক্সিকো সিটির মেয়র নির্বাচন এবং সেখানেও ক্লডিয়া ছিলেন প্রথম মহিলা মেয়র৷ তাই পরিবার ও সমাজের মানসিকতার অবসান ঘটিয়ে একটা ইতিহাস তৈরি করলেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট৷ আশা করা যায় তাঁর আমলেই নারীর স্বাধীনতা, নারী অধিকার আরো উন্নত হবে আরো ব্যাপক আকার ধারণ করবে৷ তাই তাঁকে মেক্সিকো নারী স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তবে৷

নির্বাচন হয়ে গেলেও সংবিধান অনুসারে তাকে রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করার জন্য আরো প্রায় চার মাস অপেক্ষা করতে হবে৷ ২০২৪-এর ১ অক্টোবর ক্লডিয়া নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন৷ শুরু হবে মেক্সিকোর নতুন যুগ, রচিত হবে নতুন ইতিহাস৷