সুবীর পাল
১৯৭৪ সালে রিলিজ হওয়া ‘মৌচাক’ টলিউডি সিনেমার সেই গানের লাইনগুলো মনে আছে? কি জনপ্রিয়ই না হয়েছিল।
‘নারী পুরুষ সমান সমান আছে যে তার অনেক প্রমাণ।’
Advertisement
সেই গানের সারমর্মের প্রেক্ষাপট তো অবশ্যই আলাদা ও চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক ছিল। তবু ওই একটি লাইনের প্রাসঙ্গিক পরিসরে চার দশক অতিক্রান্তের পড়ে আজও অদ্ভুত রকমের সমত্বের অধিকার দাবি করে আসছে। এমনকি লিঙ্গ সমানুপাতিক সংখ্যাতত্ত্বের সাদা-কালো পরিভাষাতেও। যেখানে আমাদের রাজ্যে, আমাদের দেশে, আমাদের চেনা বা অচেনা পৃথিবীর প্রতিটি কোনে প্রান্তরে এর উৎসুকতা যেন বহুল চর্চার চায়ের চুমুকে ভীষণ রকমের চিরন্তনী।
Advertisement
‘নারী পুরুষ সমান সমান’ এই চারটি মাত্র শব্দ, যার বৈশ্বিক সমতায় জড়ালো হয় মসৃণ মানবজীবনের চলমান নিশ্চয়তা। আর যখন সেই তত্ত্বের বৈষম্য উঁকি দেয় অঞ্চল ভিত্তিতে, তখন সমাজ ব্যবস্থার সমানুপাতের আকাশে দেখা মেলে অস্তিত্বের সিঁদুরে মেঘ। মনুষ্য শাসিত এই দুনিয়ায় বহমান সুশৃঙ্খল জীবনচক্রের স্বার্থে তাই নারী ও পুরুষের সমতুল্য সত্ত্বা সর্বাগ্রে কামনার। অন্তত এই ডিজিটাল যুগের বিশ্বব্যাপী প্রতিটি সমাজের বিবেকবাহী সমস্ত মানুষের কাছে এটাই তো অতন্দ্র কাম্যেরও।
সুতরাং এই তত্ত্বময় চুড়ান্ত প্রত্যাশার সঠিক প্রতিফলন আজকের হালফিল জগতে কতটা তথ্যগত ভাবে বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে তাও ব্যবহারিক গরম তাওয়ায় সেঁকে নেবার প্রয়োজনটা খুব আবশ্যক। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুধাবন করলে ‘নারী পুরুষ সমান সমান’ তত্ত্বকে মোটামুটি ভাবে তাই মান্যতা দেয় অন্তত খাতায় কলমে। এই রিপোর্ট অনুসারে সারা বিশ্বের নিরিখে পুরুষ ও নারীর সংখ্যা অনেকটাই সমানুপাতিক। পৃথিবীতে এখন মোট জনসংখ্যা কমবেশি ৮০০ কোটি। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে ২০২১ সালে ঘোষিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০১ জন পুরুষের জন্য নারীর সমানুপাতিক হার নির্ধারণ করা গিয়েছে ১০০ জনে। এই লিঙ্গ অনুপাতে সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি কোনে প্রকৃতই অনেকটা ‘নারী পুরুষ সমান সমান’ দাবি করে।
সারা বিশ্বের সামগ্রিক পরিসংখ্যানে নারী ও পুরুষের সমানুপাত অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও দেশ ভিত্তিক এই অনুপাত পর্যালোচনা করলে কিন্তু লিঙ্গ অনুপাতে যথেষ্ট তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি কিছু কিছু দেশের ক্ষেত্রে চমকে দেওয়ার মতো নারী ও পুরুষের মধ্যে সংখ্যাগত বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই রিপোর্টে পরিস্কার উল্লেখ করা হয়েছে, পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১২৩টি রাষ্ট্রে লিঙ্গ প্রতিসাম্য নারীদের জন্য খুব একটা উদ্বেগের নয়। কিন্তু উল্টো দিকে ৭২টি দেশে লিঙ্গ ভারসাম্যে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত প্রতিকূল। এই লিঙ্গ অসাম্যের কারণও বর্ণিত হয়েছে রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো, বিশ্ব জুড়ে শৈশবস্থায় নারী মৃত্যুর হার পুরুষের তুলনায় কিছুটা বেশি। সেই কারণেই কিছু কিছু অঞ্চলে পুরুষের তারতম্যে নারীর সংখ্যা সামান্য কম। অন্যদিকে বহু এলাকায় একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষের থেকে প্রাপ্ত বয়সের নারীর গড় আয়ু সামান্য হলেও বেশি। ফলে সেক্ষেত্রে নারীর আনুপাতিক হার পুরুষের থেকে একটু হলেও বেশি। তবে এইসব দৃষ্টান্ত বেশিরভাগ উন্নত দেশের মধ্যে সীমায়িত।
পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার হারে যে দেশটির নাম আলোচিত হয়ে থাকে তা হলো চীন। এই দেশে ১৪২ কোটির যে বিপুল জনগন রয়েছে তার মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের অনুপাত যথেষ্টই অধিক। তথ্যানুসারে এই লাল ফৌজের দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের পরিমাণ থেকে ৫% কম। এখানে জন্মগত লিঙ্গ বৈষম্য এই ব্যবধানের অন্যতম বৃহৎ কারণ।
সংখ্যার বিচারে বিশ্বের মধ্যে যে সমস্ত দেশে নারীর জনবিন্যাস পুরুষের অস্তিত্ব থেকে কিছুটা হলেও বেশি, সেগুলো হলো কানাডা, হংকং, কুরাকাও, ইউক্রেন, লাটভিয়া, নেপাল, ভিয়েতনাম, স্পেন, নরওয়ে, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, পর্তুগাল, বেলারুশ, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, জাপান, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রাশিয়া উল্লেখযোগ্য। আবার নরনারীর মধ্যে অনুপাতগত পরিস্থিতিতে পুরুষের সংখ্যাধিক্যের দৃষ্টান্ত মেলে আলবানিয়া, সিঙ্গাপুর, আর্মেনিয়া, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, মালদ্বীপ, আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড, উজবেকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তান, চেক রিপাবলিক, পাকিস্তান, জর্জিয়া, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে। অন্যদিকে লিঙ্গগত সমানুপাত অনুযায়ী খুবই সামান্যতম ফারাক বা মোটামুটি হারে সমান, এমন দেশের মধ্যে আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, মাল্টা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড অবশ্যই নজর কাড়ে।
তবে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেতে বাধ্য যদি কাতারের লিঙ্গ অনুপাত পর্যালোচনা করা হয়। এখানে প্রতি ১০০০ নারীর অনুপাতে পুরুষের সংখ্যা ৩১১০ জন। যা এই বিশ্বে নারীদের প্রতি সবচেয়ে বিপজ্জনক ও হতাশাজনক তথ্য। নারীদের প্রতি সামাজিক চরম বৈষম্যের কারণেই কাতারের এই লজ্জাজনক হাল বলে মনে করা হয়। কাতারের ঠিক বিপরীত চিত্র আবার স্পষ্ট লাটভিয়ায়। যা প্রকৃতই মানুষকে হতবাক করে। সেই দেশে ১০০০ জন মহিলার পরিমিতিতে পুরুষের অবস্থান মাত্র ৮৫০ জন। এই রাষ্ট্রে পুরুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে নারীর থেকে এতো কমের কারণ হলো যুদ্ধ, অভিবাসন, মৃত্যু হার।
বৈশ্বিক পর্যায়ে নানা দেশের নরনারী অনুপাতের হালহকিকত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি আমাদের দেশের এহেন তথ্যতালাশেও কিন্তু উঠে এসেছে বেশকিছু চমকপ্রদ প্রতিচ্ছবি।
আমাদের দেশে নরনারীর অনুপাত স্বাধীন ভারতে প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫১ সালে। তখন প্রতি ১,০০০ পুরুষের অনুপাতে ৯২৩ জন মহিলা ছিলেন। এই তথ্য স্বাধীনোত্তর দেশের প্রথম আদমশুমারি থেকে মিলেছে। তবে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৯০১ সালে এই অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১০০০ পুরুষ ও ৯২১ মহিলা। ১৯৯১ সালে আমাদের দেশে নারীর অনুপাত থেকে পুরুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। তদানীন্তন সময়ে পুরুষ ও নারীর তারতম্য ছিল প্রতি ১,০০০ জনের জন্য ৯১২ জন। যা এযাবৎকালের মধ্যে ভারতে পুরুষের তুলনায় নারী হ্রাসের এটাই সর্বকালীন জ্বলন্ত নিদর্শন। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে আমাদের দেশে জনগণনার কাজ ২০২১ সালে স্থগিত রাখা হয়। ফলে ২০১১ সালে আয়োজিত সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী যে তথ্য সামনে এসেছে তাতেও নারী ও পুরুষের সংখ্যাগত ফারাক লক্ষ্যনীয় ভাবে কমতে শুরু করেছিল। এই সংখ্যাতত্ত্বে দেখা গেছে নরনারীর প্রভেদের হার ছিল ১,০০০ প্রতি ৯৩৬ জন।
