• facebook
  • twitter
Friday, 21 March, 2025

জনমানসে বিস্মৃতপ্রায় মানভূমের ভাষা আন্দোলন

আজ যখন এক ভিন্ন বাস্তবতায় নিজের ঘরেও কোণঠাসা হচ্ছে বাংলা ভাষা, তখন এই আন্দোলনের শিক্ষা যেন ডাক পাঠাচ্ছে নতুন করে। নিজের মাতৃভাষাকে ঘিরে নতুনভাবে বাঁচার ডাক। নিজের পরিচিতিসত্তাকে খুঁজে নেওয়ার ডাক। সেই ডাক আমরা শুনতে পাচ্ছি তো?

ফাইল চিত্র

দীপক সাহা

বাংলা ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা ১৯৫২-র ২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের (বাংলা ভাষা শহিদ আন্দোলন) কথা গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করি। মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণদান করেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার আরও কত নাম না-জানা সেসব শহীদের আত্মত্যাগে পূর্ববঙ্গ ফিরে পায় প্রাণের ভাষা বাংলা। ভাষা আন্দোলনের সরণি বেয়ে পরবর্তীতে জন্ম হয় বাংলাদেশের। এর সঙ্গে ১৯৬১ সালের ১৯ মে কাছাড় (বরাক উপত্যকা) বাংলাভাষা আন্দোলনের কথাও উল্লেখ করি। বরাক উপত্যকায় প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন। এসবই মাতৃভাষার অধিকারের জন্য। কিন্ত আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া আরও একটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি গৌরবময় অধ্যায় আছে, যা ঐতিহাসিক কালানুক্রমে সবচেয়ে পুরনো বাংলা ভাষাভিত্তিক আন্দোলন। সেটি হল মানভূম ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষার সন্তাপ-সঞ্জাত প্রথম গণ আন্দোলন নিঃসন্দেহে মানভূম ভাষা আন্দোলন।

ঐতিহাসিক মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯১২ সালে শুরু হয়। লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলেন। পূর্ববঙ্গ-উত্তরবঙ্গ-অসাম-ত্রিপুরা নিয়ে একটি ভাগ,অন্যভাগে বাংলার বাকি অংশের সঙ্গে জুড়ে গেল বিহার ও ওড়িশাও। এই দ্বিতীয়ভাগেই ছিল মানভূম। সেখানে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আগে থেকেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর তা চরম আকার নিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের নীতির বাস্তব রূপায়নের দাবিতে দেশের আঞ্চলিকতা বেড়ে উঠতে শুরু করে। সেই পরিস্থিতিতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশের ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিশন মত দেয় যে, শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন না করে ভারতের ঐক্যবদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এদিকে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের কবলে বাংলাভাষী-অধ্যুষিত মানভূমে বাংলা স্কুলগুলো বদলে যেতে লাগল হিন্দি স্কুলে। মানভূমে সমস্ত আইনি ও প্রশাসনিক কাজে চেপে বসল হিন্দি। ঠিক যে-কায়দায় ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ বাংলার ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, প্রায় একইভাবে মানভূমে বাংলার ওপরে হিন্দির আগ্রাসন বাড়তে শুরু করল। এবং এর বিরুদ্ধেই শুরু হল আন্দোলন।

১৯৪৮ সালের ৩০ এপ্রিল, মানভূম জেলা কংগ্রসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের দাবি ছিল, ‘মানভূম বাংলা ভাষাভাষী’। কিন্তু সেই দাবি মান্যতা পায়নি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে। প্রতিবাদে ১৪ জুন, পাকবিড়রায় কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন অসংখ্য কংগ্রেস-কর্মী। সেই দলে ছিলেন ভজহরি মাহাতো, অতুলচন্দ্র ঘোষ, অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সহ ৩৭ জন নেতা। গঠিত হল ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’। তাঁরা বাংলাভাষার দাবিতে সত্যাগ্রহ শুরু করলেন। কিন্তু, সেই সত্যাগ্রহের ওপরেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এল। ঝালদা, পুরুলিয়া ও সাঁতুরির জনসভায় লাঠিচার্জ করে পুলিশ। অনেকে আহত হন। নির্মম অত্যাচার শুরু হয় মহিলা নেত্রীদের ওপরেও। মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অপ্রতিরোধ্য। জননেত্রী লাবণ্যপ্রভা দেবীকে পুলিশ ও রাজনৈতিক গুন্ডারা চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে, সঙ্গে চলে অকথ্য নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানি। শবরনেত্রী রেবতী ভট্টাচার্যকে পিটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় বিহারি পুলিশ। জননেত্রী ভাবিনী মাহাতোর ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। চিত্তভূষণ দাসগুপ্তের মাথা ফাটে। এই সময় বিহারের জননিরাপত্তা আইনের ধারায় লোকসেবক সংঘের কর্ণধার অতুলচন্দ্র ঘোষ, লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, অশোক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। এত দমন-পীড়নেও অবশ্য আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। উল্টে মানভূমের শিকড়ের গান টুসুকে আঁকড়ে শুরু হয় ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। ‘টুসু গানে মানভূম’ নামে একটি ছোট্ট পুস্তিকা আগুন জ্বালিয়ে দিল গোটা মানভূমে। টুসুকে ঘিরেই যেন নতুন জীবন পেল এই আন্দোলন। বেগতিক দেখে বিহার সরকার টুসু গান নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। কিন্তু তাতেও ঠেকানো গেল না টুসু গানের ভিতর দিয়ে বাংলাভাষার প্রতি আবেগের স্ফূরণ অসংখ্য মানুষ টুসু গাওয়ার জন্য গ্রেপ্তার হলেন।

