• facebook
  • twitter
Tuesday, 19 August, 2025

ইজরায়েল-ইরান সংঘর্ষ বিশ্বের অর্থ-ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে দেবে

যুদ্ধের আবহে অশোধিত তেলের দাম ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে। আর সপ্তাহ দুয়েক লড়াই চললে, ব্যারেল পিছু তেলের দাম পৌঁছে যেতে পারে ১০০ ডলারে।

ইরানের রাজধানী তেহরানে জ্বলছে আগুন।

পুলক মিত্র

ইজরায়েল-ইরান সংঘর্ষ ঘিরে গোটা বিশ্বে সঙ্কটের কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এই সংঘর্ষ কবে থামবে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। তবে খুব তাড়াতাড়ি যে এই সংঘাত মিটবে, সেরকম কোনও ইঙ্গিত নেই। অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। আর তাতে বিশ্ব অর্থনীতি একেবারে টালমাটাল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরমাণু কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারের পর ইরানের তেল শোধনাগারগুলি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। তেহরান সহ একাধিক জায়গার তেল শোধনাগারগুলি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। জ্বলছে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস ফিল্ড সাউথ পার্স-ও।
এখনও পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির যে হিসেব মিলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৩০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ কোটি লিটার তেল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ তেল নষ্ট হওয়ায়, ইরান থেকে ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেল সরবরাহ ব্যাহত হবে, তা বলাই বাহুল্য। ইজরায়েলের হামলার পর সাউথ পার্স গ্যাস ফিল্ডে গ্যাস উৎপাদন আংশিক বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে ইরান। এর ফলে দৈনিক ১২ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস উৎপাদনে ঘাটতি দেখা যাবে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস উৎপাদক দেশ হল ইরান। বিশ্বের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৬.৫ শতাংশই পূরণ করে থাকে ইরান।

ইরানের পাল্টা হামলায় ইজরায়েলেরও তেলভাণ্ডারের ক্ষতি হয়েছে। সেখানেও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ লিটার তেল নষ্ট হয়েছে। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য বিশ্বের একটা বড় অংশই মধ্য প্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে অন্যতম হল ভারত। ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইজরায়েল সহ একাধিক দেশ থেকে তেল আমদানি করে থাকে ভারত। দেশের চাহিদার ৯০ শতাংশই তেলই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রেও ৭০ শতাংশই আসে বিদেশ থেকে।

যুদ্ধের আবহে অশোধিত তেলের দাম ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে। আর সপ্তাহ দুয়েক লড়াই চললে, ব্যারেল পিছু তেলের দাম পৌঁছে যেতে পারে ১০০ ডলারে। সেক্ষেত্রে ভারত সহ একাধিক দেশেই তেল এবং পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সংঘর্ষ দীর্ঘস্থায়ী হলে, ভারতে পেট্রোল-ডিজেলের দাম লিটার পিছু ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য আকাশছোঁয়া হতে পারে।

শুক্রবার (১৩ জুন) ভোরে ইজরায়েলের হামলার পরপরই তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অপরিশোধিত তেলের দাম একলাফে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। আর বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলে নিয়ে নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম, যেমন সরকারি বন্ড ও সোনার দিকে ঝুঁকে পড়েন।

ইজরায়েল ও ইরান নিজেদের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। ইরাক এবং জর্ডানও একই পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিমান পরিচালন সংস্থা ওই অঞ্চলে উড়ান বাতিল করেছে। কারণ, বিমান ভূপাতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০০১ সালের পর থেকে এপর্যন্ত বিশ্বে ভুলবশত ৬টি বাণিজ্যিক বিমানকে গুলি করে নামানো হয়েছে। বিমানের পথ পরিবর্তন করলে, শুধুমাত্র যাত্রার সময় বাড়ে না, প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত জ্বালানিরও। ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হলে, মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি বাজার ও বাণিজ্য বিপর্যস্ত হতে পারে, যার অভিঘাত গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি উৎপাদনকারী অঞ্চল। সেখানেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে। সৌদি আরব ও ইরাকের পর এই অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ হল ইরান। এই পরিস্থিতিতে এখন সবার নজর রয়েছে হরমুজ প্রণালির দিকে। বিশ্বে বাণিজ্যিক তেল পরিবহনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রণালি হল, ইরান, সংযুক্ত আরব আমির শাহি এবং ওমানের মাঝখানে অবস্থিত এই সংকীর্ণ জলপথ। ইরান আগেও বহুবার এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যদি তা বাস্তবে ঘটে, তবে অনেক তেলবাহী ট্যাঙ্কার আটকে পড়বে এবং তেলের দাম আকাশ স্পর্শ করবে।

মার্কিন জ্বালানি তথ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বে যে পরিমাণ তেল ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল, এই প্রণালি দিয়ে পরিবহন হয়। তেলের দামের সঙ্গে সব কিছুর দামের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তেলের দাম বাড়লে, বিশ্বজুড়ে বাড়বে মূল্যস্ফীতিও।

গোটা বিশ্ব এখন নানা আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত। তার ওপর ইজরায়েল-ইরান সংঘর্ষ সেই সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলেছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়েও। ট্রাম্পের শুল্ক বসানোর হুমকি বিশ্ব বাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। ইরান-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুতিরা এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে, পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল এবং পর্যটন ক্ষেত্রও কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

গাজা যুদ্ধের কারণে ইজরায়েলও অর্থনৈতিকভাবে চাপে রয়েছে। অন্যদিকে, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান বহু আগে থেকেই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, এখনই কেন ইরানের ওপর হামলা চালানো হল? প্রথমত, প্রায় দুই বছর ধরে ইজরায়েল ইরানের ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’-এর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। দ্বিতীয়ত, ইজরায়েল ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ইরানের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে আসছে। এই ২০ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই নেতানিয়াহুই ক্ষমতায় ছিলেন।

১৯৮১ সালে ইরাকে এবং ২০০৭ সালে সিরিয়ায় পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করা হয়েছিল। দুটি ক্ষেত্রেই ওই পারমাণবিক কর্মসূচিগুলো ইজরায়েলের অস্তিত্বের পক্ষে ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১২ সালে নেতানিয়াহু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের সময় ইরানে হামলার সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তা আটকে দেন। পরে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিও হয়।

কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। অক্টোবর মাসে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইজরায়েল পাল্টা আঘাত করে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দেয়। এরপর লেবাননে হিজবুল্লাহ ভেঙে পড়ে। সিরিয়ায় আসাদের শাসনও দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রের ওপর আঘাত হানার পথ মসৃণ হয়। কিন্তু ট্রাম্পের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় ছিল ইজরায়েল।
অক্টোবরে হামলার পর ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, নতুন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহে রাশিয়ার অস্বীকৃতি, হিজবুল্লাহ নেতৃত্বের ধ্বংস, আসাদের পতন – সব মিলিয়ে বড় হামলার সুযোগ তৈরি হয়। গাজায় ইজরায়েলের আক্রমণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইজরায়েলকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে আমেরিকা। ট্রাম্প চুক্তি চেয়েছিলেন। ইরান চুক্তির শর্ত মেনে চললে, হয়তো হামলা হত না।

প্রশ্ন হলো, ইজরায়েল কি এখন গাজায় হামলা থামিয়ে দেবে? গাজায় হামাসদের ধ্বংস ও ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিকল্পনায় এখনও অটল নেতানিয়াহু। গাজার যুদ্ধ ও ইরান আক্রমণ তার জনপ্রিয়তা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু সন্দেহ রয়েই গেছে।