বিশ্বজিৎ সরকার
পহেলগাঁও ঘটনার দু’মাস আগের প্রেক্ষাপট। সকালের প্রথম প্রহরের খণ্ডখণ্ড ভাসমান মেঘগুলি হঠাৎই জমাট বেঁধে গেল। আর বেলা বাড়তেই সেই আধাঁর করা মেঘ ভেঙে পড়ল অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারাপাতে। গোটা ডাল লেক ঢাকা পড়ল বৃষ্টি ধোয়া বর্ষণের সাদা চাদরে। সন্তরণরত শিকারারা নোঙর তুলেছে আপন আপন ডেরায়। হজরতবাল মসজিদ লাগোয়া শান বাঁধানো পাড়ে দাঁড়িয়ে যারা দৃশ্যমান ডাল লেকের অপার সৌন্দর্যে মজে ছিলেন তাঁরাও সরে গিয়ে মাথা গুঁজলেন নিরাপদ ছাদের তলায়। তবে প্রতীয়মান বৃষ্টি উপেক্ষা করেও মসজিদে ধীর লয়ে ঢুকে পড়া অজস্র ধর্মপ্রাণ মানুষের সারি। জুম্মাবারে আল্লার প্রতি ইবাদত। আস্তে আস্তে শেষ হয় মসজিদে আগমনের সময়সীমা। আগন্তুক ভাবলেন, তার গেলেই বা ক্ষতি কি! যদি সুর মেলাই ওই ঐকান্তিক প্রার্থনার সমবেত গানে! কিন্তু ঢুকতে গিয়েই বাধা হয়ে দাঁড়াল দ্বারে থাকা মৌলবি সাহেব— ‘আপকা জানা আভি মানা হ্যায়’। নম্রতার সুললিত কণ্ঠে বিনীত প্রশ্ন— কিঁউ চাচাজী। চাচাজী এক কথায় উত্তর সারেন— ‘আভি নামাজ হো রাহা হে।’ আগন্তুক একটুও রাগলেন না, আরো বিনীত কিন্তু প্রত্যয় মিশ্রিত সুরে ভাঙা হিন্দিতে বললেন— ‘নামাজ মতলব প্রার্থনা, দোয়া। আল্লাতালা কা পাস, ভগবান কা পাস, গড কা পাস হোতা হ্যায়, সব একই হ্যায়, ম্যায় ভি নামাজ পড়ুঙ্গা।’ নারাজ মৌলবি সাহেব। মনে মনে ভেবে চলছেন— ব্যাটার অন্য কিছু মতলব নেই তো! মৌলবিজীর নীরবতা দেখে আবার মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় আগন্তুক— ‘সবকো হাত চিরকে দেখিয়ে, সবকা খুন কা রং একই হায়, কোই ফরক পঢ়তা নেহি।’ কি করবেন বুঝতে পারলেন না মৌলবি সাহেব। এদিকে হলের মধ্যে সারিবদ্ধ ধর্মপ্রাণ মানুষের সারি। কথা কাটাকাটির সময় নেই এখন। আগন্তুকের মায়াবী আন্তরিক কথাও বোধহয় ছুঁয়ে গেল হৃদয়। অগত্যা ছেড়ে দিলেন।
Advertisement
আগন্তুক ছুটে গিয়ে এক কোণে নিজের ব্যাগটিকে রেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন লাইনে। নামাজ শুরু হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ। পিছন থেকে একজন বলে উঠলো, আপ হট যাইয়ে। ভাবলেন দেবে হয়ত তাল কেটে। আগন্তুক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হঠাৎ একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা বছর ৩০ এর এক যুবক বলে উঠলেন— রহনে দো রহনে দো— থাকতে দাও। নামাজ শুরু হল। পাশের যুবক নামাজের ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করলেন তাঁদের সঙ্গে আগন্তুকের তাল মেলানোর ঢং। তারা তো জানতো না একেবারে কৈশোরে রাবারের বল নিয়ে যখন মকসুদ, ইদ্রিস, জিয়ার সঙ্গে তারা খেলতো, তখন পাশে থাকা একটা মাটির ঘর থেকে হঠাৎ আওয়াজ আসতো ‘আল্লা-হু আকবর’। আর তখন সবাই খেলার অঙ্গ হিসেবে ছুটে যেত সেই সমবেত প্রার্থণায়। সেখান থেকে শিখেছে প্রার্থণার এই কসরত। ইবাদত শেষে ইদ্রিস কিম্বা শফিকের বাবা-কাকারা যখন পাঠালি দিত তখন কার পাটালি বড়, আর কার ছোট সেই খুনসুটির আনন্দে কেটে যেত প্রতিটি বিকেল। কৈশোরের শেখা