শোভনলাল চক্রবর্তী
উপলক্ষ পূরাণ কথিত কাহিনি অবলম্বনে একটি ঘটনা। যার ফলে দেশের জনসমষ্টির প্রায় এক তৃতীয়াংশ উপস্থিত একটি শহরে। সেই মিলনের সমাপ্তি ঘটবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। অমৃতকুম্ভ থেকে চার ফোঁটা অমৃত উছলে যে চার জায়গাতে পড়েছিল, সেগুলি হল— প্রয়াগরাজ (সাবেক ইলাহাবাদ), হরিদ্বার, নাশিক এবং উজ্জয়িনী। সেই কারণে বহু কাল ধরে প্রতি ৪ বছর অন্তর এই ৪টি জায়গাতে অনুষ্ঠিত হয় ভারত তথা বিশ্বের বৃহত্তম কুম্ভমেলা। শুধু তা-ই নয়, প্রতি ১২ বছর অন্তর আসে পূর্ণকুম্ভ। আর এই রকম ১১টি পূর্ণকুম্ভ পার হয়ে ১৪৪ বছর পর আসে মহাকুম্ভ (১২ নম্বর পূর্ণকুম্ভ) বা ত্রিবেণী যোগ। এই যোগে, বিশেষ করে মৌনী অমাবস্যায় গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান অগণিত মানুষের অন্যতম মনোবাসনা। সেই কারণে এই বছর প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত মহাকুম্ভ মেলার প্রচারবার্তা শুরু হয়েছিল অনেক দিন আগেই। অবশ্য এ বার ধর্মীয়, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক মেলবন্ধন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মহাকুম্ভের এই ত্রিবেণী সঙ্গমে, যেটা হিন্দুদের মহাসঙ্গমও বটে।
এই মেলাকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সমগ্র হিন্দুসমাজের নেতা বা মুখ হয়ে ওঠার সমস্ত উপকরণই মজুত ছিল এবং তিনি সেইমতো প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে মহাকুম্ভের পরিকাঠামোর জন্য প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং মেলার ৪৫ দিনে আনুমানিক ২ লক্ষ কোটি টাকার বাণিজ্যের আশা করা হয়েছে। কিন্তু এই বহুল প্রচারিত মহাকুম্ভ মেলা, উত্তরপ্রদেশ সরকার কর্তৃক যার ‘ডিজিটাল মেলা’ নামকরণ করা হয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে, সেখানে গত ২৯ জানুয়ারির মৌনী অমাবস্যাতে দ্বিতীয় শাহি স্নান উপলক্ষে জমায়েতে কয়েক কোটি মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে ব্যারিকেড ভেঙে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন কমপক্ষে ৩০ জন (সরকারি মতে) পুণ্যার্থী। যদিও উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের তরফে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির পরিবারকে এককালীন ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু দুর্ঘটনার পরেও উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফ থেকে দুর্ঘটনায় মৃত এবং আহতদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। উপরন্তু, বেসরকারিভাবে এই খবরও উঠে আসছে যে, ওই দুর্ঘটনাস্থল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে আরও দু’টি দুর্ঘটনার ফলে কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়। লক্ষণীয় যে, এই শেষোক্ত দুর্ঘটনাগুলি নিয়ে এই সরকারের পক্ষ থেকে একটি শব্দও এখনও পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। এর উপর আছে ময়নাতদন্ত এবং মৃত্যুর শংসাপত্র মৃতদেহগুলির পরিবারের হাতে তুলে না দেওয়ার মতো অদ্ভুত সব কাণ্ড।
গত ২৯ জানুয়ারির ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন যে মেলা সংক্রান্ত পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রয়াগরাজে কোনও গাড়ি না ঢোকার নির্দেশ। ফলত, শুধুমাত্র যে প্রয়াগরাজের স্থানীয় বাসিন্দারাই প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে দিন কাটিয়েছেন তা-ই নয়, নিকটবর্তী তীর্থক্ষেত্র বারাণসীতেও অত্যন্ত অব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেও হোটেলে কোনও ঘর ফাঁকা ছিল না, প্রচণ্ড যানজটের ফলে পথে বেরিয়ে প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে, জিনিসপত্র এবং গাড়িভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, স্টেশনে জনসমুদ্র, দিল্লি স্টেশনে মানুষ পদপিষ্ট হলেন, ট্রেনগুলিতেও পা রাখার জায়গা ছিল না। এসবের দায় বা দায়িত্ব কাদের ছিল সেই প্রশ্ন অবান্তর।
