• facebook
  • twitter
Monday, 19 May, 2025

ধর্মীয় ধর্মে আমিত্বের আমিতে আমার ভারতবর্ষ

ভারতবর্ষ শুধু হিন্দুর নয়। নয় শুধু মুসলমানের।

প্রতীকী চিত্র

সুবীর পাল

প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছেন এক নারী। মনে মনে তবু তিনি ভাবছেন, আমার আগত সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। পুরুষ দিয়েছেন ঔরস। নারী দিয়েছেন জঠর। বৈশ্বিক জনবন্ধনের পরম্পরার চিরন্তনী প্রাকৃতিক সহযাত্রায় নতুন করে সুচিত হলো আবাহণ। প্রসব পর্বের সমাপ্তিতে হলো আবির্ভাবের সঞ্চার। কার আবার? এই ধরণীর নয়াতম সদস্য আমার। জন্মালাম আমি। মূহুর্তে শুরু করলাম চিল চিৎকার। গলা ফাটিয়ে। প্রথম বারের মতো আমি জানান দিলাম, আমি এসেছি। এরপরেই মাতৃদুগ্ধ পান করার জন্য নীরব উৎসুক। মাতৃস্তন বৃন্তে ঠোঁট লাগিয়ে সর্বপ্রথম নিজের অধিকার বুঝিয়ে দিলাম এই সমাজকে, এটাই আমার এখনকার মতো বেঁচে থাকার পরমতম আশ্রয় ছায়া। এ যেন পৃথিবীতে পা দিয়েই নিজের ‘আমিত্ব’কে পাকাপাকি ভাবে বুঝে নেওয়ার পালা। ‘আমি’ মনষ্কতায়। শুরু হলো আমৃত্যু পথ চলা স্বীয় আমির অস্তিত্বে এক পৃথক আমিত্বের অভিসারে। যা বিশ্বব্যাপী আটশো কোটি আলাদা আলাদা মানবরূপী আমিগুলির থেকে পরিপূর্ণ পৃথক অথচ অনেকটা একাত্মতার এক স্বতন্ত্রতার আমি হলাম সেই স্বয়ং আমি। সেই সেই সেই একমেবাদ্বিতীয়ম পবিত্র আত্মার পরম অংশের প্রতিনিধি স্বরূপ।

আমার আমিত্বের একটা সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে কবিগুরুর ‘আমি’ কবিতায়। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে। আমি চোখ মেললুম আকাশে- জ্বলে উঠল আলো পুবে পশ্চিমে। গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’-
সুন্দর হল সে। তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা। এ কবির বাণী নয়। আমি বলব এ সত্য, তাই এ কাব্য। এ আমার অহংকার, অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।’

এটাই বোধ হয় মনুষ্যত্বের আমিত্বের মহিমান্বিত প্রকাশ। সঙ্গে চলতে থাকে জীবনের চলন বলন অভিযোজন বেঁচে থাকার সরণিতে। সেখানকার উত্তরণে পলকে পলকে বিজ্ঞাপিত হয় নানা মতবাদের বিভিন্ন মাইলস্টোন। এমনই এক মাইলস্টোনের অন্যতম উপাচার ‘ধর্ম’। ব্যাস বাকি জীবনটায় খেলা হবে খেলে হবে করতে করতেই জায়গা দখল করে বসে আমি ও ধর্মের এক আদিম দ্বন্দ্ব- ভারসাম্যের মাদারী খেলা।

তবুও আমি কিন্তু কোনও ধর্ম সঙ্গে নিয়ে জন্মাইনি। মৃত্যুর সময়ও কোনও ধর্ম আমার পাশে থাকবে না। এ’ব্যাপারে আমি কোটি কোটি শতাংশ অন্ধ নিশ্চিত। তবুও আমি নতমস্তকে তামাম মনুষ্য বিশ্বাস সৃষ্ট যাবতীয় সর্ব ধর্মের অপার শান্তি মন্দ্রিত আধ্যাত্মিক ঔদার্যের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল হবো, এটাই এই ধরণীর একান্ত কাম্য। সেই শৈশববেলা থেকে এই প্রবীণমেলাতেও বেঁচে থাকার অবিচ্ছেদ্য প্রেক্ষাপটে কোনও একটি ধর্মের উপর আমি অবশ্যই প্রকৃত হৃদয় সঙ্গম করে চলেছি অন্তরাত্মার অঘোম আকর্ষণে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক, নিজ ধর্ম সহ অপরের সকল ধর্মের উপাসনার নামে অমনুষ্যত্ব, ঘৃণা, অসম্মান, বর্বরতা, অসভ্যতা, পক্ষপাতযুক্ত নারী-পেষণ, বিদ্বেষ, ভেদাভেদ, অতি-তোয়াজ মনষ্ক ধান্দার ছদ্মবেশ, তোষণ-রাজনীতি ও উন্মাদনা আমার জীবনে অর্থহীন, প্রশ্রয়হীনতার, অমান্যতার সঙ্গে ধিক্কারেও। এটাই তো আমিত্বের থেকে সমাজের এক চুড়ান্ত প্রত্যাশা।