জিনিস অনেকদিন বেঁচে থাকে! তাই নামাজের এই আনন্দপাঠে ভুল হয়নি আগন্তুকের। নামাজ শেষ হতেই, তার নিবিড় ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে পিছনের সেই নামাজী বুকে জড়িয়ে নিলেন তাঁকে। আর যুবকের সঙ্গে গ্রন্থিত হল বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন। কিন্তু এই বন্ধন কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? বোধহয় না। পহেলগাঁমের ঘটনায় প্রাণ দিয়েছেন সহিস আদিল হুসেন। রুখে দাঁড়িয়ে উগ্রপন্থীদের হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে শহীদের মৃত্যবরণ করেছেন তিনি।
Advertisement
কাশ্মিরী যুবক নজাকত পেটের দায়ে শাল বিক্রি করেন ছত্তিশগড়ের গ্রামে। বড়মুখ করে সেখানের ১১ হিন্দুকে নিজের মুলুকে ঘোরাতে নিয়ে এসে পড়ে বৈসরনের বধ্যভূমিতে। সন্ত্রাসবাদীরা যখন একে একে গুলি করে খতম করছে পর্যটকদের তখন নজাকত ভেবেছিল এদের যদি বাঁচাতে না পারি তাহলে আমারই দায়, আমারই ব্যর্থতা, ফেল আমার আতিথেয়তা। বুদ্ধিমান নজাকত অসম সাহসে উল্টো দিকের বেড়া দিয়ে পার করলেন সেই ১১ হিন্দু যাত্রীদের, এরই মাঝে চটজলদি খুঁজে নিলেন দলছুট কয়েকজনকে। নজাকতের মত অনেকেরই আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন আটকে পড়া বাকি পর্যটকরা। তবু ভারতমাতার অনেক কুশীলব, রাজনীতির কারবারীরা ধবনি তুলেছিল— খবরদার যাবেন না ওখানে। ওই উপত্যকাতে গেলে আপনার মৃত্যু। আবার কেউ প্রেক্ষিত ভুলে মেরে দিয়ে যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত পঙ্ক্তি— ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।’ না, এই মৃত্যু উপত্যকা আমারই দেশ। এখানে আমার, আমাদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ।
যাঁরা সম্প্রতি গিয়েছেন খেয়াল করে দেখবেন গোটা শহর সিআরপিএফে মুড়ে দিলেও এই সব দুর্গম এলাকায় ছিল না কোনও নিরাপত্তা। আজো কাশ্মীরের নিভৃত কোণায় যেখানে ছড়ানো নিসর্গের অপার সৌন্দর্য, যা খুঁজে খুঁজে চলে যান অগণন টুরিস্ট, সেখানে নেই কোনও নিরাপত্তা। পহেলগামের ঘটনা মাথায় রেখেই বলছি সাধারণ টুরিস্টদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না কোনওদিন। প্রাণ যায়নি কারো। পহেলগামের ঘটনা বিরল। বরং যাঁরা এই ভূখণ্ডকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করার আওয়াজ তুলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে বলুন— আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব/ বুকের মধ্যে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান/ সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকী না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম/ অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী/ প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছামতো। ডেকে নেবো টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মতো দীঘি ভালোবাসা (এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না— নবারুণ ভট্টাচার্য)।
Advertisement