ভারতে নরনারীর পরিসংখ্যানের মধ্যে অন্তর ফারাক কমাতে কেন্দ্রীয় সরকার শেষমেশ স্লোগান তোলে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ নীতির। ২০১৫ সালে এই প্রকল্প চালু করা হয় দেশের ‘নীতি আয়োগ’এর প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুসারে। নারী সুরক্ষার সঙ্গে শিশুকন্যার স্বাস্থ্য উন্নতি ও নারী শিক্ষায় জোর দেওয়ায় প্রসঙ্গে এই প্রকল্পের অধীনে একাধিক সামাজিক পরিষেবা চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার। ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সচেতনতা গড়ে তোলাও ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম কর্মসূচি।
বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প সম্পর্কে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আলোচনার ও সমালোচনার পরিসরে দু’টি ভিন্ন ধারার মতাদর্শ বারেবারে প্রকট হয়েছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে এমন বিপরীত মুখী পর্যালোচনা তো থাকবেই। আর তাতেই তো বিপুল সুফলও মিলেছে হাতেনাতে। সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে এই দেশ এখন নারী আধিক্যের নয়া রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে দুনিয়ার দুয়ারে।
ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে বা এনএফএইচএস) দেশব্যাপী একটি সমীক্ষা চালিয়ে ছিল ২০১৯-২১ সালে। এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার ফলাফল ২০২১ সালে সরকারি ভাবে প্রকাশ করা হয়। আর সেখানেই উদ্ঘাটিত হয়েছে পুরুষের তুলনায় নারী সংখ্যাবৃদ্ধির জয়মাল্য। ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার’ স্বপ্ন আশাকে সার্থক করে সেই সমীক্ষায় অবশেষে প্রতিফলিত হলো গর্বের ভারতীয় ঐতিহাসিক তথ্য, ১০০০ জন পুরুষ প্রতি ১০২০ জন নারী। তবে এই সমীক্ষা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কিন্তু সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। এরাজ্যের পরিসংখ্যান হলো ১,০০০ পুরুষ অনুসারে নারীর স্থান ৯৭৩ জন। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মধ্যে নারী পরিসংখ্যানের অবস্থান সবচেয়ে হতাশাজনক হলো দমন ও দিউ’এ। সেখানে এই হার হলো ১,০০০ পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা মাত্র ৬১৮। তবে একদম বৈপরীত্যের ছবি দেখা গিয়েছে কেরালায়। এই দক্ষিণী রাজ্যের প্রতি ১০০০ পুরুষকে ছাপিয়ে গিয়েছে নারী। এখানে দেশের সর্বোচ্চ স্তরের নারী সংখ্যাবৃদ্ধির অগ্রগতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১০৮৪ জনে।
পরিশেষে এটুকু দাবি করা যেতেই পারে ‘মেরা ভারত মহান’ অন্তত নরনারীর সংখ্যাগত যৌথ উত্তরণের স্বর্ণফসল। পরস্পরের প্রতি হাতে হাত রেখে এগোনোর শপথে। দূরদ্রষ্টা সম্প্রীতির কাজী নজরুল সেকারণেই হয়তো আগাম বলতে পেরেছিলেন, ‘অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’
স্বভাবতই অনুপাত অচলায়তনের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ ভাঙা কবির ভারত আজ যে প্রকৃতই বিশ্ব মসনদের নয়া উজির।
Advertisement



