প্রথম দফাতেই খুন জখম ধর্ষণ অপরাধে অভিযুক্ত ২৫২ জন প্রার্থী ভোটের ময়দানে

Written by SNS April 19, 2024 1:06 pm

ড. কুমারেশ চক্রবর্তী

উনিশে এপ্রিল ২০২৪ শুক্রবার৷ ভারতের লোকসভার নির্বাচন শুরু সকাল সাতটায়৷ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন আমাদের ভাগ্য বিধাতারা, যারা দেশ চালাবেন এবং দেশের বাইরে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন৷ কিন্ত্ত আমাদের এমনই ভাগ্য যে, প্রথম দফার ১০২ টি আসনের মোট প্রার্থীর মধ্যে ২৫২ জন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত৷ ১০২টি আসনে প্রথম দফায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৬২৫ জন, এই ১,৬২৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৬১৮ জনের মনোনয়ন পত্রে দেয়া হলফনামা পরীক্ষা করা হয়েছে৷ একটা সমীক্ষায় দেখা গেলো যে, এর মধ্যে ২৫২ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে৷ তাছাড়া ১৬১ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর মামলা রয়েছে৷ ফৌজদারী মামলা বলতে এখানে ডাকাতি, খুন, জখম, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধে অভিযুক্ত৷ আরও মারাত্মক ধরনের অপরাধী প্রার্থীর সংখ্যা সাত৷

আশ্চর্যের ব্যাপার যে, এরা মনোনয়নপত্র জমা দেবার অনুমতি পেলেন কি করে? তার মানে নির্বাচন কমিশনের মধ্যেই কিছু একটা গুরুতর গলদ থেকে গেছে৷ এই ধরনের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার অধিকার থেকেই বঞ্চিত হওয়ার কথা৷ এরাই হবে আমাদের ভাগ্য বিধাতা! সমীক্ষাতে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে প্রথম দফার নির্বাচনে প্রায় ১৬ শতাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজারী মামলা রয়েছে৷ এখানে উল্লেখযোগ্য যে ফৌজদারি মামলা সাধারণত মারামারি দাঙ্গা খুন জখম ডাকাতি অপহরণ ধর্ষণ প্রভৃতি মারাত্মক অভিযোগ থাকলেই করা হয়৷ তাহলে কি করে এরা আইনের ফাঁক গলে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারে? অবশ্যই তারা বলতে পারেন, যে বিচারাধীন বন্দি কিংবা বিচারাধীন প্রার্থী, এদের তো এখনো সাজা হয়ে যায়নি সুতরাং এদের আসামী বলা যায় না৷ খুব সত্যি কথা৷ তবুও এটা শুধু অজুহাত মাত্র৷ কারণ আইনের ফাঁক গলে এইসব অপরাধীরা বেরিয়ে গেলেও যে দল অর্থাৎ যে রাজনৈতিক দল এদের মনোনীত করছে তারা তো এদের খুব ভালো করেই জানে, অন্তত জনগণের থেকেও বেশি জানেন৷ তাহলে তারা কি করে এদের মনোনয়ন দিলেন? তাহলে নীতি আদর্শ মূল্যবোধ এসব কি রাজনৈতিক দলে থাকতে নেই? শুধুমাত্র দলের সংকীর্ণ স্বার্থে বলা ভালো দলের গোষ্ঠীবদ্ধ নেতাদের ব্যক্তি স্বার্থে এরা মনোনয়ন পেয়ে থাকেন৷ আগে রাজনৈতিক দলের সম্পদ ছিল শিক্ষা দীক্ষা, সমাজসেবা এবং চরিত্র৷ আর এখন দলের প্রধান সম্পদ হচ্ছে দুর্নীতি আর পেশি শক্তি৷ আশ্চর্য ব্যাপার এইসব প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ জিতেও যাবে এবং জিতে তারাই আবার আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা ঠুকে দেবে, শাস্তি দেবে৷