জাগতিক নিয়মমতো কুম্ভমেলা আবার আসবে, চলেও যাবে। আমরাও এই দুর্ঘটনার কথা ভুলে যাব। মৃত মানুষদের স্থান হবে ইতিহাসের পাতায়— সংখ্যায়! মহাকুম্ভ মেলার প্রশাসনিক অব্যবস্থাজনিত কারণে অসংখ্য মানুষের হয়রানি এবং অন্তত ৩০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। ধর্মীয় আবেগহেতু বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানের জমায়েত বন্ধ করা অসম্ভব। অথচ, বেশির ভাগ ধর্মস্থানের পথের দুর্গমতা হেতু যাত্রাপথ মসৃণ নয়। তার উপর বিশেষত হিন্দুবাদীদের স্বর্গ বা নরকবাসের তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনও পুণ্যস্থানে মন্দির দর্শন এবং গঙ্গায় (এখানে ত্রিবেণী সঙ্গমে) অবগাহন করা পুণ্যার্জনের লক্ষ্যে প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ছোটখাটো ধর্মীয় জমায়েতে ভারতের সর্বত্র এ ধরনের দুর্ঘটনার নজির বিরল নয়। তার প্রধান কারণ এমন বিপুল জনসমাগমকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পুণ্যার্জনের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি। অবশ্যই দক্ষিণ ভারতের কিছু মন্দিরে (উল্লেখ্য তিরুপতি) যেখানে স্থায়ী প্রশাসনিক পরিকাঠামো আছে, সেখানে ভিড় নিয়ন্ত্রণ সুচারুভাবে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আবার দুর্ঘটনাস্থলটি ছিল মহাকুম্ভ মেলা (১৪৪ বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়), যা ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি ও সম্মিলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের সংমিশ্রণ। এর গুরুত্ব হিন্দুদের কাছে অপরিসীম। তা সত্ত্বেও প্রয়াগরাজ ফেরত তীর্থযাত্রীদের একটাই বক্তব্য যে, জনসমাগমের হিসাব অনুযায়ী পরিবহণ ব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের থাকার ব্যবস্থা এবং আনুষঙ্গিক দিন গুজরানের সাময়িক ব্যবস্থাপনা করতে অগ্রিম চিন্তাভাবনায় যথেষ্ট গলদ ছিল। ত্রিবেণী এবং সংলগ্ন এলাকার পূতিগন্ধময় পরিবেশ জনস্বাস্থ্যর পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল। পরিবেশবান্ধব শৌচাগার তৈরির প্রচেষ্টা করা হয়েছিল কি না, তাও অজানা। যেখানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন আসছেন, সেখানে অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব ছিল। যে মেলাতে কোটি কোটি মানুষের সমাবেশ, এবং পুণ্যার্জনই অভীষ্ট, সেখানে তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল্য দিতে হবে এক বিষাদময় পরিস্থিতিতে, তা বোধ করি কাম্য ছিল না। আশা করা যায় মেলার সংশ্লিষ্ট আয়োজক রাজ্য এ বিষয়ে আগামী দিনে অগ্রিম চিন্তাভাবনা করবে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গাসাগর মেলা প্রতি বছর হয়, সুষ্ঠু ভাবেই।
তেমন বড়সড় দুর্ঘটনা এখনও ঘটেনি। সেখানেও কিন্তু জনসমাগম নেহাত কম হয় না। অতীতকাল থেকে চলে আসা কুম্ভমেলায় মৃত্যুমিছিল যেন কিছুতেই থামছে না। ১৮২০ সালে হরিদ্বার কুম্ভমেলায় ৪৩০ জনের মৃত্যু দিয়ে যে মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছিল, ২০২৫ সালে এসেও তা অব্যাহত। কুম্ভমেলায় পূর্বের একাধিক বার মৃত্যুমিছিল দেখেও কি বর্তমান উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের ঘুম ভাঙেনি বা কিছুই শিক্ষা হয়নি? এ বার প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, গ্রহনক্ষত্রের বিচারে এমন পুণ্যলগ্ন ১৪৪ বছর অন্তর আসে। স্বাভাবিক ভাবেই পুণ্যার্থীদের ভিড় যে উপচে পড়বে— তা তো জানাই ছিল। সেই মোতাবেক প্রশাসন ব্যবস্থা করলে এত মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হত না। ঘটনার দিন ছিল মৌনী অমাবস্যা। কুম্ভমেলায় স্বাভাবিক দিনের চেয়ে এ দিন ভিড় বেশি হওয়ার আশঙ্কা ছিলই, তা সত্ত্বেও কেন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন? এই মৃত্যুমিছিল যে উত্তরপ্রদেশ সরকারের চরম গাফিলতির পরিণতি— তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখা দরকার শুধু লম্বাচওড়া ভাষণে কাজের কাজ হয় না। বিগত এক বছর ধরে উত্তরপ্রদেশ সরকার কুম্ভমেলা নিয়ে সরকারি স্তরে এত ঢক্কানিনাদ করার পর তার অসারতা বোঝা গেল ৩০ জন পুণ্যার্থীর প্রাণ বিসর্জন ও শতাধিক পুণ্যার্থীর আহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। যাঁদের মধ্যে অনেকের অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক। পুণ্য অর্জনের খোঁজে এসে এভাবে যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে, স্বজনহারা হয়ে ঘরে ফিরতে হবে— তা কি পুণ্যার্থীরা ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন?
