• facebook
  • twitter
Thursday, 15 May, 2025

অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি

বিভেদের কাজ সমাধা করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি আর আমাদের বিভেদের রাজনীতি

প্রতীকী চিত্র

মহম্মদ শাহাবুদ্দিন

উত্তর না জানা অনেক প্রশ্ন আমরা রেখে এসেছি ফেলে আসা সময়ের কাছে। এখন আর কেউ স্মৃতি ধরে রাখতে ডায়েরি লেখে না। অনেক ঘটনা হৃদয়েই জুড়ে থাকে। শীত আর কুয়াশায় মুখ ঢেকে বছর সরে যায়, সময়ের ক্যালেন্ডারে নতুন সাল আসে। স্মৃতির কপাট খুলে বার বার তা বন্ধ করি। প্রশ্ন যা মেরে মেরে আবার তাকে খুলে দেয়। সময়ের অতিক্রমণে পথ কিন্তু মসৃণ ছিল না। সেখানে রাজনীতি সমাজকে জড়িয়ে থেকে গেছে অনেক জিজ্ঞাসা। আমরা প্রশ্ন নিশ্চয়ই খুঁজব ৭৭ বছরের স্বাধীনতায়, আমরা আজও কেন এতো বিভাজন নিয়ে আছি। স্বাধীনতার পর দেশ ও সমাজের লক্ষ্যপূরণে আমরা পৌঁছতে পারিনি। অপূরিত রয়ে গেছে মানুষের চাহিদা, স্বপ্ন। জাতি ধর্মের রেখাটেনে এতকালের ভারতবর্ষকে আমরা টুকরো করেছি। স্বাধীনতার মধ্যরাতেই আমাদের স্বপ্ন ভেঙেছিল।

বিভাজন বিদ্বেষ তো আকাশ থেকে পড়েনি। বিভেদের কাজ সমাধা করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি আর আমাদের বিভেদের রাজনীতি। আমরা নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলবো, কেন আমরা আজও বিভাজনে আছি। রয়ে গেছে অনেক প্রশ্ন। দেশভাগের কাঁটা তারে স্বপ্ন বাঁধা পড়লেও আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। যা ছিল আমাদের অধিকারের রক্ষাকবচ, আমাদের কর্তব্যের পথ নির্দেশ। তবুও সংবিধানকে বাঁচাতে মানুষকে পথে নামতে হচ্ছে। কখনও নাগরিকত্ব আইনের প্রশ্নে, কখনও ভোটাধিকারের প্রশ্নে। বিপুল সরকারি সম্পত্তি, ঐতিহ্যময় সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসকারি মালিকানায়। সংবিধান নির্দেশিত জনগণনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আজও রহস্যের ঘোরাটোপে।

মণিপুরের জাতিদাঙ্গার দাবানল এখনও নেভেনি। সীমান্তের এই পাহাড় ঘেরা প্রদেশে উপজাতি মানুষের বাস। দাঙ্গা থামাতে রাজ্যে বহুবার গুলি চালানোর নির্দেশ জারি হয়েছে। মণিপুরে হিংসার শুরু ২০২৩ এর মে মাসে। বহু মৃত্যুর পর আজও থামেনি সে আগুন। ইম্ফল উপত্যকায় মৈতেই জনজাতির তরফে দাবি তোলা হয়েছে, তাদের তফশিলি উপজাতি হিসেবে মেনে নিতে হবে। এই দাবি মানতে পারছে না কুকি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। এই বিরোধের সূচনা থেকেই হিংসার আগুন জ্বলছে। মণিপুরে এথনিক গোষ্ঠী মৈতেই আর কুকিরা অন্যতম বৃহত্তম জনজাতি। কোথাও মৈতেইরা সংখ্যা গরিষ্ঠ কোথাও নাগা ও কুকিরা। শুধু ঝুম চাষ নির্ভরশীল কুকিদের না আছে জীবনের স্থায়িত্ব, না আছে শিক্ষার সুযোগ। মণিপুরে ১৬ জেলার মধ্যে ৩৫টি উপজাতির বাস। রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে চলেছে। গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের হিংসাত্মক পরিস্থিতির সংকট আজও মেটেনি। এই ভয়াবহ অবস্থা নিয়েই মণিপুরের মানুষ পা রেখেছে নতুন বছরে। এখনও রাষ্ট্র রয়েছে উদাসীন। আইনের চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। কবে থামবে এই জাতি দাঙ্গা। কবে আসল সত্য জানবে মানুষ?