একটি সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে, নির্বাচনে দুর্বৃত্তদের আনাগোনা ক্রমশ বেডে়ছে৷ অর্থাৎ রাজনীতি এখন দুর্বিতায়নে আচ্ছন্ন৷ আগের নির্বাচন গুলোর থেকে বর্তমানে নির্বাচনে মনোনীত অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বেডে়ই চলেছে৷ এমনকি বামপন্থী প্রার্থীদের মধ্যেও এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তবে নিঃসন্দেহে আশার কথা যে কমিউনিস্ট বা বামপন্থীরা এখনো পর্যন্ত এদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে৷

ভারতের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক দশক ধরেই৷ এই প্রবণতা চলছে চলবে৷ স্বাভাবিকভাবেই দেখা গেছে যে, শাসক দলেতেই সবচেয়ে বেশি অভিযুক্তদের সংখ্যা থাকে৷ যে সমীক্ষা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রথম দফার নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত প্রার্থী আছে শাসক দল বিজেপিতে৷ তারপরেই কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিতে৷ ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটে মাত্র ১০২ আসনে যে ২৫২ জন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রার্থী রয়েছে তার মধ্যে বিজেপির সংখ্যা হচ্ছে ২৮ অর্থাৎ বিজেপি মনোনীত ৭৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ২৮ জন বিভিন্ন ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত৷ পার্সেন্টেজ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, বিজেপির প্রথম দফার মোট প্রার্থীর ৩৬ শতাংশ হচ্ছে অপরাধী বা অভিযুক্ত প্রার্থী৷ এর পরেই আছে জাতীয় কংগ্রেস৷ কংগ্রেসের প্রথম দফায় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন ৫৬ জন প্রার্থী৷ এই ৫৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন হচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত! এখানেও শতকরা হিসেবে মোট প্রার্থীর ৩৪ শতাংশ হচ্ছে অভিযুক্ত প্রার্থী৷ প্রথম দফার নির্বাচনে বিহারে লালুপ্রসাদজির আর জে ডি দলের ১০০ শতাংশই হচ্ছে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত৷ অর্থাৎ প্রথম দফার নির্বাচনে বিহারে সমাজবাদী পার্টির যে চারজন প্রার্থীর নাম ঘোষিত হয়েছে তার মধ্যে চারজনই বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত৷ তার মধ্যে একজন তো অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের অভিযুক্ত৷

ভারতে এখন বহু রাজ্যেই আঞ্চলিক দলগুলি সরকার পরিচালনা করছে ৷ফলে এই ধরনের শাসকদলের মধ্যে অপরাধের সংখ্যা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে৷ যদিও এইসব অভিযুক্ত প্রার্থীরা বেশিরভাগই দেওয়ানি মামলায় অভিযুক্ত অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক দুর্নীতি, স্বজন পোষণ চাকরি পাইয়ে দেয়া প্রভৃতি অপরাধে অভিযুক্ত৷ তবে ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত প্রার্থী আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে আছে৷ এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ডি এম কে, আর জে ডি এবং তৃণমূল৷

উনিশে এপ্রিল থেকে মোট ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে৷ মূলত ইলেকশন ওয়াচ এবং এসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্ম সংস্থার সমীক্ষা থেকেই এই তথ্যগুলি পাওয়া গেছে ৷তাছাড়া আরও বিভিন্ন সংস্থা থেকে এগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে৷ তবে যেটা খুব দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁডি়য়েছে তা হচ্ছে শাসক দলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির বাসা৷ রাজ্য কেন্দ্র সর্বত্রই একই চিত্র৷ সকলেই শাসন ক্ষমতায় আসার আগে স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দেন৷ তারপর ক্ষমতায় কয়েক বছর কাটার ফলেই যথারীতি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন৷ যেমন ১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীজি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন তৈরি করবেন এবং অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন৷ কিন্ত্ত এখন চিত্রটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে তার প্রমাণ প্রথম দফাতেই দলের নির্বাচন প্রার্থীদের অপরাধের তালিকা এবং সংখ্যা৷
অভিযুক্ত প্রার্থী প্রসঙ্গে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, লোকসভা বা বিধানসভাতে শুধু নয় নিম্নতর ক্ষেত্রেও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি৷ ভারতের প্রায় অধিকাংশ রাজ্যের সর্বত্রই সব দলেরই “সম্রাট শাহজাহানে”রা বুক ফুলিয়ে রাজত্ব করছে৷