সবশেষে এই পৃথিবীর কোনও ধর্মকে আঘাত না করে, বিশ্বের সকল ধর্মের সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে বিনম্র সম্মান জানিয়েই আমি স্পষ্টভাবে সদর্পে বলি, আমার জীবন বিশ্বাসের পবিত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ের জীবন গ্রহণীয় আছে তো একটা ধর্ম। যা আমার প্রতিটি দিনের শেষে কাম্য মার্গে তপস্যার নমস্য অহংকারও। এই ধর্ম আমার ব্যক্তি নিঃশ্বাসের বৈদিক স্বভিমান, আমার নিজস্ব প্রশ্বাসের ঐশ্বরিক পীঠস্থান। ঔঁ শান্তি, ঔঁ শান্তি, ঔঁ শান্তি। হ্যাঁ এই শান্তির পথে কাঙ্ক্ষিত সাম্যই তো চায় আমাদের বিশ্ব। বা আমাদের মানব দুনিয়া। সৌহার্দ্যের অভিলাষে।

দুখু মিঞা। আক্ষরিক অর্থেই দুখু মিঞা বা কাজী নজরুল ছিলেন একজন প্রকৃতই মানুষ। মানবিক মুসলিমের পরিচয়ে। তিনি তাই সাম্যের গান গেয়েছিলেন, “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ।” এ গান আমার প্রাণে সুধা। আমার ব্যক্তি পরিচয়ের পুন্য বীজমন্ত্র। এ গানের সুরে সুরে বাল্যকাল থেকেই আমি কখন অজান্তেই শিখে গেছি অহংকারের স্রেফ দুটি মাত্র ব্রহ্মশব্দ, ‘আমি ভারতবাসী।’ বোধহয় এটাই আমার আমিত্বের প্রশিক্ষিত ধর্মীয় স্লোগান।

তিনি যে গুরুদেব। আমার অস্তিত্বের পূর্ণ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুর মহাশয় সর্বনেষে কিছু বলে ফেলেননি তো? অতি গেরুয়া কমুন্ডলধারীদের প্রশ্নটা করতেও কিরকম কিরকম সংশয় লাগে। আসলে তাঁদের রথের উদ্ধত ধূলা উড়িছে যে হিমাচল থেকে কেরালা। তবু স্মরণ করাই মুসলিম ধর্ম সম্পর্কে নোবেলজয়ী এই কবির একটি কালজয়ী লেখা, ‘জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম। মহান এই ধর্মমতের অনুরাগীদের দায়িত্বও তাই বিশাল। ইসলামপন্থীদের মনে রাখা দরকার, ধর্ম বিশ্বাসের মহত্ত্ব আর গভীরতা যেন তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ওপর ছাপ রেখে যায়। আসলে, এই দুর্ভাগা দেশের অধিবাসী দুটি সম্প্রদায়ের বোঝাপড়া শুধু তো জাতীয় স্বার্থের সপ্রতিভ উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না, সাহিত্যদ্রষ্টাদের বাণী নিঃসৃত শাশ্বত প্রেরণার ওপরও তার নির্ভরতা। সত্য ও শাশ্বতকে যারা জেনেছেন ও জানিয়েছেন, তারা ঈশ্বরের ভালবাসার পাত্র, এবং মানুষকেও তারা চিরকাল ভালবেসে এসেছেন।’
শুধু অতি গৈরিকতার দিকে একতরফা আঙ্গুল তুলে কি লাভ! সবুজ ঘাসের বাগিচায় দুগ্ধবতী গরুর উদ্দেশ্য-অতিআদর প্রকারান্তরে প্রকৃতই মুসলিমদের জাত্যাভিমানে আঘাত দেওয়া হয়। তাঁরাও যে এই মহামানবের তীরে ভারতবর্ষেরই মানুষ। নাই বা কষলাম সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর সাপলুডু পাটিগণিত। আসলে এই ধর্মকেন্দ্রিক ভোট ভেদাভেদের সম্পর্কে বিবেকানন্দের বিশ্ববন্দিত উক্তিতে কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি দৃষ্টিকটু লালিতের উপলব্দি। ‘যখনই কোনও ব্যক্তি উঠিয়া বলে, আমার ধর্মই সত্য ধর্ম, আমার অবতারই একমাত্র সত্য অবতার, সে ব্যক্তির কথা কখনই ঠিক নহে, সে ধর্মের ‘ক’ পর্যন্ত জানে না। ধর্ম কেবল কথার কথা বা মতামত নহে অথবা অপরের সিদ্ধান্তে কেবল বুদ্ধির সায় দেওয়া নহে। ধর্মের অর্থ প্রাণে প্রাণে সত্য উপলব্ধি করা; ধর্মের অর্থ ঈশ্বরকে সাক্ষ্যভাবে স্পর্শ করা, প্রাণে অনুভব করা, উপলব্ধি করা যে, আমি আত্ম-স্বরূপ আর সেই অনন্ত পরমাত্মা এবং তাহার সকল অবতারের সহিত আমার একটা অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রহিয়াছে। …তােমরা সকল দেশের সকল যুগের ধর্মপ্রাণ মহান নরনারীগণকে চিনিতে শিখ আর ইহাও লক্ষ্য করিও বাস্তবিক তাহাদের পরস্পরের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নাই।’