গত বছর আগস্ট থেকে শুরু হয়েছিল ঝড়ের দিন। এনেছিল এক দ্রোহকাল। সেই দ্রোহের উত্তাপে রাত দখলে পথে নেমেছিল লাখো মানুষ।

হাসপাতালের নিরাপদ ঘেরাটোপে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছিল। আরজি করের এই ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এই খুন ও ধর্ষণ একটা ব্যবস্থার নগ্ন চেহারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সরকারি হাসপাতালের নিরাপদ চৌহদ্দীতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা একটা সংগঠিত ভয়ঙ্কর ক্রাইম। প্রতিবাদে মেয়েরাই রাত দখল করে বাঁধভাঙ্গা মিছিলে আওয়াজ তুলেছিল। নারী গর্জনের এ এক নতুন ইতিহাস। এই ঘটনাকে নিয়ে দীর্ঘায়িত বিচার পদ্ধতি বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিচারের বাণী আজও কি পৌঁছবে না মানুষের কানে। নৃশংস খুনের প্রতিবাদে মানুষ কি আবার পথ হাঁটবে। কার ভুলে স্যালাইন কাণ্ডে আজ মাতৃগর্ভ থেকে নবজাতক সূর্যের আলো দেখতে পেল না। নিথর প্রসূতির পাশ থেকে অসহায় সদ্যজাতকে তুলে নিতে হল পরিবারের অন্য মানুষদের। কি তাদের অপরাধ। যে স্যালাইন নিয়ে এতো কথা চলছে, কেউ কি একবারও ওই মাতৃহারা সদ্যজাতের ভবিষ্যতের কথা বলছিল। কে দোষী? কে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে। এই নিয়ে চাপান উতোর। স্যালাইনের নির্মাতা, পরিবেশক, হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক, —সবার মধ্যে দোষ চাপাতে চাপাতে শেষে সাসপেন্ড করা হল ১২ জন চিকিৎসককে। এই বিষ স্যালাইন আর কোথায় ছড়িয়ে আছে এবং এই অপরাধের মূল দোষীকে, সে সম্পর্কে আরও গভীর অনুসন্ধানের কি হল?

অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রেখে আমরা পথ চলছি। সত্যকে লুকিয়ে রাখা, হাজারো জিজ্ঞাসার সমাধান না হওয়া আমাদের হতবাক করছে। সব তথ্য, সব সত্য কি মিডিয়াতে সংবাদের পাতায় আমরা খুঁজে পাচ্ছি? রাজনৈতিক স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে অনেকে সত্যকে আড়াল করে চলে। এখন সীমাহীন ক্ষমতা যে দূর্নীতি তৈরি করে চলেছে তারা অনেক শক্তিশালী। তাদের মুখোস না সরে গেলে আমরা সত্যের কিনারা পাব না। ১৪ আগস্টের ন্যায় বিচারের আওয়াজে আমরা সাহস পেয়েছি। সাহস হরিয়ে গেলে আমরা থেমে যাব। মনে রাখতে হবে একটা গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সচেতনতা না থাকলে তার কণ্ঠ হারিয়ে যায়।

যেন একটা ব্যর্থ সমাজের নাগরিক হয়ে পড়ে। তখন একটা রুচিবোধ সচেতনতার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীনদের সস্তা কৌলুসে হাততালি দিই। তাদের দান অনুদানে নেচে উঠি। তাদের অপরাধেও উদাসীন থাকি। তবে মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, তার প্রতিবাদী মন আজও ফুরিয়ে যায়নি। সমাজে অন্যায় অপরাধ দেখেই আমরা হৃদয়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বালি। পাথরে পাথর ঘষে যদি আগুন না জ্বলে, তাহলে আঁধারে আঁধার ঘষে আগুন জ্বলতে হয়। আঁধারের যন্ত্রণাই এই কাজটি করে দেয়। এই আলোয় হয়তো আবার মানুষ পথে নামবে। কারণ সত্যকে জানতে হাতে হাত রেখে হৃদয়ে হৃদয় জুড়ে মানুষ পৌঁছতে চায় সত্যের কাছাকাছি। সেই আগুনের মশাল এই প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাক পরের প্রজন্মের কাছে।