এ বার কুম্ভমেলার গোড়ার দিকেই আগুন লেগে বেশ কিছু তাঁবু পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। তারপর পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু, অনেকে আহত হওয়ার পরেও কি যোগী প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ব্যর্থতার নৈতিক দায় স্বীকার করার কথা ভাববেন না?
প্রয়াগ সংলগ্ন ঝুসি, নৈনি, আড়াইল ঘাটের দিকে তাকিয়ে, বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের পশ্চিমে ঢলে পড়া আর তাতে সিলুয়েট হয়ে আসা মাথায় বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে নিরন্তর অব্যক্ত দৃষ্টিতে এগিয়ে চলা ভারতবর্ষের ছবি আমরা অনেক দেখেছি। পরিতাপের বিষয়, এর মধ্যেও রাজনৈতিক পাথেয় খুঁটে খাওয়ার মতো করে খুঁজে চলেছে নানা শক্তি। তাদের এই অভিপ্রায়ের লয় হোক, এ আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা। তবেই নতুন ভারতবর্ষের অভ্যুদয় সম্ভব। বারো বছর পরে পরবর্তী কুম্ভ ভিলেজে নিয়ন গ্যাস বাতি এবং বিশালাকৃতি বৈদ্যুতিক স্তম্ভের আলো, সেই সঙ্গে আখড়ায় জ্বলতে থাকা ধুনির ধোঁয়া, মাঠের ধূলিকণা, সব মিলিয়ে হয়ত এক মায়ানগরীর রূপ নেবে এই মানবসাগর। একটি দেশের জনসমষ্টির এক তৃতীয়াংশের উপস্থিতি একটি নগরে, কিসের আকর্ষণে, কী মোক্ষলাভের আশায়, সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে হতদরিদ্র ও দেশের তাবড় ভিআইপি তথা রাজনৈতিক নেতা নেত্রী, শিল্পে, শিক্ষায়, ব্যবসায় যাঁরা অগ্রণী তাঁরা সকলে ছুটে এলেন – অমরত্ব যে মিলবে না সেটা জেনেও? অমরত্বের আশা ত্যাগের পরপরে থাকছে পাপস্খলনের আশা। সত্যিই কি এই সময়পর্বে বা দিন বিশেষে হাড় হিম করা ঠান্ডায়, কোনও বিশেষ মুহূর্তে একটি ডুব দিলেই যাবতীয় পাপ ধুয়ে যাবে? সেই ডুব দেওয়ার সময় তাঁরা কি এ শপথ নেন যে কারুর ক্ষতিসাধন তো দূরের কথা, কোনও কুচিন্তা যেন তাঁদের স্পর্শ না করে! যদি একটি ডুব দিলে মানুষের চৈতন্য উদয় হয়, তবে এমন অবগাহন তাঁরা নিয়ত করে যান। তখন তাঁদের কাছে দেশের প্রতিটি জলাশয়ের প্রতিটি জলকণাই অমৃতসম হয়ে উঠবে। আগামীতে এমন কুম্ভই হোক আমাদের ইপ্সিত, অভিপ্রেত। আসুন, তার আগে আমরা আমাদের চারপাশের মৃতপ্রায় জলাশয়গুলিতে প্রাণ সঞ্চারে নিজেদের নিয়োজিত করি।