ইতিমধ্যে, ১৯৫২ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে হইচই ফেলে দিয়েছেন ‘লোকসেবক সঙ্ঘে’র দুই প্রার্থী ভজহরি মাহাতো ও চৈতন মাঝি। বিধানসভাতেও জিতেছেন ভাষা আন্দোলনের সাত জন প্রার্থী। আন্দোলনের ঢেউ যখন আরও বাড়ছে, এমন সময়ে সীমা কমিশনের কাজ শুরু হল। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং শ্রীকৃষ্ণ সিংহ প্রস্তাব দিলেন বাংলা-বিহার জুড়ে গিয়ে নতুন রাজ্য হোক। আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল। কলকাতাবাসীদের পক্ষ থেকে হেমন্তকুমার, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট নাগরিকগণ সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।

মানভূমের ভাগ্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায়, ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে লোকসেবক সঙ্ঘের আন্দোলনকারীরা কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সাড়ে তিনশ’ নারীসহ হাজার দেড়েক আন্দোলনকারী দশটি বাহিনীতে ভাগ হয়ে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। ষোলো দিন পর, ৬ই মে কলকাতায় উপস্থিত হয় সেই পদযাত্রা। ২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে টানা দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। কণ্ঠে ছিল ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ গান।

“শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্ দেখাই / তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই / ভাইকে ভুলে করলি বড় বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই / বাঙালী-বিহারী সবই এক ভারতের আপন ভাই / বাঙালীকে মারলি তবু বিষ ছড়ালি — হিন্দি চাই / বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই কোন ভেদের কথা নাই / এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষার রাজ্য চাই।”

ভজহরি মাহাতোর লেখা জনপ্রিয় এই টুসু গান গাইতে গাইতে হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে জনপ্লাবন। বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রতিবাদ করে, জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে, মাতৃভাষা বাংলার দাবি নিয়ে মানভূমবাসীরা মিছিল করে এগিয়ে আসছেন কলকাতার দিকে। ডালহৌসি স্কোয়ারে পা রাখতেই গ্রেপ্তার হলেন তাঁরা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পরিশ্রমে অসুস্থও হয়ে পড়লেন অনেকে। ১২ দিন পরে মুক্তি। এই সময়ে, কলকাতাতেও মানভূমের সংহতিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রেফতার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।

আন্দোলন তীব্রতর হয়। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রদ করা হল বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব। দ্রুত পাশ হল বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন। তারপর, সীমা কমিশনের রিপোর্ট লোকসভা হয়ে ‘সিলেক্ট কমিটি’ ও আরও নানা স্তর পেরিয়ে ১ নভেম্বর, ১৯৫৬ সালে বাংলা অধ্যুষিত ১৬টি থানা অঞ্চল জুড়ে ২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া। মানভূমবাসীরা এতদিন পরে অন্তর্ভুক্ত হলেন পশ্চিমবঙ্গে। এখানে কেউ আর বাংলাভাষায় পড়তে-লিখতে বাধা দেয় না। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন কোনও স্বাধীন দেশ গড়ার আন্দোলন ছিল না। ছিল কেবল বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার লড়াই। টুসুপ্রেমীরা সেই ভাষা আন্দোলন আজ জনমানসে বিস্মৃতপ্রায় হলেও ইতিহাসের দলিলে তা উজ্জ্বল।

আজ যখন এক ভিন্ন বাস্তবতায় নিজের ঘরেও কোণঠাসা হচ্ছে বাংলা ভাষা, তখন এই আন্দোলনের শিক্ষা যেন ডাক পাঠাচ্ছে নতুন করে। নিজের মাতৃভাষাকে ঘিরে নতুনভাবে বাঁচার ডাক। নিজের পরিচিতিসত্তাকে খুঁজে নেওয়ার ডাক। সেই ডাক আমরা শুনতে পাচ্ছি তো?