রবি কবি যেমন মুসলিম পবিত্রতার উদারত্য আমাদের শিখিয়েছেন তেমনি হিন্দুত্বের নান্দনিক পরিভাষা সমাজে ছড়িয়ে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবশিষ্য নরেন। তাই তিনিই বলতে পারেন এই অঘোম সত্যতা। ‘যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই স্বীকার করি।’

তা রবীন্দ্রনাথ নজরুল বিবেকানন্দ যে যা বলুক বলতেই পারেন। এই মনীষীগণ কখনই অতি তোষণশীল ছিলেন না। ছিলেন আমিত্বের উপলব্ধিতে সুউচ্চ মার্গের পরধর্ম শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বিশ্বে ব্যতিক্রম যে অনন্ত বহমান। তাই হয়তো চোরা না শোনে ধর্মের কথা। ধর্ম সেটা আবার কি? ধর্ম তো আফিম। ধর্ম আমরা মানি না মানছি না। আমরা আসলে বিদেশ ভূঁই থেকে ধার করা সাম্যবাদ শিখে নিয়েছি। আমাদের রক্তিম গডফাদার লেনিন, স্টালিন অথবা মাও সে তুং। তবু মাইকেল দত্তর ‘পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি। কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!’ ভেবে আমাদেরই দেশের সাম্যবাদী সন্ন্যাস নেতা বিবেকানন্দ এই বাণীটি একটিবার শ্রবণ করলে ক্ষতি কি? ধর্মের পরিপূর্ণ মান্যতার ভিত্তিস্থাপন করে ভারতের ভবিষ্যত অভিমুখের দিশা বহু আগেই বর্ণনা করে গেছেন। ‘বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কখনও বিরােধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য-সাধন করিয়া গিয়াছে—সেইজন্যই এখানে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত।…সকল ধর্মে ভালাে ভালাে লােক আছে, এই কারণেই সেইসব ধর্ম লােকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া থাকে, সুতরাং ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।’ এমনকি অযাচিত পর্যায়ে অবজ্ঞা বা অবহেলা করাও সমীচীন নয়।

ভারতবর্ষ মানে রঙতুলির একটা তেরঙা ম্যাপের ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যের স্কেচ আঁকা নয়। ভারতবর্ষ শুধু নির্বাচনের হিসেব নিকেষ নয়। ভারতবর্ষ শুধু হিন্দুর নয়। নয় শুধু মুসলমানের। নয় অন্য কোনও বিশেষ ধর্ম পীঠস্থানের। এই দেশ একশো চল্লিশ কোটি ভারতীয়ের গর্বিত সমন্বয়ের দেশ। এই দেশ সর্বধর্মের পুন্যভূমির দেশ। তাই যে উচ্চস্বরে আমি বারবার ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান, নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি।’
হ্যাঁ আমি গর্বিত। আমার আমিত্বে প্রাণবন্ত। ধর্মীয় ধর্মে উচ্ছ্বসিত। আমার অহংকার এই ভেবে, “ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো…।”